পাহাড়ী রূপকথার গল্প
হবি বুড়ি ভুদুনি ও কচ্ছপ
অনেক অনেক আগের কথা। পাহাড়ের একটি ছোট্ট গ্রামে এক বুড়ো-বুড়ি আর তাদের ছোট্ট মেয়ে বাস করতো। তাদের দিন সুখেই কাটছিলো। মেয়েটির নাম হবি। হবিকে বাসায় রেখে প্রতিদিন বাবা-মা জঙ্গলে খাবার সংগ্রহ করতে যেতো। আর প্রতিদিনই মেয়েটি তাদের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতো। জঙ্গল থেকে ফুল আর ফল এনে দেওয়ার নাম করে তারা তাকে বাড়িতে রেখে যেতো। একদিন প্রতিদিনের মতো তারা মেয়েকে রেখে জঙ্গলে গেলো। সেদিন তারা একটু পাহাড়ে উঁচুতে যেখানে পাহাড়ী ফল পাওয়া যায় সেখানে যাবে বলে ঠিক করলো।
যেতে যেতে অনেক দূর যাওয়ার পর বুড়ির পিপাসা লাগে। সে বুড়োকে বলে, ও বুড়ো, আমার পানির পিপাসা লেগেছে।
বুড়ো ভাবে, তার নিজেরও অনেক্ষণ ধরে পিপাসা লেগেছে, কিন্তু সাথে তো পানি আনেনি। তাই বুড়িকে বললো, বুড়ি, পানি খুঁজতে হবে, যদি পায় তবে ভাগ করে খাবো।
এই বলে তারা পানি খুঁজতে থাকলো। অনেক্ষণ খোঁজার পর বুড়ো একটা পাথরের খাঁজে একটু পানি দেখতে পেলো। বুড়ো বুড়ি কে ডেকে বললো, বুড়ি, আগে তুই খা, তবে আমার জন্যও রাখিস, আমারও পিপাসা পেয়েছে।
বুড়ি আচ্ছা বলে যেইনা খাওয়া শুরু করেছে তার পিপাসা যেন মিটেই না। খেতে খেতে সে পুরোটাই খেয়ে ফেললো। তা দেখে বুড়োর তো ভীষণ রাগ হলো। সে বুড়োর দিকে আঙুল তুলে বললো, তুই দূর হ।
সঙ্গে সঙ্গে বুড়ি কচ্ছপ হয়ে গেলো। (তখনকার যুগটা এতোই সত্য ছিলো যে সরল মনের কেউ কাউকে অভিশাপ দিলে সাথে সাথে ফলে যেতো। দূর হ = কচ্ছপ হয়ে যা)
বুড়ির এই অবস্থা দেখেতো বুড়োর হাত কপালে উঠলো। রাগ করে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। এখন কি করবে সে। সে তো আসলে বুড়িকে খুব ভালোবাসে। কাঁদতে কাঁদতে সে বাসায় ফিরে যায়। এদিকে বাসায় হয়েছে আরেক জ্বালা। ছোট্ট মেয়েটা সারাক্ষণ ‘মা কোথায় মা কোথায়’ বলে কান্নাকাটি করে।
গ্রামের মুরুব্বীরা সবাই বুড়োকে পরামর্শ দিলো আবার বিয়ে করতে। কি আর করা, বুড়ো হবির দিকে তাকিয়ে আবার বিয়ে করলো। ঘরে আসলো হবির নতুন মা ভুডুনি আর তার মেয়ে ধবি। হবি তো খুশিতে সারাক্ষন বাসার এ মাথা থেকে ও মাথা নাচানাচি করে আর সবাইকে তার নতুন মা সম্পর্কে গল্প করে।
প্রথম কয়েকদিন ভুদুনি হবি কে মাথায় তুলে রাখলো। বুড়ো ও তা দেখে খুশি হলো। কিন্তু কয়েকদিন পর বুড়ো যখন আবার খাবার আনতে বনে যাওয়া শুরু করলো ভুদুনি হবির উপর অত্যাচার শুরু করলো। সে বাড়ির সব কাজ ছোট্ট মেয়েটিকে দিয়ে করাতে লাগলো। হবি ও নীরবে সব করতো মায়ের আদেশ মনে করে। কিন্তু হবি প্রতিবাদ করতো না দেখে ভুদুনির যেন গা জ্বলে যেতো। সে হবির কাজ আরো বাড়িয়ে দিলো। এমন কি অইটুকুন মেয়েকে সে বনের মধ্য দিয়ে দূরে কাপড় কাচতে পাঠাতো আর মনে মনে প্রার্থনা করতো যাওয়ার সময় যেন হবিকে বাঘে খেয়ে ফেলে। একদিন হবি নদীর পাড়ে কাঁদতে কাঁদতে কাপড় কাচছিলো। এমন সময় সে তার আসল মাযের গলার আওয়াজ শুনতে পায়। তার মা যেন তাকেই ডাকছে। আশে পাশে তাকিয়ে দেখে একটা কচ্ছপ তার মায়ের গলায় তাকে ডাকছে। সে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে?
