‘স্যার, আমরা আবিষ্কার করেছি পৃথিবীর চূড়া’। অতিরিক্ত সার্ভেয়ার জেনারেলে ঘরে গিয়ে চেঁচিয়ে ঘোষণা করেছিলেন এক বঙ্গসন্তান। ১৮০ বছর আগে সেই প্রথম পৃথিবীর উচ্চতম স্থানের খোঁজ মিলেছিল। এভারেস্টে প্রথম অভিযান অবশ্য আরও ৪৩ বছর পরে শুরু হয়। আর বিশ্বের সবোর্চ্চ শৃঙ্গ জয়ের জন্য আরও ৫০ বছরের অপেক্ষা করেছিল মানব সভ্যতা।
রাধানাথ শিকদার, হাতিবাগানের শিকদার বাড়ির বড় ছেলে যখন পৃথিবীর চুড়ো আবিষ্কার করেন, সেটা ১৮৪৬ সাল। শৃঙ্গের নামটাও তাঁরই দেওয়া। কেন এই নাম? রাধানাথ বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম, আমি কী করেছি। এমন একটা কৃতিত্ব এসেছে। ইংরেজরা শুনলেই হয়ত রানীর নামে নামকরণ করে দিত। সেটা চাইনি বলেই জর্জ এভারেস্টের নাম প্রস্তাব করি। উনি সাহায্য না করলে আমি কাজ করতে পারতাম না। ভাগ্য ভালো আমার প্রস্তাব মানা হয়।’
১৯০৩ সালের আগে এভারেস্টে অভিযানের প্রশ্নই ছিল না। কারণ তখন এই অভিযানের জন্য কোনো অনুমতিই ছিল না। ইতিহাস গড়তে ১৯০৩-এ প্রথম রওনা দেয় ৬ অভিযাত্রীর দল। বারবার অভিযানের সংখ্যা বাড়লেও এভারেস্ট কিন্তু ধরা দেয়নি দীর্ঘদিন। ১৯২৪ তেই তৈরি হতে পারত ইতিহাস। হয়নি। সম্ভবত শৃঙ্গ ছুঁয়ে ফেরার পথে মৃত্যু হয় জর্জ ম্যালোরির। যা অভিযানের ইতিহাসে টেল অব মিরফরচুন বলেই পরিচিত।
১৯৫৩ সালে এভারেস্টের শৃঙ্গে প্রথম মানুষের পা পড়ল। ইতিহাস গড়লেন এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে । ২৯ মে তাদের সামিট শেষ করেছিল এই জুটি। তারপর থেকেই এই দিনটিকে এভারেস্ট দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
প্রথম জয় আসতে সময় লেগেছিল ৮৩ বছর। দ্বিতীয়বার সাফল্য এল ৮ বছর পর। ১৯৯০ এর পর অবশ্য এভারেস্টে অভিযান ও সাফল্য দুইই অনেক বেড়ে যায়। তবে অভিযানের রোমাঞ্চ, মৃত্যুর হাতছানি এখনও এতটুকুও কমেনি।
পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০ বছরে অভিযানের ইতিহাসে ৫০ জন অভিযাত্রীর দেহের খোঁজ মেলেনি। প্রায় আড়াই হাজার উদ্ধার অভিযান চলেছে। এটাই এভারেস্ট। এখানে কিছুই স্থায়ী নয়। সব চেনা হয়েও অচেনার ঘেরাটোপে এভারেস্টের কোলেই চিরঘুমে ঢলে পড়েছেন বহু পাহাড়প্রেমী। ১৮০ বছর ধরে বারেবারে তার প্রমাণ মিলছে।
এভারেস্ট জয় বাংলাদেশিদের কাছে এখন আর স্বপ্ন নয়। পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীম, মোহাম্মদ আবদুল মুহিত, নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরীনরা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন এ স্বপ্নকে। মুসা ইব্রাহীমের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কোনো বাংলাদেশির পদচিহ্ন পড়ে পৃথিবীর উচ্চতম শুভ্র বরফচূড়ায়, হিমালয় শৃঙ্গে ওড়ানো হয় লাল সবুজের পতাকা। এরপর ২০১১ ও ২০১২ সালে এভারেস্ট পর্বত জয় করেন মুহিত, নিশাত ও ওয়াসফিয়ারা। তবে ২০১৩ সালে আরেক বাংলাদেশি মোহাম্মদ খালেদ হোসেন এভারেস্ট জয় করলেও পর্বত থেকে নামার সময় মৃত্যু হয়। পৃথিবীর উচ্চতম এই পর্বত জয়ের দুঃসাহসিক অভিযানে সফল হয়ে পুরো বিশ্বের কাছে দেশের নাম আরও উজ্জ্বল করেন বাংলাদেশের এই তরুণ-তরুণীরা। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম। লালমনিরহাটের ছেলে মুসা ইব্রাহীম ২০১০ সালের ২৩ মে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন। সাগরতল থেকে ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উচ্চতায় হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূূড়ায় প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান মুসা। মোহাম্মদ আবদুল মুহিত দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে ২০১১ সালের ২১ মে এভারেস্ট জয় করেন। ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুরে তার জন্ম। বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের সদস্য হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুহিত। এভারেস্ট জয়ের আগে ২০০৯ সালে মুহিত বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ চো ওয়ো (৮ হাজার ২০১ মিটার) জয় করেন। বাংলাদেশি পর্বতারোহীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এ সাফল্য অর্জন করেন। মুহিত দ্বিতীয়বার ২০১২ সালে নিশাত মজুমদারের সঙ্গে আবারও এভারেস্ট জয় করেন। বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ মে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন নিশাত মজুমদার। লক্ষ্মীপুরে ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি তার জন্ম। এর আগে তিনি এভারেস্ট বেস ক্যাম্প, হিমালয়ের মেরা ও সিঙ্গাচুলি পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করেন। পৃথিবীর পঞ্চম পর্বতশৃঙ্গ মাকালুতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ অভিযানেও অংশ নেন তিনি। এ ছাড়া হিমালয়ের চেকিগো নামের একটি শৃঙ্গেও সফল অভিযান করেন। দেশের দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ২৬ মে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। এ ছাড়া দেশের প্রথম পর্বতারোহী হিসেবে সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন তিনি। তার জন্ম ১৯৮২ সালের ২৭ অক্টোবর। ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী এই নারীর শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামে। বাংলাদেশ অন সেভেন সামিট কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০১১ সালের ওয়াসফিয়া তার সেভেন সামিট অভিযান শুরু করেন। আর ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া অঞ্চল দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার (ওশেনিয়া) সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কারস্তনেজ পিরামিড জয়ের মধ্য দিয়ে সাতটি পর্বত জয় সম্পন্ন করেন। ওয়াসফিয়া ন্যাশনাল জিওগ্রাফির বর্ষসেরা অভিযাত্রীর খেতাব পেয়েছেন। দুঃসাহসী অভিযানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে নিজের অঙ্গীকার ও কর্মতৎপরতার জন্য তাকে ২০১৪ সালের অন্যতম বর্ষসেরা হিসেবে মনোনীত করা হয়। বাংলাদেশের হিমালয় পর্বত বিজয়ীদের মধ্যে মোহাম্মদ খালেদ হোসেন এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথে ২০১৩ সালের ২০ মে ৮ হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতায় অজানা কারণে দুঃখজনকভাবে মৃত্যু বরণ করেন।
ফিচার ডেস্ক / সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তন