প্রেমের ফাঁদপাতা ভুবনে/ কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে-এ ছিল রবি কবির ভ‚য়োদর্শন। বহুকাল সত্য ছিল এ বচন। আজ ভুবনের এক ইঞ্চি জায়গাও আর ঈশ্বরের দখলে নেই। সর্বত্র আজ মানুষ; হয় মানুষের স্থাপনা নয় তার পদচারণা। এখানে ফাঁদ কোথায়? আর ফাঁদ পাতার ঈশ্বর বোধ করি এখন শিবরাম চক্কোত্তির দখলে ; নাকে খাঁটি সর্ষের তেল দিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছেন। তবে মেয়েদের জন্য একটি বিকল্প ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছেন। এক শব্দের একটি লোভের টোপ আজ বরং যথেষ্ট কার্যকরী ব্যবস্থা। বিয়ে। হ্যাঁ, বিয়ে। প্রেম ভাণমাত্র। বিয়েই মূলকথা। নইলে ধর্ষণের এত এত ঘটনার একটা বড়ো অংশ জুড়ে বিয়ের প্রলোভন কথাটা আসছে কেন? বিয়ের প্রলোভনের শিকার হয়ে যারা ধর্ষিত হচ্ছে তারা কিন্তু শৈশবে ধর্ষণের হাত থেকে কোনোমতে রেহাই পেয়েছে অর্থাৎ শৈশব ছাড়িয়েছে। ধর্ষণের বর্বরতম এবং নিষ্ঠুরতম আক্রমণটির শিকার আমাদের শিশুকন্যারা। শিশু অধিকার ফোরাম বাংলাদেশ গত ছ’মাসের সমীক্ষায় যাদের সংখ্যা পাঁচশত বলে ধার্য করেছে। এই শিশুরা হয় পেডোফেলিক নির্যাতনকারীর বা পেডোফেলিয়ার শিকার। অথবা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোনো পিশাচের তাৎক্ষণিক যৌন আক্রমণের শিকার। শৈশব-উর্ধ্ব বা অতিক্রান্ত যারা ধর্ষণের শিকার তাদের একটা অংশ বিয়ের প্রলোভনের টোপ গেলে। কিন্তু কেন?
এটা তো মানতে হবে যে মন খারাপের কারণ ঘটলেও কন্যা সন্তানের জন্মের সংবাদে আজ আর কোনো পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে না। এটা সত্যি যে বহু বহুকাল কন্যার জন্মসংবাদ অন্তত প্রথম সন্তান হিসেবে অফুরান আনন্দ নিয়ে আসেনি। এখনও সম্ভাব্য সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় জানতে চাইলে আলট্রাসোনোর দায়িত্বে থাকা মানুষটি পুত্র সন্তানের খবর নির্দ্বিধায় পরিবেশন করেন কিন্তু কন্যার বেলায় ইতঃস্তত করেন। তিনি তো এ সমাজেরই মানুষ। কন্যার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারে এখনও যে উদ্বেগটি ভেসে বেড়ায় সেটি হচ্ছে, তার গাত্রবর্ণ এবং নাক-নকশা ঠিকঠাক আছে তো? এখনও আমাদের অন্তর্গত রক্তে খেলা করে সেই সংস্কার যে সংস্কারে মেয়েটিকে সমাজ-কাক্সিক্ষত রূপে বড়ো করতে হবে। পরের ঘরের উপযুক্ত করে গড়তে হবে তাকে। নইলে এতটা বদলে যাওয়া সময়ে মেয়েদের উন্নতির এত এত সূচক, এত এত পরিসংখ্যানের পরেও বিয়ের গুরুত্বের এতটুকু রদবদল কেন হলো না? গুরুত্বপূর্ণ কারণটা বোধকরি এই যে এখনও সংসার ও সন্তানের মধ্য দিয়ে জীবনের ধারা বহমান এবং এখনও সন্তানের বৈধতার দলিল ‘বিয়ে’।
আমাদের মেয়েদের জন্য যখন স্কুল হয়নি বা স্কুলে পাঠাবার প্রয়োজন যখন ছিল না তখন মেয়েকে বড়ো করার চিন্তাভাবনার জায়গাটা ছিল সম্পূর্ণ মায়েদের। পারিবারিক পরিবেশ থেকে তখনও প্রাথমিক শিক্ষা মেয়েরা পেত। অন্তত ধর্মীয় শিক্ষা তো বটেই। এদের মধ্য থেকেই এক শতাব্দীতে একজন রোকেয়ার জন্ম হয়েছিল। শিক্ষিত স্বামী তাঁর সহায়ক শক্তি ছিলেন। শুধু রোকেয়া নন, তাঁর সমকালে বা পরবর্তী আরও কিছুকাল শিক্ষিত স্বামীদের প্রেমপ্রীতিপূর্ণ সাহচর্য এবং শিক্ষার উৎসাহ সেকালের মেয়েরা যে পেতেন তার সপক্ষে প্রমাণ আজ দুর্লভ নয়। স¤প্রতি প্রয়াত প্রায় শতবর্ষী রাজিয়া বেগম সম্পর্কে মা, বন্ধু ও পথপ্রদর্শক শিরোনামে লিখেছেন তাঁর কন্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান। (দৈনিক প্রথম আলো) মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে এবং ১৬ বছরে প্রথম সন্তানের জন্মের পর বেঙ্গল সার্ভিসের কর্মকর্তা স্বামীর সঙ্গে নোয়াখালীর এক গণ্ডগ্রাম থেকে