সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনাকে উজ্জীবিত ও উদীপ্ত করতে যে দুয়েকটি জায়গায় বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানু’র ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, এটির মধ্যে বোচাগঞ্জ উপজেলার হাটরামপুর আদিবাসী পাড়া অন্যতম। নিজস্ব অর্থায়নে স্বাধীনতার শহীদদের আবক্ষমূর্তি খেলার মাঠের সম্মুখে উন্মুক্ত করা হয়েছে। যোদ্ধাবেশে সিধু-কানু’র হাতে রয়েছে আদিবাসীদের আদিমতম অস্ত্র তীর-ধনুক। মূলতঃ এটিই আদিবাসীদের আত্মরক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র। বৃটিশ সরকারের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের সম্মুখে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তীরন্দাজ বাহিনীই। আদিবাসীরা শত্রুদের ঘায়েল করতে তীরের ফলায় বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করে থাকে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত অসম যুদ্ধে সেটি ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছিল। ইতিপূর্বে ২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার ঐতিহাসিক কান্তনগর মন্দির প্রবেশ সড়ক দ্বীপে নির্মিত স্মারক ভাস্কর্যের উদ্বোধন কার হয়েছিল। ঐতিহাসিক স্মারক ভাস্কর্যে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানুসহ তেভাগা আন্দোলনের নেতা কৃষক নেত্রী কমরেড ইলা মিত্র, গুরুদাস তালুকদার, হাজী মোহাম্মদ দানেশ ও খোকা বাইশের প্রতিকৃতি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। সেদিন বক্তারা বলেছিলেন, ‘১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ না হলে আমাদের স্বাধীনতা আসত না। সাঁওতাল বিদ্রোহই পাকিস্তানীদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, আমাদের তীর-ধনুকের কাছে তোমাদের কামানের গুলি তুচ্ছ।’ একই জেলা ও উপজেলার মহেশপুর গ্রামে সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘সিধু-কানু’ ২রা মে, ২০২৩ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল। এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে মহেশপুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে বক্তারা বলেছিলেন, ‘এই অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যত আন্দোলন হয়েছে, আমাদের সেই আন্দোলনের প্রকৃত বিজয় অর্জন হয়েছে ১৯৭১ সালে মহান বিজয়ের মধ্য দিয়ে।’’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চিহ্নিত দুস্কৃতিকারীরা প্রকাশ্যে দিনের আলোয় সিধু-কানু’র ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানু’র যে কয়েকটি ভাস্কর্য বিদ্যামান, তার মধ্যে সুন্দরপুর ইউনিয়ন, কাহারোল, দিনাজপুরের ১০ মাইলের তেভাগা চত্বরের ভাস্কর্যটিই ছিল তাৎপর্যপুর্ণ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। এই ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আদিবাসীরা উদীপ্ত ও প্রদীপ্ত হয়েছেন, সাহসিত হয়েছেন ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অগ্রগামী হতে। উপমহাদেশের অন্যতম স্বাধীনতাকামী আদিবাসী সিধু-কানু, চাদ-ভাইরো, ফুলো-জানোদের নেতৃত্বে ১৮৫৫ খ্রি. ন্যায্য দাবিতে সরব হয়ে উঠেছিলেন অরণ্যচারীরা। আদিবাসী সাঁওতালরা নিরক্ষর হলেও চেতনাগতভাবে ছিলেন বিদ্যান ও দূরদর্শী। আজ থেকে ১৭০ পূর্বে একান্ত শান্তিপূর্ণভাবে ব্রিটিশ শাসকদের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন—মহাজন, জোতদার, জমিদারদের নির্মমতা থেকে বাঁচার আকুতি। পদযাত্রা করেছিলেন কলকাতার উদ্দেশ্যে, ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে সহজ-সরল ভাষায় নিজেদের দুর্দশার কথাগুলো শোনাতে। মনে করা হয়, এটিই উপমহাদেশের প্রথম পদযাত্রা, লংমার্চ; শান্তিপূর্ণভাবে যাত্রা শুরু হলেও পথিমধ্যে শৃঙ্খলাচ্যুত হয়েছিলেন সাঁওতালরা। অবশ্য এটির জন্য তাদেরকে চরমমূল্য দিতে হয়েছে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের মহানায়ক সিধু-কানু’র ভাস্কর্য ভাঙার প্রেক্ষিতে আদিবাসীরা ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট দিনাজপুরের রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করেছে। যারা উপমহাদেশের মানুষকে শতবর্ষ ধরে নিগৃহীত, নির্যাতন, বৈষম্য ও জবরদস্তির মাধ্যমে রাজত্ব করেছেন; সেই ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন সিধু ও কানু’রা। আদিবাসীরা এই অমিত সাহসের নেতা-নেত্রীদেরকে দেবতাস্বরূপ মান্য করেন। গ্রামের সাধারণ গ্রামবাসী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাও সেদিনের প্রতিবাদ সভাতে সামিল হয়েছিলেন। আমরা দেখেছি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সভাতে নিজেদের অবস্থানকে পরিষ্কার করেছেন। প্রতিবাদ সভায় বক্তারা আদিবাসী মহান নেতাদের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনাকে সাম্প্রদায়িকতা হিসেবেই উল্লেখ করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন এবং পুনঃনির্মাণের স্মারকলিপি জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পৌঁছিয়েছেন।
