প্রতিটি মুসলমানের আমৃত্যু স্বপ্ন ও নিয়ত থাকে জীবনে অন্তত একবার হজ পালনের। বাংলাদেশী হাজিদের মধ্যে দেখা যায় বেশির ভাগই সংসারের পাঠচুকে বৃদ্ধ বয়সে হজে যান। সামর্থবান না হওয়ায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হজে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।
হজে যেতে প্রয়োজন মানসিক, শারীরিক সামর্থ ও আর্থিক প্রস্তুতির। হজে গমনেচ্ছুকদের সুবিধার জন্য, জ্ঞাতব্যের জন্য, চেষ্টা করব হজের প্রস্তুতির প্রতিটি পর্ব সম্মন্ধে যাত্রীদের সম্যক বাস্তব ধারণা দিতে যা আপনার পবিত্র হজ সমাপনে অত্যন্ত সহায়ক হবে।
আরবী জেলকদ মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার তারিখ সাপেক্ষে হজের তারিখ নির্ধারিত হয়। হজ যাত্রীদের : স্বাস্থ্য পরীক্ষা । টিকা দেওয়া। স্বাস্থ্য সনদ সংগ্রহ করা । হজের জন্য প্রয়োজনীয় মাল পত্র/পোশাক সংগ্রহ করা। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ঢাকার আশকোনাস্থ হাজী ক্যাম্প থেকে হজের যাবতীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। হজ্জ যাত্রী মনোবল বৃদ্ধিতে যা বিরাট সহায়ক ভূমিকা রাখে।
যাত্রার পূর্বে করণীয়
আপনার প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করা। বিমানের টিকেট সংগ্রহ করা। হালাল রুজীর টাকার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রা/রিয়াল সংগ্রহ করা। মনে রাখবেন আপনার হালাল রুজীর টাকাই আপনার হজ্জ কবুলের পূর্ব শর্ত। ম্যানিনজাইটিসের টিকা দিয়ে সনদ সংগ্রহ করে নিজ তত্ত্ব্বাবধানে রাখা। হজের নিয়ম কানুন ও রীতি জানার জন্য বিভিন্ন বই পুস্তক পড়া ও আমল করা। ধর্মীয় বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়ে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা যা আপনার এবাদতে সহায়ক হবে। ছ) প্রয়োজনে অভিজ্ঞ হাজী সাহেবদের সাথে আলোচনা করে হজের বিভিন্ন করণীয় ও ঐদেশের আচার আচরণ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করা। আপনার ধর্মমত বা ধর্মীয় আচরণ অন্য কাউকে পালন করার জন্য বাধ্য না করা বা এ নিয়ে বাক্-বিত-া না করা।
হজে যাত্রালগ্নে আপনার প্রয়োজনীয় মালপত্র
পরিচয়পত্র, পাসর্পোট, টাকা ও ডকুমেন্ট রাখার জন্য গলায় ঝুলানো ছোট ব্যাগ সংগ্রহ করা।
পুরুষের জন্য এহরাম : কমপক্ষে ২ সেট এহরামের কাপড় সংগ্রহ করা।
নারীদের জন্য এহরাম : নারীদের জন্য আঁট সাট বিহীন সিলাই যুক্ত শরীরের নিষিদ্ধ অংশ দেখা যাবে না বা শরীরের ভাঁজ দৃশ্যমান হবে এমন স্বাভাবিক পোশাকই এহরাম হিসেবে গণ্য করা হবে। অবশ্যই ওড়না এবং বোরকা ব্যবহার করতে হবে।
নরম দুই ফিতাওয়ালা স্যান্ডেল নেবেন, এহরাম পরার কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনে বেল্ট সংগ্রহ করতে হবে। গামছা/ তোয়ালে, লুঙ্গী, গেঞ্জী, পায়জামা/পাঞ্জাবী, সার্ট, ছোট ছাতা নিতে হবে।
সাবান, পেস্ট, ব্রাশ, মেশওয়াক, নেইল কাটার, সুঁই-সুতা, থালা-বাটি, গ্ল্যাস ইত্যাদি সঙ্গে নিতে হবে অথবা সেখানে গিয়ে সংগ্রহ করতে হবে।
হজ্জ সংক্রান্ত বই, কোরআন শরীফ, ধর্মীয় পুস্তক, কাগজ কলম, প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র (ব্যবস্থাপত্রসহ) এবং অন্তত আপনার ব্যবহারের দুইটি চশমা নিতে হবে।
ফিরার পথে বিমান বন্দরে খরচের জন্য কিছু বাংলাদেশি টাকা সঙ্গে নিতে হবে। নারীদের জন্য বোরখা নিতে হবে।
