ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০১৬ সালে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার শরণার্থী সংকট নিয়ে একটা রিপোর্ট করেছিল সেখানে শরণার্থী ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া এক সন্তান সাক্ষাৎকারে বলেছিল, ‘‘আমার জন্মই হয়েছে এখানে, আমি এই ক্যাম্পটাকেই চিনি আমরা অনেকটা খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ”। আমরা কেউ চাইবো না যে আজ থেকে ১০-২০ বছর পর বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া কোনো শিশু এভাবেই বলে উঠুক। কিন্তু সেটা যে হবে না তার নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে?
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বর্তমানে যার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। রোহিঙ্গারা যে মর্মান্তিক এবং হৃদয় বিদারক ঘটনার মধ্য দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসেছিল সেটা দেখে যে কারো হৃদয়ই কেঁপে উঠেছিল। বাংলাদেশ সরকার বেশ শক্ত অবস্থান নিয়ে বিশ্বের দরবারে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
কিন্তু বছর দুয়েক পেরোতেই দেখা গেল ভিন্ন এক ঘটনা। গত ২৫ অগাস্ট প্রায় ৫-৬ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটিয়ে রোহিঙ্গারা তাদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিয়েছে। বোঝাতে চেয়েছে যে খুব সহজেই তারা এখান থেকে ফেরত যাবে না। সাথে কতগুলো দাবিও করেছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার মাধ্যমে মিয়ানমারে বসবাস করার সুযোগ দেয়া। তাছাড়া ২৫ অগাস্টকে রোহিঙ্গারা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে সবাইকে।
এই সমাবেশের পর অনেকেই নড়েচড়ে বসেছেন। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? অনেকেই বলছেন- প্রশাসনই বা কীভাবে এই সুযোগ তৈরি করে দিল! হয়ত অনেকেই ভেবেছিল ছোটখাটো কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা তাদের আয়োজন সীমাবদ্ধ রাখবে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আর সেটা থাকলো না। এক ভিন্ন রকম আয়োজন দেখতে পেল বাংলাদেশ। সম্ভবত যেটা কেউ কল্পনাতেও ভাবেনি সেরকম কিছু। মিটিংয়ে সাদা রঙের জামাকাপড়ের যেমন আধিক্য ছিল তেমনি আবার ডিজিটাল ব্যানার আর ইংরেজিতে লেখা অনেক দাবি-দাওয়ার কথা লেখা ছিল। বুঝতে বাকি থাকে না যে বেশ সংগঠিতভাবেই তারা আয়োজনটা করেছিল।
কিন্তু তাতে আমাদের সমস্যা কী? আমরা তো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তাদেরকে জায়গা দিয়েছি। তারা তো এখন আমাদেরই অংশ। কী ভাবছেন, পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে? তাহলে আসুন দেখি তারা কীভাবে আমাদের অংশ। প্রথম কথা হচ্ছে, তারা এখন আমাদের দেশে বসবাস করছে, আমাদের দেশের আলো, বাতাস, পাহাড় খাচ্ছে, আমাদের দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে, ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় এই রকম ফোন ব্যবহার করছে, তারা নাকি আবার হোয়াটসআপের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করছে, দিনের বেলা নাকি বাংলাদেশের লোকজন তাদের এলাকায় খোঁজ খবর নিতে পারে। কিন্তু রাতের বেলা ঢুকতেই পারে না গুম, খুন হওয়ার ভয়ে, যে কারণেই হোক নিজেরা যেমন নিজেদেরকে মারছে আবার বাংলাদেশিদেরকেও মারছে।