কচ্ছপটি উত্তর দিলো, আমি তোর মা।
সে মা বলে কচ্ছপটিকে হাতে নিলো।
মা বললো, তোর বাবা আমাকে জঙ্গলে ফেলে গিয়েছিলো। সেই থেকে আমি এখানেই থাকি।
হবি কেঁদে বলে, মা গো, তুমি আমার সাথে বাড়িতে চলো। তোমার আর এখানে থাকতে হবে না।
মা হেসে বললো, তা কি আর হয় রে। এখন এটাই আমার বাড়ি। তুই প্রতিদিন এখানে আসিস। মা মেয়ে মিলে প্রতিদিন গল্প করবো। তুই আবার ভয় পাসনে। এই জঙ্গলে সবাই তোকে চেনে। তারা তোর কোন ক্ষতি করবে না।
হবি খুব খুশি হয়। এরপর সে বাড়ির সব কাজ সেরে তাড়াতাড়ি নদীতে কাপড় আর থালা-বাসন ধুতে যায় আর মায়ের সাথে খুব গল্প করে।
এদিকে ভুদুনি তো খেয়াল করে হবি আর আগের মতো শুকনো মুখে থাকে না। মাঝে মাঝে অকারণে হেসে ওঠে। ব্যাপার কি জানার জন্য পরের দিন তার মেয়ে ধবিকে হবির পিছনে পাঠায়। ধবি সব দেখেশুনে মা কে এসে বলে দেয়। ভুদুনি তখন রেগে আগুন। সে তখন ফন্দি আটে কিভাবে ঐ কচ্ছপটাকে ধরে রান্না করে খাবে। সে বাড়ির উঠোনে রাখা মাটির হাড়িগুলো ভেঙে তার বিছানায় ছড়িয়ে দেয়। এর উপরে একটি চাদর দিয়ে শুয়ে থাকে। বুড়ো যখন বাড়িতে ফিরে সে উহ্ আহ্ করতে থাকে। এদিকে বিছানা নড়াচড়া করলে ভাঙা হাড়িগুলো চড়চড় করে আওয়াজ করে। বুড়ো তখন জিজ্ঞেস করে, ভুদুনি তোমার কি হয়েছে?