দিনাজপুরের সিধু-কানু ভাস্কর্যটি অধিকার আদায়ের একটি স্মারক চিহ্ন হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল।
সাঁওতালসহ আদিবাসীরা বীরত্বের প্রমাণ দিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধেও, ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী সেনাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে তীর-ধনুক নিয়েই ঘেরাও করেছিলেন দুঃসাহসীরা। অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ঝনঝনানিকে উপেক্ষা করে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দেশের প্রতি মমত্ববোধ, ভালোবাসা এবং শত্রুমুক্ত করতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন আদিম অধিবাসীরা। দেশপ্রেমের কষ্টিপাথরে আদিবাসীদের দ্বিতীয়বার পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নেই। ৫ আগস্ট, ২০২৪ সালে সিধু-কানু’র ভাস্কর্য এবং হাতে লক্ষ্যস্থির তীর-ধনুকও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়া ভাস্কর্যই দাবি আদায়ের শক্তি ও চেতনাকে শাণিত করে। বিশ্বাস করি, সরকার দ্রুত পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
৫ আগস্টের পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা শহর থেকে শুরু করে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ জায়গার দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেয়েছে আদিবাসীদের তীর-ধনুক সম্বলিত প্রতিকৃতি। অর্থাৎ এই চিত্রগুলোই আমাদের স্মৃতিকে, চেতনা ও সংগ্রামকে উজ্জীবিত করে। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় সহস্রাধিক আদিবাসী শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে। অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি এরূপ আচরণে আমরা মর্মাহত, বিহব্বল ও সংক্ষুব্ধ হয়েছি। বিশ্বাস করেছি, একদল দুর্বৃত্ত আন্দোলনের ভাবমূর্তিকে ভুলুণ্ঠিত করতেই সিধু-কানু’র মতো ভাস্কর্যকে ধুলিস্যাৎ করেছে। সিধু-কানু শুধু বাংলাদেশের নয় উপমহাদেশের অগ্রনায়ক হিসেবে স্বীকৃত, সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনা, সাহস, দেশপ্রেম ও ঐক্যেবদ্ধ হওয়ার যে মন্ত্রণা দিয়ে গেছে; সেটির পথ ধরেই ’৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধ হেঁটেছিল।
নির্মিত ভাস্কর্যে যোদ্ধাবেশে সিধু-কানু’র হাতে ছিল আদিবাসীদের আদিমতম সমরাস্ত্র তীর-ধনুক। আদিবাসীরা সর্বদাই আত্মরক্ষার্থে তীর-ধনুক ব্যবহার করে থাকে। বাৎসরিক ‘শিকার উৎসবে’ পশুপাখিদের শিকার করতে কিংবা স্বাভাবিক সময়ে পুষ্টির জোগাতে তীর-ধনুকের সাহায্যে পাখি, ইঁদুর, বন্য শূকর, খরগোশ, খাটাস প্রভৃতি শিকার করে থাকে। তবে কখনোই প্রকৃতির ভারসাম্যকে নষ্ট করে নয়, জনসাধারণের উপকারার্থেই আদিবাসীদের ডাক পড়ে থাকে। মূলতঃ তীর-ধনুক হচ্ছে আদিবাসীদের জীবন সংগ্রামের সাথী, পথচলার সাহসী সহচর্য। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বৃটিশ সরকারের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের সম্মুখে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তীরন্দাজ বাহিনীই। আদিবাসীরা হিংস্র জানোয়ার কিংবা শত্রুদের ঘায়েল করতে তীরের ফলায় বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করে থাকে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত অসম যুদ্ধে সেটি ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছিল। কেননা আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে এই বোধটুকু ছিল যে, অনৈতিক উপায়ে হত্যা মানব সভ্যতাকে কুলষিত করে।
বিগত বছর এবং এ বছরও কয়েকবার দিনাজপুর গমন করেছি, দেখেছি সিধু-কানু’র ভাস্কর্যের স্মৃতিচিহ্ন। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আদিবাসীরা দেশপ্রেমে আপ্লুত হয়েছেন, সেটি এখন কেবলই ধ্বংসস্তূপ। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় সিধু-কানু’র ভাস্কর্যটি পুনঃনির্মাণের দাবি জানাচ্ছি। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার আদিবাসী মহান নেতা সিধু-কানু’র প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে ভাস্কর্যটি পূর্বের ন্যায় স্থাপনে ভূমিকা গ্রহণ করলে আদিবাসীরা শ্রদ্ধাবনত হয়ে কুর্ণিশ জানাবে।
