আমার একজন সমাজ সচেতন আত্মীয়া আশির দশকের প্রথম দিকে নিজ লোকালয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছিলেন। পরবর্তীতে সেই প্রতিষ্ঠানটি বড়ো পরিসরে এনজিওভুক্ত হয়। তাঁকে শুরুতে নির্যাতিত নারীদেরকে অনেক ধৈর্য ধরে বুঝাতে হয়েছে, যে সব নির্যাতন তাদের প্রতি করা হচ্ছে সেটি অপরাধ, দুঃখজনক সত্য ঐ লোকালয়ের নারীদের কাছে পারিবারিক নির্যাতন যাপিত জীবনের অংশ বিশেষ এবং বেশির ভাগ নারীই তাদের নিয়তি হিসাবে ধরে নিয়েছে। আমার আত্মীয়া সমমনা আরো কয়েকজন নারীকে সাথে নিয়ে এইসব সুবিধা বঞ্চিত নির্যাতিত নারীদেরকে সচেতন করলেন, পরবর্তীতে প্রতিকারের আশায় অনেক নির্যাতিত নারী তাঁর শরণাপন্ন হলো। এই রকম একটি সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন নারী দুইটি ছোট শিশু নিয়ে এসে আকুতি করতে লাগলো, মহিলাটির স্বামী মহিলাটিকে মেরে ফেলবে, মহিলাটিকে শিশু সন্তানসহ কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। তিনি বললেন সেটি সম্ভব নয়, নির্যাতক স্বামীকে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু মহিলা কেবলই থাকার স্থানের জন্য আকুতি করতে থাকলো। হঠাৎ মহিলাটি বলে উঠলো আমার আত্মীয়াকে, আপনার গরুর ঘরটি অনেক বড়ো, আমি তার একপাশে থাকতে পারবো বাচ্চাদেরকে নিয়ে, সত্যিকারভাবেই মহিলা বেশ কিছুদিন সেই গরুর ঘরটিতে ছিল। রাখালের সাথে সে গরুগুলির পরম যতœ নিতো এবং আমার আত্মীয়ার আস্থা অর্জন করায় পরবর্তীতে মহিলাটির অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। নারীটি বলেছিল পশুকে মায়া করলে পশু আঘাত করে না, কিন্তু মানুষ পশু হয়ে মানুষকে আঘাত করে।
ইউরোপের ইটালি শহরের একটি দর্শনীয় স্থান ‘কলজিয়াম’। এই স্থানটিকে নিয়ে হলিউডে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ‘গ্ল্যাডিয়েটর’। এখানে ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে শক্তিশালী বন্দী মানুষকে দেয়া হতো। সিংহ রক্তমাংসের মানুষটিকে লড়াইয়ে পরাজিত করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে মানুষটিকে খেত, এই দৃশ্য দেখে চারপাশে বসে থাকা সবাই কুৎসিত আনন্দ পেয়ে উল্লাস করতো। এখানে একটি গল্প প্রচলিত আছে, একবার উৎসুক দর্শনার্থীরা বসে আসে, সিংহকে যথারীতি ছেড়ে দেয়া হলো বন্দীর সাথে লড়াই করতে, সিংহটি স্বভাবসুলভ তেড়ে এসে লোকটিকে দেখে ‘বাও’ হয়ে কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে বসে গেলো। উপস্থিত দর্শক হতবাক। জানা গেলো এই সিংহটির পায়ে কাঁটা ফুটে অসুস্থ হয়ে গেলে লোকটি সিংহটির সেবা করে সুস্থ করে তুলেছিল। সিংহ ঠিকই উপকারী লোকটিকে চিনতে পেরেছিল।
জাপান ভ্রমণের ওপর লেখা কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি বইয়ে পড়েছিলাম, জাপানের একটি শহরে একজন অধ্যাপকের পোষা কুকুর ছিল। অধ্যাপক সাহেব ট্রেনে চড়ে কলেজে যাওয়ার সময় স্টেশনে এসে কুকুরটি বিদায় জানাতো, আবার কলেজ ছুটি শেষে ফিরে এলে কুকুরটি স্টেশন থেকে অধ্যাপকের সাথে বাড়ি ফিরে যেতো। একদিন কলেজে পাঠদানের সময় হার্ট এটাক হয়ে অধ্যাপক সাহেবের মৃত্যু হয়। কুকুরটি প্রতিদিনের অভ্যাসবশত অধ্যাপকের বাড়ি ফিরে আসার অপেক্ষায় স্টেশনে অপেক্ষা করে, এবং আমৃত্যু এই স্টেশনেই কুকুরটি অবস্থান করে। পরবর্তীতে এই ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কুকুরটির একটি মূর্তি তৈরি করা হয়েছে এই স্টেশনে।
গত মাসে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য ভারতের দিল্লিতে গিয়েছিলাম। ভারতের জাতীয় পত্রিকায় একটি খবর পড়ে খুবই ভালো লাগলো। মুসলিম মাদ্রাসায় অযুর সময় পানির অপচয় রোধ করে পানি সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছে মাদ্রাসার দুইজন ছাত্র। আধুনিক পদ্ধতিতে পানির ট্যাপের মধ্যে বিশেষ ‘সেন্সর’ বসিয়ে পানির অপচয় রোধ করা হয়, মাদ্রাসার ছাত্র দু’জন সেটি প্রথমে চিন্তা করে দেখেছে খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়, পরবর্তীতে তারা আরো গবেষণা করে পানির ট্যাপের কাঠামোতে ‘ট্যাকনিক্যাল’ সাপোর্ট দিয়ে পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং ব্যবস্থাটি ব্যয়বহুল নয়। ফলাফল প্রচুর পানি সাশ্রয় হচ্ছে। রাজ্য সরকার এই আবিষ্কারের জন্য দুজন মাদ্রাসা