ভুদুনি আরো বেশি নড়চড়া করে আর ভাঙা হাড়ি গুলো চড়চড় করে। উহ্ আহ্ করতে করতে বলে তার হাড়ভাঙা-চাড়ভাঙা রোগ হয়েছে। এজন্য হাড়গুলো চড়চড় করছে।
বুড়ো বদ্যি আনার কথা বললে সে বলে বদ্যি এসে ওষুধের নাম বলে গেছে। অমুক নদীতে যে কচ্ছপটা থাকে তা রান্না করে খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। নাহলে সে মারা যাবে।
এদিকে হবি ভুদুনি আর বুড়োর কথা গুলো শুনতে পায় আর ভুদুনির মতলব বুঝতে পারে। তাই সে পরের দিন সকালে উঠেই নদীর কিনার থেকে গান গেয়ে গেয়ে তার কচ্ছপ মা কে কিনারে না আসতে অনুরোধ করে কিন্তু এসব করেও মা কে বাচাতে পারলো না হবি। ভুদুনির জেলে গিয়ে ঠিকই তার কচ্ছপ মা কে ধরে এনে দিলো।
ভুদুনির কি তাতেও মন ভরে! সে হবিকে কাছে ডেকে বলেÑ যা অই কচ্ছপটিকে কেটে রান্না করে আন।
হবি কান্নায় ভেঙে পড়লো। সে কি করে তার মাকে কেটে রান্না করবে? সে তার মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাদে। তখন ওর কচ্ছপ মা বলেÑ কাঁদিস না রে মা। তোর হাতে আমি মরবো না। এই দেখ আমি কচ্ছপের খোলস ত্যাগ করে বাড়ির চালে যে লাউটা ধরেছে ওখানে যাচ্ছি।
এই বলে কচ্ছপটি প্রাণ শূন্য হয়ে গেল। হবির মন তখন আবার খুশিতে নেচে ওঠে।
এরপর সে কাজের ফাকে প্রতিদিন লাউটার গা মুছে দেয়, আনমনে লাউটার সাথে গল্প করে দিন কাটাতে লাগলো। এদিকে ভুদুনি তো হবির কা- দেখে অবাক। সে কিছুতেই খুঁজে পাই না হবি এতো হাসিখুশি থাকার কারণ কি! সে আবার নিজের মেয়ে ঢবিকে ডেকে বলেÑ এই রে আমার সুন্দরী মেয়ে, কি লালটুকটুক হয়েছিস দেখতে। শোন, কাল হবির সাথে খেলা করবি, সে যেখানে যায় সেখানে যাবি। তারপর রাতে এসে সব খবর আমাকে বলবি।
পরেরদিন ঢবি মায়ের কথামত কাজ করে। সে সারাক্ষণ হবির পিছন পিছন থাকে। হবি পানি আনতে গেলে সেও যায়,রান্না ঘরে গরমের মধ্যেও চুপচাপ হবির পাশে বসে থাকে এমন কি হবি লাউয়ের সাথে কথা বলার সময় ও সাথে থাকলো। হবি ছোটবোনটিকে খুব ভালোবাসতো। তাই সে কোন সন্দেহ করলো না।
এদিকে রাত হতেই ঢবি গেলো মায়ের কাছে আর সারাদিনের সব খবর জানিয়ে দিলো। ভুদুনি তখন মুচকি হেসে মাথা নাড়ে। মেয়েকে আদর করে মিষ্টান্ন খেতে দেয়।
পরের দিন ভোর হতে না হতেই রান্না ঘর থেকে দা টা এনে লাউটাকে এক কোপে কেটে ফেললো। আগেরবার মতো এবারও হবি কে ডেকে বললোÑ যা অই লাউটিকে কেটে রান্না করে আন।
হবি লাউটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আবার কাদতে থাকে। কাউকে বলতে পারে না সে মনের কথা। কেউ যে শোনার নেই। একমাত্র এই লাউ মা টাই ছিলো তার সুখ দুখের সাথী। এখন সে কার জন্য বেঁচে থাকবে?
কাঁদতে কাঁদতে সে লাউটাকে রান্না করে আর মনে মনে ঠিক করে, এই পৃথিবীতে আর নয়। কালই সে পানি আনতে গেলে গাঙে ডুব দিয়ে মরবে।
কিন্তু রাতে ঘটলো আশ্চর্য ঘটনা। হবি তার আসল মাকে স্বপ্ন দেখলো এবং শুনলো মা তাকে বলছে-
হবি, মা আমার, তুই কষ্ট পাস না। আমি এখন বনের মাথায় যে চন্দন গাছটি আছে সেখানে আছি।
হবির জীবনটা আবার খুশিতে ভরে উঠলো।
