রাজধানী ঢাকা এখন বহুমুখী সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে বারবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনটারই সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাগুলো এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তালিকা তৈরি করলে অনেক লম্বা হবে এবং কোনটির আগে কোনটি সমাধান করা হবে তা নিয়েই ভজঘট লেগে যাবে। এসব সমস্যা কার্যত এই শহরটাকে অকার্যকর করে ফেলছে। এই শহরে থাকা মানুষগুলো প্রতিদিন সমস্যা নিয়েই ঘর থেকে বের হচ্ছে আবার সমস্যার মাঝেই ঘরে ফিরছে। তাহলে একসময় কি ঢাকা স্থবির হয়ে যাবে? যানজট নিরসনে বহুবার বহু উদ্যোগ নেয়া হলেও কার্যত তা ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে ঢাকার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
যানজটের এই অবস্থার জন্য ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স ২০১৯ এ প্রকাশিত তথ্যে ঢাকা প্রথম অবস্থানে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে কলকাতা। গত বছর ও তার আগের বছর এই অবস্থান ছিল যথাক্রমে ২য় ও ৩য়। ২০১৫ সালে এই অবস্থান ছিল অষ্টম। আমরা খুব দ্রুতই নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করেছি। পরিস্থিতি যে খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা বোঝার জন্য কোনো অবস্থান জানার দরকার হয় না। প্রতিদিনকার অবস্থা দেখলেই স্পষ্ট হওয়া যায়। ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তি মালিকানাধীন গণপরিবহন, প্রাইভেট কার, মাইক্রো বাস, মটরসাইকেল এসব যানবাহন প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা যেন থমকে আছে। এই অবস্থার উন্নতি না হলে কি হবে তা সময়ই বলে দেবে।
যানজট নিরসনের জন্য ঢাকায় নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি ফ্লাইওভার। কিন্তু এসব ফ্লাইওভার তৈরি করেও সমস্যা সেই গোড়াতেই থেকে গেছে। শহরের ভেতরে গাড়ি চালানোর নিয়ম কানুনের কোন তোয়াক্কা করছে না চালকেরা। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ভেতর আনতে হবে। একটি ছোট পরিবারের জন্য একটি গাড়ি থাকতে হবে। সড়ক পরিবহণ খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। স্বল্প দূরত্বে সাইকেলের মতো যানবাহন জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। এতে একদিকে যেমন যানজটের মাত্রা কমানো যাবে অন্যদিকে দূষণের মতো বিষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। প্রতি মাসে যে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেসব গাড়ি রাখার মতো জায়গা ঢাকায় নেই। ইতিমধ্যেই এই শহরের ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে। বলাই বাহুল্য এর বেশিরভাগই ব্যক্তিগত।
ঢাকার মানুষের জন্য আরেকটি বড়ো ঝুঁকি হলো দূষিত বায়ু। ডব্লিউএইচওর মানদ- অনুযায়ী, বিশে^র যেসব দেশের শতভাগ মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে তার একটি বাংলাদেশ। আর বলাই বাহুল্য যে আমাদের দেশের অন্য শহরের তুলনায় রাজধানীর বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি। ঢাকার বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে যা নিশ^াসের সাথে দেহের অভ্যন্তরে পৌঁছে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়েই বিষাক্ত বাতাস টানতে হচ্ছে এ শহরের মানুষকে। একদিকে শহর থেকে গাছের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়া অন্যদিকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া যানবাহনের ধোয়া, আশেপাশের ইটভাটার ধোঁয়া এসব মারাত্মকভাবে বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থের জন্ম দিচ্ছে।
বায়ু দূষণের সাথে নোংরা এবং পানের অযোগ্য পানির কথা না বললেই নয়। ওয়াসার সাপ্লাই দেয়া পানি নিয়ে একজন সাধারণ নাগরিকের অভিনব প্রতিবাদের কথা গণমাধ্যমের কল্যাণে আজ সবারই জানা। এই ঘটনা কেবল একজন নাগরিকের ক্ষেত্রে নয় বরং এরকম নোংরা দুর্গন্ধ পানির অভিযোগ বহু। প্রায় প্রতিটি সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকাতে। ফলে বাধ্য হয়েই সারাদেশের মানুষকে ছুটতে হয় এই শহরে। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রিকরণের কোনো বিকল্প নেই। দেশের অন্য বিভাগীয় শহরে যদি বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নেয়া যায় তাহলে চাপ বিকেন্দ্রীভূত হবে। রাজধানীর জন্য আরও কার্যকরী পরিকল্পনা নিতে হবে। সেক্ষেত্রে রাজধানীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলার জন্য সঠিক গৃহীত পদক্ষেপসমূহের বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। না হলে একসময় ঢাকা তার কার্যকারিতা হারিয়ে একটি অকার্যকর এবং স্থবির শহরে পরিণত হবে সন্দেহ নেই।
অলোক আচার্য : সাংবাদিক-কলামিস্ট।