ছাত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল মাদ্রাসায় এই ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তির জন্য অনুরোধ করেছে। কারণ মাদ্রাসায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের অযুর জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। দেশে এসে মাদ্রাসা সম্পর্কিত দুঃখজনক ঘটনা শুনলাম। আমাদের হারাতে হলো ‘নুসরাত’কে। নুসরাত আমাদের একালের ‘জোয়ান অব আর্ক’। কয়েকশত বছর আগে ফ্রান্সের ‘জোয়ান অব আর্ক’ এই যুবতী নারীটিকে ‘ডাইনী’ আখ্যা দিয়ে বিচারের নামে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। চার্চ এই নারীটির বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগের পাশাপাশি পুরুষের পোশাক পরাতে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির প্রতি অবমাননার অভিযোগ আনলো। তখন ‘জোয়ান অব আর্ক’ আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিল, বন্দী অবস্থায় আমি যখন নারীর পোশাক পরিহিত ছিলাম তখন আমাকে পুরুষেরা যৌন হয়রানি করেছিল, যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে আমি পুরুষের পোশাক পরতে বাধ্য হয়েছি’।
নুসরাত ভুক্তভোগী অনেক নারীর মতো অধ্যক্ষের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনা চেপে যেতে পারত। সমাজ নারীকে এইভাবেই দেখতে অভ্যস্ত। নুসরাতের ভিতরের মনুষ্যত্ববোধ এই পরাজয় বরণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। মানুষ রূপী পশুর আক্রমণ মেনে নিতে নিজেকে অপবিত্র মনে হতে পারে। পবিত্র আত্মা শরীর নিয়ে নুসরাত এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বীরের বেশে চলে গেছে অবিনশ্বর পরপারে। যাবার বেলায় মানুষরূপী পশুগুলোকে চিহ্নিত করে গেছে। যুগে যুগে যেসব মানুষরূপী পশুগুলো আমাদের মাঝেই বিচরণ করছিল। লোকালয়ে একটি পশু দেখে মানুষ নিজেকে সাবধান করতে পারে কিন্তু মানুষরূপী পশুগুলোকে চিহ্নিত করা কঠিন।
আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম প্রাইমারি স্কুলে, বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য আমাদের শ্রেণিতে পাঁচজন মেয়ে এবং সাতজন ছেলে নির্বাচিত হয়েছিল। মূল স্কুল শুরুর এক ঘণ্টা আগে এবং স্কুল ছুটির পর আবার এক ঘণ্টা আমাদের কোচিং হতো। দীর্ঘ সময় আমাদেরকে স্কুলে থাকতে হতো, এই জন্য একজন পিতৃসম শিক্ষক আমাদের পাঁচজন ছাত্রীকে টয়লেটে নিয়ে যেতেন, তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে অবস্থান করতেন আমাদের নিরাপত্তার জন্য। আমরা তখন সবাই এগারো বারো বছরের শিশুই। কিন্তু আমাদের সহপাঠী একটি ছাত্রীর শারীরিক গঠন বয়সের তুলনায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ছিল। একজন যুবক অংক শিক্ষক ছাত্রীটিকে শারীরিকভাবে হয়রানি করত, আমরা বাকিরা সেটি বুঝতাম, কিন্তু প্রতিবাদের সাহস আমাদের কোনোভাবেই ছিল না, শিক্ষকটি ছিল দুর্ধর্ষ। তিনি পৃথিবীতে এখন বেঁচে আছে কিনা জানি না, আমি তাকে ঘৃণা করি।
কিন্তু নুসরাত অধ্যক্ষের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে শুধু ঘৃণা নয় প্রতিবাদ করেছিল। কৈশোর উত্তীর্ণ একটি মফস্বল শহরের মেয়ে, অনেক গভীর চিন্তাশীল ছিল বলেই তার মধ্যে প্রতিকার বোধ জন্মেছিল। এই অধ্যক্ষ পশু যেন পরবর্তীতে আর কোনো ছাত্রীর সাথে পশু সুলভ আচরণ করতে সাহস না পায়, সেই মেয়েদের রক্ষার্থে নুসরাত অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদ করেছিল। আমরা সবাই জানি স্থানীয় প্রশাসনের উচ্চাসীন ব্যক্তিবর্গ অধ্যক্ষের আনুগত্য প্রিয় হওয়ায় নুসরাতের পরিণতি ভয়াবহ হয়ে গেল।
সমাজের মূলস্রোত আজকের নারীকে আসতে হয়েছে পাহাড় সমান বাধা ডিঙ্গিয়ে। কিন্তু সমাজের মূল স্রোতে পুরুষের দীর্ঘ দিনের আধিপত্য নারীর এই অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে বদ্ধপরিকর। রাষ্ট্রযন্ত্র নারীর স্বপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে কিন্তু পুরুষের মনোজাগতিক বৈকল্য দূরীকরণে ব্যর্থ হচ্ছে। উন্নত অনুন্নত যুদ্ধ বিধ্বস্ত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ধর্মীয়তন্ত্র সর্বত্রই পুরুষের মনোজাগতিক এই জাতীয় বৈকল্যের শিকার হচ্ছে নারী। নারী, পুরুষ তথা মানুষ এই দানবীয়তা থেকে মুক্তি প্রত্যাশা করে।