এসময় রাজ বাড়ি থেকে পেয়াদা আসলো। রাজ্য জুড়ে ঢোল পিটিয়ে বলতে লাগলোÑ শোন শোন প্রজাগণ, আমাদের রাজ্যের রাজকুমার মরণব্যধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাকে সুস্থ করতে হলে খাঁটি বাঘের দুধ খাওয়াতে হবে। যে রাজকুমারের জন্য বাঘের দুধ নিয়ে আসতে পারবে তাকে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা দেয়া হবে।
এই খবর পেয়ে ভুদুনীর চোখ লোভে চকচক করে উঠলো। সে ফন্দি আটতে লাগলো কিভাবে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা বাগিয়ে নিতে পারে। সব ভেবে চিন্তে সে তার মেয়ে ঢবিকে একটি বাঁশের চোঙ ভর্তি ছাগলের দুধ দিয়ে বললোÑ শোন, রাজার বাড়ি যাবি, সবাইকে বলবি তুই রাজকুমারের জন্য বাঘের দুধ নিয়ে এসেছিস। দুধ চাইলে এটা দিয়ে দিবি। আর পুরস্কারটা নিয়ে সরাসরি বাড়িতে চলে আসবি।
ঢবি রাজসভায় গিয়ে তার মা যা বলেছে তাই হুবহু বলে দিলো। দুধ চাইলে চোঙাটা দিয়ে দিলো। কিন্তু রাজার বদ্যি খুব জ্ঞানী মানুষ। দুধ দেখেই বলে দিলেন ওটা বাঘের দুধ নয়। আর যাই কোথায়! ঢবিকে বন্দি করা হলো।
ঢবির খবর শুনে ভুদুনি কেদে কেদে আকাশ পাতাল এক করলো। পুরো রাজ্যময় তার কান্না শোনা যেতে লাগলো। তার সৎ মায়ের এহেন অবস্থা দেখে হবির মন কেঁদে উঠলো। হাজার হোক, মা তো।
সে গেলো তার চন্দন গাছ মায়ের কাছে। সব শুনে তার মা বললোÑ যা বলি মন দিয়ে শোন। বনের এই রাস্তা দিয়ে গেলে একদম মাথায় একটা পাহাড় আছে। ঐ পাহাড়ের গুহায় তোর বাঘ মাসী থাকে। গুহার মুখে গিয়ে মাসী বলে তিনবার ডাক দিবি। যদি জবাব পাস তবে আমার কথা বলবি। খবরদার, তোর মাসী ভেতরে না ডাকা পর্যন্ত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি। ডাকলে যাবি আর ওর বাচ্চা গুলো কে আদর করবি। তারপর দুধ চাইবি। দুধ পেলে সরাসরি আমার কাছে আসবি।
হবি তার মায়ের কথা অনুসারে গুহার মুখে গিয়ে বাঘমাসীর অনুমতি নিয়ে ভেতরে গেলো। বাঘের বাচ্চা গুলিকে আদর করে দিলো। এরপর বাঘমাসীকে সব খুলে বললো। মাসী শুনে বললোÑ তা বাছা, প্রথমবার তোর মাসীর কাছে কিছু চাইতে এসেছিস। কিভাবে না করি।
হবি খুশিমনে দুধ নিয়ে তার চন্দন গাছ মায়ের কাছে গেলো। তার মা বললোÑ হবি মা, আমার শিকড়ের ফাকে একটা গর্ত আছে। ওখানে দেখ তোর জন্য কিছু গয়না আছে। ওগুলো পড়ে রাজবাড়িতে যা। তোর যাত্রা শুভ হোক।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হবি রাজসভায় গেলো। রাজাকে বললো সে বাঘের দুধ নিয়ে এসেছে। রাজবদ্যি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলো। সবাই হবিকে বাহবা বাহবা দিতে লাগলো।
রাজা তাকে পুরস্কার দিতে যাবেন এমন সময় সে বললোÑ মহারাজ, আমার পুরস্কার চাই না। যদি কিছু দিতে চান তবে আমার বোন ঢবিকে ফিরিয়ে দিন।
রাজসভায় সবাই অবাক হলো। এটুকুন মেয়ে কত সাহসী, কত বিনয়ী, কত নির্লোভ আর কত মমতাময়ী। আর সোনার গয়না পরা অবস্থায় হবির রূপ যেন ঠিকরে পড়ছিলো।
রাজা আনন্দের সাথে ঢবিকে মুক্ত করে দিলেন এবং রাজসভায় সবার সামনে ঘোষণা দিলেন, রাজকুমার সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি হবির সাথে রাজকুমারের বিয়ে দিবেন।
যথাসময়ে রাজা হবির সাথে রাজকুমারের বিয়ে দিলেন এবং হবির জীবনে আর কোন কষ্ট থাকলো না।
তবে বনের মাথায় চন্দন গাছটিরও কোন চিহ্ন থাকলো না।