দেশে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও থেমে নেই উন্নয়ন কর্মকাÐ। ঘর থেকে বের হলেই চোখে পড়বে রাস্তার কাজ চলছে। রাস্তার কাজের চেয়ে আমার আগ্রহ নারী নির্মাণ শ্রমিকদের প্রতি। এই নারী শ্রমিক তাদের পুরো সামর্থ্য দিয়ে কাজ করলেও একজন পুরুষ শ্রমিক যা মজুরি পাবে তার অর্ধেক পাবে ওরা। এই বৈষম্য হয়ত একদিন থাকবে না। কিন্তু তারা যে এই পেশায় আসার সাহস করেছে এটাই নারী মুক্তি আন্দোলনের অংশ। আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীরাই মূলত নারী স্বাধীনতার পথটা পরিষ্কার করছে। নারীর স্বাধীনতা অর্জনের চাওয়া ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
সামাজিক বিচারের ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্য যাতে না থাকে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পুরুষদের ওপর নারীদের অর্থনৈতিকভাবে নির্ভর করার কারণেই নারীরা বৈষম্যের শিকার। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পুরুষেরাই যেহেতু মূলত অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই স্বাভাবিকভাবেই সেখানে লিঙ্গ বৈষম্য চলে আসে। নারী-পুরুষের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠাই নারী স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য।
তিন দশক ধরে প্রায় আমাদের দেশে নারী শাসন চলছে। অনেক উঁচু উঁচু পদে অভ‚তপূর্বভাবে নারীর পদায়ন ঘটেছে। তা দেখে আমরা উচ্ছ¡সিত। আবেগ আপ্লুত হই। নারীর ক্ষমতায়নে আমরা প্রশংসিত হই। আমরা আরও বেশি আনন্দিত হই যখন আমরা দেখি নারী ও মেয়ে শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতি অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রসূতি মাতৃ মৃত্যুহার কমেছে, শিশু মৃত্যুহার কমেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মেয়েশিশু ছেলে শিশুর সমান হার অর্জন করেছে। শিক্ষার পরবর্তী স্তরগুলোতেও মেয়েদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাÐেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে তা শুধু গ্রামীণ অর্থনীতিতে নয় জাতীয় অর্থনীতি, শিল্পখাতসহ নানাখাতে নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জকভাবে বেড়েছে।
এই সাফল্যগাথাই শেষ কথা নয় দুর্ভাগ্যের মত আমাদের সমাজকে আঁকড়ে ধরে আছে নারীর প্রতি সহিংসতা। কিছুতেই যেন এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার খবরে আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। জাতিসংঘের মহাসচিব অন্ত্যেনিও গুতারেস বলেছেন, বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা। আমাদের দেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্বৃত্তায়ন ও তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির কারণেই সমস্ত অপরাধের বিস্তার ঘটছে।
জাতিসংঘ নারী সংস্থা ২০২০ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য করেছে, ‘আমি সমতার প্রজন্ম’। নতুন প্রজন্মের কিশোরী তরুণীদের জীবন মানে সমতা আনা এই প্রতিপাদ্যের লক্ষ্য। তাদের নিরাপদ ও নিরাপত্তাপূর্ণ যৌন জীবনের অধিকার এবং প্রজনন ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করাও এই প্রতিপাদ্যের একটি লক্ষ্য। বাংলাদেশের নারী সমাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমাদের সংস্কৃতি এবং মানসিকতা নারী স্বাধীনতায় মূল প্রতিবন্ধক। আমাদের শিক্ষার গুণগত মান ও সুশাসনই পারে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে।
নারী মুক্তি নারী স্বাধীনতা শব্দগুলো শুধু পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। নিয়মের বিরুদ্ধে, প্রথার বিরুদ্ধে, দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে, নারীর উন্নয়ন নীতি ঘোষিত হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাল্যবিবাহ সারা পৃথিবীতে কমেছে কিন্তু বাংলাদেশে বেড়েছে। ইউনিসেফের হিসেবে বাল্যবিবাহের হার ৫৯ শতাংশ যদিও সরকারের দাবি ৫২ শতাংশের বেশি নয়। নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক অধিকারগুলো বাস্তবায়ন সরকারকেই করতে হবে। কাগজে কলমে নারী নাগরিক হিসেবে পুরুষের সমান অধিকার থাকা সত্তে¡ও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়া নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নারীর অধিকারগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমেই নারী-পুরুষের সমতা আসতে পারে। নারীর অধিকার শুধু নারীর বিষয় নয়। এটা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। এটা সামাজিক শৃঙ্খলার প্রশ্ন। আমি মনে করি ন্যায় ও ন্যায্যতায় বিশ্বাসী পুরুষেরা কখনও নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে না। সুস্থ সুন্দর পারিবারিক বন্ধনে বেড়ে ওঠা পুরুষেরা নারীকে কখনও লাঞ্ছিত করে না, অসম্মান করে না।
যে পুরুষ পরিবারে লৈঙ্গিক বৈষম্যের সুযোগ পেয়ে বড়ো হয় তারাই সমাজকে বিষিয়ে তোলে। নারীরও একটা ভ‚মিকা রয়েছে পুরুষকে অসীম ক্ষমতাবান করে তোলার পেছনে। যা নারীরাই নিজের অজান্তে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বৈষম্যের দেওয়াল তুলে দিয়ে বিষবৃক্ষ রোপণ করে দেয়। আমাদের আগে বিষয়টা ভাবতে হবে। জেন্ডার সমতাভিত্তিক একটা সমাজ পাওয়া সহজ কথা নয়। আমাদের অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
নারী দিবস মানে পুরুষদের প্রতি বিষোদগার নয়, অসুস্থ প্রতিযোগিতা নয়। এটা একটি ভয়াবহ সামাজিক ও মানসিক সমস্যা। প্রতিটি সচেতন নারী-পুরুষের মিলিত উদ্যোগে এর সমাধান আসতে পারে।