মোবাইল সেট নিয়ে যাবেন। সৌদিতে গিয়ে সিম কিনে নিতে হবে। মালপত্র নেওয়ার জন্য ৫৬ সে.মি. ২৫ সে.মি ৪৫ মাপের ব্যগ এবং হাত ব্যাগ নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ করতে হবে। ব্যাগের উপরে নাম ঠিকানা, ফোন নাম্বার পাসর্পোট নাম্বার এবং বাংলাদেশ লিখতে হবে।
ঢাকার হজ্জ ক্যাম্পে করণীয়
ঢাকার হাজি ক্যাম্পে তারিখ মতে হাজির হয়ে যে কয়দিন অবস্থান করবেন সেই কয়দিন আপনি অবশ্যই আপনার স্বাস্থ্যের প্রতি এবং নিজস্ব মালামাল এর প্রতি মনোযোগ রাখবেন। অবশ্যই হাজী ক্যাম্পে শিখানো মতে হজের তালিমের প্রতি মনযোগী হবেন।
আপনার কোন ভেকসিন/টিকা দেওয়া বাকি থাকলে তা অবশ্যই এই সময়ের মধ্যে দিয়ে নিবেন এবং আপনার পরিমাণতো বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে নিতে ভুলবেন না।
ব্যাগেজ নিয়ম
বিমান উড্ডয়নকালে হাত ব্যাগে ছুরি, কাচি, কোনো দড়ি নেওয়া যাবে না। আপনার ব্যাগেজে কোনো মতেই ৪০ কেজির বেশি মালামাল বহন করা যাবে না। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ঔষধ বহন করবেন না। চাল, ডাল, শুঁটকি, গুড়, ইত্যাদিসহ পচনশীল কোনো খাদ্যদ্রব্য বহন করা যাবে না। রান্না করা খাবার, তরি-তরকারি, ফলমূল বহন করা যাবে না। কোনো অবস্থাতেই পান/সুপারি বহন করা যাবে না। এটা সৌদি আরবে জঘণ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়।
জরুরি কাগজপত্র যা সঙ্গে নিবেন
১০ কপি পাসপোর্ট আকারের ছবি, স্ট্যাম্প আকারের ৬ কপি ছবি, পাসপোর্টের ২/৩ পাতার ফটোকপি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ, টিকা কার্ড। নারী হজযাত্রীর ক্ষেত্রে শরিয়তসম্মত মাহরামের সঙ্গে সম্পর্কের সনদ, ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার রসিদ। সরকারি চাকরিজীবী হলে অফিস আদেশ বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে দেখাতে হয় বলে এগুলো সঙ্গে রাখতে হবে।
প্রত্যেক হজযাত্রীর ৭ সংখ্যার একটি পরিচিতি নম্বর থাকে। এর প্রথম ৪ সংখ্যা এজেন্সির নম্বর আর শেষ ৩ সংখ্যা হজযাত্রীর পরিচিতি নম্বর। ১০ সংখ্যার ট্র্যাকিং নম্বরটি প্রাক নিবন্ধনের সময় কম্পিউটারে দেওয়া নম্বর যেমন N11709F1E2C জানা থাকলে হজযাত্রী ও তাঁর আত্মীয়স্বজন ওয়েবসাইটে ওই হজযাত্রীর তথ্য পেতে পারেন সহজে।
সৌদি সরকার হজযাত্রীদের জন্য ই-ভিসা চালু করেছে। এই ভিসা পাসপোর্টের সঙ্গে লাগানো থাকে না। কাগজে প্রিন্ট করে দেবে। ফলে হজযাত্রীদের এটি আলাদা ভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। আগে পাসপোর্টের সঙ্গে ভিসা লাগানো থাকত বলে আলাদা করে ভিসা সংরক্ষণের প্রয়োজন হতো না।
এহরাম
আপনার গন্তব্য ঢাকা থেকে যদি মদিনায় হয়, তাহলে ইহরাম করা যাবে না; যখন মদিনা থেকে মক্কায় যাবেন, তখন ইহরাম করতে হবে। যদি মক্কায় যেতে হয়, তাহলে ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগে ইহরামের নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে নেওয়া উত্তম। কারণ, জেদ্দা পৌঁছানোর আগেই মিকাত বা ইহরাম বাঁধার নিদিষ্ট স্থান।
বিমানে যদিও ইহরামের নিয়ত করার কথা বলা হয, কিন্তু ওই সময় অনেকে ঘুমিয়ে থাকেন আর বিমানে পোশাক পরিবর্তন করাটা দৃষ্টিকটু। বিনা ইহরামে মিকাত পার হলে এ জন্য আপনাকে দম বা কাফফারা দিতে হবে। তদুপরি গুনাহগার হবেন। ইহরাম বাঁধার পর সাংসারিক কাজকর্ম নিষেধ। এহরাম অবস্থায় পুরুষেদের কোনো সেলাই করা পোশাক পরা বৈধ নয়। কথা ও কাজে কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না, নখ, চুল, দাড়ি-গোঁফ ও শরীরের একটি পশমও কাটা বা ছেঁড়া যাবে না। কোনো ধরনের সুগন্ধি লাগানো যাবে না, কোনো ধরনের শিকার করা যাবে না, তবে ক্ষতিকারক সব প্রাণী মারা যাবে।