বাংলাদেশের লোকজন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় রীতিমতো সংখ্যালঘুদের মতো জীবনযাপন করছে। রোহিঙ্গারা ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজেদের একটা আয় উপার্জনের পথ খুঁজে নিচ্ছে আর যখনই কিছু টাকা হাতে চলে আসবে তখন তাদের চাহিদাও পরিবর্তিত হবে। তারা পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে, অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে অবৈধভাবে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিংবা সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে গিয়ে জাতিসংঘের লোকজনের সাথে মিটিং করছে, সারা বিশ্বে নেটওয়ার্ক তৈরি করছে, সর্বোপরি বড়ো ধরনের গণজমায়েতের মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন করছে। এত কিছু যদি করতে পারে তাহলে তারা কীভাবে এখন আর আমাদের অংশ না? কারণ যা কিছু করছে সেটা তো আমাদের দেশের মধ্যে থেকেই করছে।
আবার তারা মিয়ানমারেরও অংশ। সেখানেই তাদের জন্মভ‚মি, আদিবাস। নাগরিক হওয়ার জন্য যত আন্দোলন সেটা সেখানেই করতে হবে। সেখানেই তাদের নির্যাতন বন্ধ করতে বলতে হবে। সেখানেই ফেরত যেতে হবে। আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু চাইলেই কি আর ফেরত নেয়া বা যাওয়া যায়? আসুন দেখি কেন যাবে না।
প্রথমত, রোহিঙ্গারা এখনো সেখানে ফেরত যেতে নিরাপদ বোধ করছে না। পৃথিবীতে কেউ নিজের জীবনকে হারাতে চায় না। তাই যতই পর্যাপ্ত নিরাপত্তার কথা বলা হোক কিনা তারা সেটা শুনবে না। যে ট্রমার মধ্য দিয়ে তারা যাচ্ছে সেখান থেকে বের হয়ে আসা এত সহজ না। আর সেক্ষেত্রে দুই বছর তো কিছুই না। অন্যদিকে মিয়ানমারই চাইবে না তারা ফেরত যাক সেটা তাদের রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক কারণেই হোক।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেভাবে সাহায্য দিচ্ছে ঠিক সেভাবে যে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জোরালোভাবে কথা বলছে তা কিন্তু না। তাই মিটিং করে আন্তর্জাতিকভাবে মনোযোগ কেড়ে নিবে সেটা কিন্তু কেউ আর সহজে বিশ্বাস করতে চাইবে না। আর বিশ্বের মোড়ল দেশগুলো যেমন কাশ্মীর ইস্যুকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখতে চাচ্ছে সেটা যে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে হবে না সেটার নিশ্চয়তা কে দিবে? কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখন জাতীয় রাজনীতিতে আবির্ভ‚ত হচ্ছে। আর এসব কারণেই আঞ্চলিক বিষয়গুলো অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বকে আরো জটিল করে তুলবে।
কোনো এক মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন যে রোহিঙ্গাদের সুখের দিন আর বেশি থাকবে না, তাহলে সুখ (!) চলে গেলে দুঃখের দিনে যে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে না তার নিশ্চয়তা কে দিবে? বিশ্বের অনেক দেশ এখন শরণার্থী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তার মধ্যে বড়ো সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে আফ্রিকার দেশ কেনিয়াকে। ঘটনা যাই হোক না কেন, কেনিয়ার শরণার্থী সমস্যা যাতে আমাদের দেশে না হয় সেটাই আশা করব।
রোহিঙ্গা ডাকাত কন্যার কান ফুরানোর অনুষ্ঠানে স্বর্ণালংকার আর লাখ টাকার ছড়াছড়ি একটা বড়ো উদাহরণ হতে পারে যে কীভাবে টাকার খেলা চলছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। টাকা যখন হাতে আসে ক্ষমতা তখন খুব দূরে থাকে না। কারণ দুইটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্তমান যুগের বাস্তবতা।
