উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হলে কৃষকের স্বার্থ ক্ষুণœ হবে, এটাই স্বাভাবিক। শুরু হচ্ছে ধান কাটার ভরা মৌসুম। ধান উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষককে ফসলের জমি পরিচর্যা, সার প্রয়োগ, কীটপতঙ্গ দমন, ডিজেল কিংবা বিদ্যুতে খরচ করতে হয়। ধান বিক্রি করেই কৃষককে সে খরচ যোগান দিতে হবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এখন ধানের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতিমণে মাত্র সাড়ে ৫ শত টাকা। ফলে ধান চাষীদের এনজিও ঋণ, মহাজনি ঋণ, ব্যাংক ঋণের দুষ্টু চক্রে আটকে পড়তে হচ্ছে। ভাগ্যগুণে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে ধান কেটে হয়তধার দেনা কিংবা ঋণ পরিশোধ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে।
চাষীদের ধানের মূল্য নিশ্চিত করতে এবং আপদকালীন খাদ্য মজুদ গড়ে তুলতে সরকার ধান ও চাল অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করে থাকে। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় এ বছর আমন মৌসুমে কৃষকদের নিকট থেকে ৬ লাখ টন ধান ও ৪ লাখ টন চাল চালকল মালিকদের নিকট থেকে সংগ্রহ করবে। তবে স্থান সংকুলানের অভাবে বেশির ভাগ সময়ে সরকার কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করতে পারে না। যদিও কোনো কোনো মৌসুমে সরকার ধান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করে, সেখানেও বিপত্তি ঘটে। ‘আগে আসলে আগে বিক্রি’ এই নিয়মে ধান কেনাও সম্ভব হয় না। ফলে কৃষি বিভাগ প্রকৃত কৃষকের তালিকা প্রস্তুত করে খাদ্য বিভাগে জমা দিতেই দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। আবার একজন কৃষকের ভাগ্যে ১০/১৫ বস্তা ধান বিক্রির সুযোগ আসে কিন্তু স্বল্প পরিমাণ ধান নিয়ে কোনো কৃষকই খাদ্য গুদামে যেতে চান না। অনেক সময়ই খাদ্য মন্ত্রণালয় অসংগৃহিত ধানের বিপরীতে চালের বরাদ্দ প্রদান করে মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে থাকে। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয় না।
অথচ কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করা ব্যতিত কৃষির সমৃদ্ধি ধরে রাখাও কঠিন। এ কারণে সরকারের উচিত ধান চাল সংগ্রহের পদ্ধতি কৃষকবান্ধব করা। অর্থাৎ খাদ্য বিভাগকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে। প্রয়োজনে হাটবাজারে, কিংবা প্রতিটি চাল কলে সরকারকে বিনির্দেশমতো ধান কেনার উদ্যোগ নিতে হবে। যা কার্যকর করতে কিছু সুপারিশ বিবেচনার জন্য তুলে ধরছি। ১. খাদ্য বিভাগকে আগ্রহী প্রতিটি চালকল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী চালকল মালিক মিল গেটে কিংবা মিলের আশেপাশে হাটবাজার কিম্বা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে সরকারি বিনির্দেশ মোতাবেক শুকনা ধান সরকার নির্ধারিত দরে খরিদ করবেন। ২. খরিদকৃত ধান চালকল মালিক পরিবহন করে মিলে এনে ভাপাই সিদ্ধ করে ফলিত চাল খাদ্যগুদামে জমা করবেন। অর্থাৎ চুক্তিবদ্ধ প্রতিটি চালকলই হবে সংগ্রহকালীন সরকারের খাদ্য গুদাম। ৩. খাদ্য বিভাগকে ধান পরিবহন খরচ, সিদ্ধ শুকানো খরচ, ফলিত চাল খাদ্য গুদামে জমা প্রদানের খরচ এবং চালকল মালিকদের যৌক্তিক মুনাফা নির্ধারণ করে বিল প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. এ ক্ষেত্রে হাসকিং মিলগুলোতে যেহেতু কালার সর্টার মেশিন নেই, সেহেতু কালার সর্টার মেশিন থেকে মরাদানা বাছাইয়ের খরচ ও পরিবহন খরচ যুক্ত করতে হবে। এ পদ্ধতিতে যদি সরকার চাল সংগ্রহ করে তাহলে একদিকে কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে সরকারের আপদকালীন খাদ্য মজুদ গড়ে উঠবে। এ ছাড়া স্থান সংকুলানের অভাবে ধান সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না, বছরের পর বছর ধরে এ কথা বলে প্রকৃত কৃষকের বদলে এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর স্বার্থই রক্ষা করা হয়। আমাদের দেশে যেকোনো ফসলের ভালো ফলন হলেই, কৃষকের কপাল পোড়ে। যদিও ভোক্তা সাধারণ কম দামে খাদ্য কিনতে পারে সত্য। কিন্তু শুধু ভোক্তার স্বার্থ ভাবলেই হবে না, উৎপাদকের স্বার্থও ভাবতে হবে। যে কারণে ভোক্তার স্বার্থ ও উৎপাদকের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে হয়। ফলে কখনও শুল্কমুক্ত সুবিধায় খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়, আবার প্রয়োজনে খাদ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ করতে হয়। মূলত দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ভালো হলে আর বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয় না। কিন্তু সা¤প্রতিক সময়ে কৃষিপণ্যের উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি উৎপাদন খরচও বেড়েছে। গবেষক ও পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, সরকারকে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। পাশাপাশি কৃষক যেন ফসলের ন্যায্যমূল্য পান তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি থেকে কৃষককে রক্ষা, বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি না করা এবং ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা বাড়ানো জরুরি। দৃষ্টি বাড়াতে হবে, যেন কোনভাবেই মধ্যস্বত্বভোগীরা সুবিধা আদায় করতে না পারে।
উল্লেখ্য, কৃষিকাজ করে সিংহভাগ কৃষক পরিবার সচ্ছলতার মুখ দেখতে পারে না। শুধু কৃষিকাজ করে জীবন চালানো কঠিন। ফলে কৃষক পরিবারের সন্তানেরা বেশির ভাগই কৃষি কাজে থাকতে চায় না। আমাদের চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে এক সময় বাংলাদেশের মতো ছোটো ছোটো জমিতে চাষাবাদ হতো। পরে সেটা বাণিজ্যিক রূপ পায়। কৃষকেরা একত্র হয়ে চাষাবাদ করেন। এ পদ্ধতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ে এবং উৎপাদন খরচও কমে আসে। পাশাপাশি কৃষিতে বীমা পদ্ধতি চালু হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হলে বীমা থাকায় ক্ষতিপূরণ পান চাষীরা। আমাদের দেশেও একত্রে চাষাবাদ পদ্ধতি চালু করা দরকার। কমিউনভিত্তিক চাষাবাদ পদ্ধতি চালু করতে না পারলেও এই মুহ‚র্তে নাম মাত্র প্রিমিয়ামে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষি বীমা চালু করা দরকার। তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি হলে কৃষক যেন ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে, সে উদ্যোগ সরকারকে নেয়া উচিত। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, আগাম বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এ কারণে প্রতি বছরই কমবেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফলন বিপর্যয় ঘটে। ফলে কৃষকের মেরুদÐ ভেঙে যায়। কৃষককে বাঁচাতে হলে কৃষিতে এখন বীমা পদ্ধতি চালু করা বাধ্যতামুলক করা বাঞ্ছনীয়।
কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কৃষি ও কৃষক না বাঁচলে প্রকৃত অর্থে দেশের সমৃদ্ধি আসবে না। এ কারণে কৃষির ওপর আরো বেশি করে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে শস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। বেশির ভাগ সময়ে হিমাগারের অভাবে সবজি চাষীরা সবজি সংরক্ষণ করতে পারে না। ক্ষেতের সবজি ক্ষেতেই নষ্ট হয়। তখন সে পণ্য চাষীরা আর চাষ করতে চান না। ফলে উৎপাদন কমে আসে। বাধ্য হয়েই ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় যে পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আবার আমদানি করতে হয়। আর চাষের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হলে হঠাৎ করে কোন পণ্যের যেমন ঘাটতি হবে না। তেমনি উৎপাদন বেশি হলেও ক্ষেতের ফসল নষ্টও হবে না। কারণ চাষীরা সে পণ্য সংরক্ষণ করবেন এবং দাম বাড়লে হিমাগার থেকে বের করে বাজারে বিক্রি করবেন। এতে উৎপাদক ও ভোক্তার উভয়ের স্বার্থই রক্ষা হবে। কিন্তু সরকার দেশের নানা খাতে উন্নয়ন করছে ঠিকই। কিন্তু কৃষকের স্বার্থ রক্ষা হয় এমন সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগার নির্মাণে সরকার কেন গুরুত্ব দেয় না, যা আমাদের বোধগম্যের বাইরে। এই সমীকরণটি খুবই সরল। এরপরও সরকার যখন নির্বিকার থাকে তখন বলতে হয়, ক্ষমতাসীনরা শ্রেণি স্বার্থ রক্ষার কারণেই উৎপাদকের স্বার্থের চেয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই বেশি করে দেখে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি এখনো বড়ো ভ‚মিকা রাখে। কৃষির যে উন্নতি আমরা ১০-১২ বছর ধরে দেখছি, তার গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে কৃষির নতুন প্রযুক্তির দিকে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মস‚চিকে কম গুরুত্ব দিয়ে কৃষকের ধান চাষে ভর্তুকীর পরিমাণ বাড়ানো উচিত। কৃষকের অনুক‚লে উৎপাদন খাতে আরো ভর্তুকীর পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষি বীমা চালু করলে কৃষকের স্বার্থ অনেকাংশেই রক্ষা করা সম্ভব হবে।
আব্দুল হাই রঞ্জু : প্রাবন্ধিক।