মক্কায় পৌঁছানোর পর যা করতে হবে
মক্কায় পৌঁছানোর পর আপনার থাকার জায়গায় মালপত্র রেখে ক্লান্ত থাকলে বিশ্রাম করুন। আর যদি নামাজের ওয়াক্ত হয়, নামাজ আদায় করুন। বিশ্রাম শেষে দলবদ্ধভাবে ওমরাহ পালন করুন।
ওমরাহ
হিল (কাবা শরিফের সীমানার বাইরে মিকাতের ভেতরের স্থান) থেকে অথবা মিকাত থেকে ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া সাঈ করা এবং মাথার চুল ফেলে দেওয়া বা ছোট করাকে ওমরাহ বলে।
হজ তিন প্রকার তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ।
তামাত্তু : হজের মাসসমূহে (শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ) ওমরাহর নিয়তে ইহরাম করে, ওমরাহ পালন করে, পরে হজের নিয়ত করে হজ পালন করাকে হজে তামাত্তু বলে। কিরান : হজের মাসসমূহে একই সঙ্গে হজ ও ওমরাহ পালনের নিয়তে ইহরাম করেওমরাহ ও হজ করাকে হজে কিরান বলে। ইফরাদ : শুধু হজ পালনের উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে হজ সম্পাদনকে হজে ইফরাদ বলে।
বিশেষ পরামর্শ
দেশে থাকাকালীন আপনার প্যাকেজের সুবিধাদি যেমন মক্কা, মদিনায় থাকা, খাওয়া, স্থানান্তর করা ঐতিহাসিক স্থান পরিভ্রমণ করা, কোরবানিসহ অন্য সুবিধার কথা হজ এজেন্সির কাছ থেকে লিখিতসহ খুব ভালোভাবে বুঝে নিন। সৌদি আরব গিয়ে তা মিলিয়ে নিতে পারবেন।
সৌদি আরবে অবস্থানকালে
সৌদি আরবে অবস্থানকালে ট্রাফিক আইন মেনে চলুন। সিগন্যল পড়লে রাস্তা পার হতে হবে। রাস্তা পার হওয়ার সময় অবশ্যই ডানে-বাঁয়ে দেখেশুনে সাবধানে পার হতে হবে। কখনো দৌড়ে রাস্তা পারাপার হবেন না। মনে রাখবেন সৌদি আরবে গাড়ি চলে হাতের ডাক দিক থেকে অর্থাৎ যা আমাদের দেশের নিয়মের বিপরিত, তাই অতি সর্তকতা অবলম্বন করবেন।
কোনো ধরনের অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনায় পড়লে বাংলাদেশ হজ মিশনের মেডিক্যাল সদস্যের (চিকিৎসক) সঙ্গে যোগাযোগ করুন। হজযাত্রীদের তথ্য, হারানো হজযাত্রীদের খুঁজে পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ হজ মিশনে অবস্থিত আইটি হেল্প ডেস্ক সাহায্য করে।
মাহরাম : যেসব পুরুষের সঙ্গে মহিলাদের দেখা দেওয়া জায়েজ। যেমন স্বামী, বাবা, আপন ভাই, আপন চাচা-মামা, ছেলে ইত্যাদি।এছাড়া নারী হজযাত্রী এককভাবে হজে গমনের যোগ্য বিবেচিত হন না বলে মাহরমের সনদ পত্র সঙ্গে রাখুন।
প্রথমে মদিনা হয়ে মক্কায় আসা হজ্ব যাত্রীদের জন্য
মদিনা থেকে যদি মক্কায় আসেন, তাহলে ইহরামের কাপড় সঙ্গে নিতে হবে। প্রতি মধ্যে “যুল হুলায়ফা” নাকম স্থানে (মিকাত) এ এহরাম পরিধান করবেন। এবং নফল নামাজ আদায় করবেন। মসজিদে নববিতে নারীদের জন্য ভিন্ন প্রবেশপথ ও নামাজ পড়ার আলাদা জায়গা আছে।
হজের সময় লক্ষ করুন
হজের ৫ দিন মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা, মিনায় অবস্থান করবেন। তাই হাতবাগে এক সেট অতিরিক্ত ইহরামের কাপড় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাবেন। ছোট বোতলে করে পানি নিয়ে যেতে ভুলবেন না।
দিনের বেলা বাইরে বের হলে ছাতা সঙ্গে নেবেন। মুজদালিফায় রাতে থাকার জন্য প্লাস্টিকের পাটি রাখতে পারেন। মনে রাখবেন এটা আপনার জন্য বিদেশ-বিভুঁই তাই চলা ফেরা, কথা বার্তা, খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি সমস্ত কিছুতে আপনি সতর্কতার সঙ্গে করবেন। মহান আল্লাহ আপনার ওপর সহায় হোন।