এবার আসি মায়ানমারের প্রত্যাবর্তন পরিকল্পনায়। ইউএনএইচসিআর এর তথ্য মতে, অনেক যাচাই বাছাইয়ের পর মাত্র ৩৪৫০ জনকে মায়ানমার ফেরত নিতে চেয়েছে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। কিন্তু কেউ যেতে চাইলো না। তাছাড়া ধরে নিই, যাচাই বাছাই প্রক্রিয়াতেই যদি লাখ লাখ লোক বাদ পরে তাহলে তারা কোথায় যাবে? সহজ ভাষায় তারা আমাদের এই দেশেই থাকবে। তাই যতই বলি না কেন কিছু এনজিও চাচ্ছে না বা উস্কানি দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থানের ব্যাপারে তাতে কিন্তু পরিস্থিতির জটিলতা এড়ানো যাচ্ছে না।
যদিও সরকার চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে কিন্তু এই ধরনের সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? আর আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দাদের তৎপরতা যে নেই তাই কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? তাই দিন যত যাচ্ছে ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা ঠিক ততই কমবে।
তাহলে যদি তারা না-ই যায় বা যেতে পারে তাহলে কী হবে আমাদের দেশের? ভালো খারাপ নিয়ে অন্য লেখায় বলা যেতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতে যে ধরনের ঝুঁকির মধ্যে দেশকে পড়তে হতে পারে সেটা নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। যেমন আগেই বলেছি, বিবিসি বাংলার রিপোর্ট অনুযায়ী রাতের বেলা সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ১০ লাখ মানুষ যেখানে একসাথে গাদাগাদি করে বসবাস করছে সেখানে আসলে কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে? শুধু কি বিদ্যুৎ আর সিসি ক্যামেরাতে কাজ হবে?
এই মানুষগুলো তাদের আপনজন হারিয়েছে, মনে অনেক কষ্ট নিয়ে জীবনযাপন করছে, তাদের যে একই রকম ধৈর্র্য থাকবে এটার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? অনেক তরুণ ছেলেমেয়ে আছে তারা যে সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ নিয়ে বিপথে পা বাড়াবেনা সেটা কে বলতে পারবে? যতদিন ত্রাণ আছে ততদিন না হয় খেয়ে পরে বাঁচলো, কিন্তু যখন সেটা থাকবে না তখন জীবন চালাবে কি করে? কি পথে আয় উপার্জন করবে? ভবিষৎই বলবে কি হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলতে শুরু করেছেন যে, বাংলাদেশ একটি ভ‚রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পরে যেতে পারে।
যাই হোক, এই চরম অমানবিক কাজের জন্য তারা তাদের অধিকার অনুযায়ী মত প্রকাশ করবে এবং সেটা করছে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেভাবে করছে সেটা নিয়েই যত প্রশ্ন। এখন কথা হচ্ছে মায়ানমারে রোহিঙ্গারা কেন তাদের অধিকার নিয়ে এক হতে পারেনি বা আগে কেন সেখানে এত লোকজন এক হয়ে তাদের দাবি জানায়নি। বাংলাদেশ কি তাদের দাবি জানানোর জায়গা? উত্তরে এক বেসরকারি টেলিভশন এর সাথে আলোচনায় এক রোহিঙ্গা নেতা বলেছেন যে, আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই তারা সেটা করেছে। তাই বলে এত মানুষের এই রকম নিরাপত্তাহীন একটা সমাবেশ? কিন্তু বাংলাদেশ তো এই সমস্যার কোন সমাধান করে দিবে না।
তাহলে কে করবে এই সমস্যার সমাধান? যেহেতু রোহিঙ্গারা এখন একসাথে লক্ষ লক্ষ লোকজন নিয়ে মিটিং করতে পারে, তার মানে হচ্ছে, তারা একত্রিতও হচ্ছে এবং নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্তটাও নিচ্ছে। মূলত রোহিঙ্গারাই এখন অন্যদের সাথে এগিয়ে আসতে পারে সমস্যা সমাধানে। দুই নৌকায় পা না রেখে নিজের নৌকায় পা দেওয়াই ভালোÑনা খারাপ, সে ব্যাপারে এখন তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দেবাশিস সরকার : গবেষক ও কলামিস্ট।