তাঁকে যেতে হয় কোলকাতায়। দশ বছর কোলকাতা বাসের সময়টাতে উচ্চ শিক্ষিত স্বামীর যথার্থ জীবনসঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিদ্যালয়ের আঙিনায় কোনোদিন পা না রাখা রাজিয়া বেগম হয়ে উঠেছিলেন তাঁর উজ্জ্বল, মেধাবী ছয় ছয়টি সন্তানের প্রথম শিক্ষক। আশি বছর বয়সে তাঁর স্মৃতিকথা ‘স্মৃতির জানালা’ এবং এর চার বছর বাদে প্রকাশিত তাঁর ২য় গ্রন্থ ‘ডায়েরির পাতা থেকে’ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন স্বয়ং রওনক জাহান। বলেছেন গ্রন্থ দুটি ‘আমাদের সামাজিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ।’ ১৯৯৬ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন তাঁকে বলেছেন, ‘অনেক বড়ো কাজ করেছেন আপনি’ ছ’টি সন্তানকে মানুষ করেছেন।’ তাঁর উত্তরটি ছিল, ‘ওদের বড়ো করে দিয়েছি, মানুষ করতে পেরেছি কিনা জানি না। রাজিয়া বেগমের আগে-পরে এমন উদাহরণ আমাদের সমাজে বিরল নয়। এঁরা কিন্তু যথার্থ জীবনসঙ্গী পেয়েছিলেন। সেকালে পরবর্তীকালের এই রত্ন-মায়েদের সংসার ধর্মের উপযোগী করে সামান্য প্রাথমিক শিক্ষাসহ তৈরি করা হতো। এবং বিনা বাক্যব্যয়ে বিদ্বান স্বামীরা অভিভাবকের সিদ্ধান্ত মেনে এঁদের পাণিগ্রহণ করতেন। কিন্তু সেদিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। পৃথিবীটা আমাদের চোখের ওপর দেখতে দেখতে ভীষণরকম বদলে গেল।
আজ সমাজের কোনো স্তরেই একটি মেয়েকে সেভাবে তৈরি করা হয় না বা তার কোনো অবকাশ নেই। বাল্যবিয়ে এখন অপরাধ বটে। মেয়েরা স্কুলে শুধু যাচ্ছেই না, প্রাথমিক শিক্ষা অব্দি লিঙ্গসমতা আজ রীতিমতো অর্জন নিঃসন্দেহে। কিন্তু একই সঙ্গে মেয়েদের সমস্যার অন্ত নেই। ভয়াবহ সমস্যাটি হচ্ছে নারীর নিরাপত্তাহীনতা। ঘরে-বাইরে কোথাও নারী আর নিরাপদ নয়। ট্রেন-বাসের মতো যানবাহনেও তার নিরাপত্তা নেই। নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমনকি কর্মক্ষেত্রেও। সংবাদ মাধ্যমে সা¤প্রতিককালে গুচ্ছের ধর্ষণ-ঘটনা একসঙ্গে আসছে। নিজের ঘরেও নারী আজ নিরাপদ নয়। স্বামীকে বেঁধে রেখে সদলবলে ধর্ষণোৎসব করে যাচ্ছে দর্বৃত্তরা। এ তো একদিক। অন্যদিকে নিজের সংসারে স্বামীই যে আতঙ্কের কারণ হচ্ছে না তাও নয়। প্রচুর প্রতারক স্বামী গ্রেপ্তারের খবর আসছে। বিয়েও ভাঙছে আকসার। যৌন সন্ত্রাসবিরোধী গণ কনভেনশনের তথ্য অনুযায়ী (দৈনিক প্রথম আলো, ১২ মে ২০১৮) স্বামীদের যৌন নিপীড়নের শিকার ৯০ শতাংশ স্ত্রী। এখানে অবশ্য বৈবাহিক ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে। স্ত্রীকে ঘরে রেখে শ্যালিকা ধর্ষণ, সেও সম্পর্ক-ধর্ষণ নিশ্চয়ই। আপন বোনের কাছে শিশু কন্যাকে রেখে স্বামী-স্ত্রী রাজধানীতে কর্মরত। এক বছর ধরে আপন ফুফা নির্যাতন করে চলেছে তাকে, স্ত্রী নিরুপায় দর্শক। এই ধর্ষকেরা আকাশ থেকে পড়ছে না। সমাজে এদের চাষবাস হচ্ছে। এই টালমাটাল সময়ে এখনও ‘বিবাহ’ নামক সম্পর্কের পবিত্রতা ঘোষণা করে যাচ্ছে সমাজ। মেয়েটিকে সে স্বপ্নে বিভোর হবার মন্ত্র দিচ্ছি আমরা। কোনোদিন চোখে না দেখা, কানে না শোনা স্বামীর ঘরে পাঠাতে বা ঘর করতে বাধ্য করছি। এক্ষেত্রে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা স্বনির্ভর-পরনির্ভর ভেদাভেদও করছি না। মেয়েটি মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত, রোজগেরে যেমনই হোক মেয়ে বই তো নয়। স্বামীর ঘর তার তীর্থক্ষেত্র তো নিশ্চয়ই। কিন্তু দ্রুত, অতিদ্রুত পরিবর্তমান পৃথিবীতে পুরোনো রীতি-প্রথা-বিশ্বাস বা ধ্যান-ধারণা নিয়ে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। সমীচীনও নয়। আজ সফল, সুন্দর আনন্দময় এবং বিকশিত একটি জীবন নারীরও আরাধ্য। কন্যা ও স্ত্রী হিসেবে একটি ঝলমলে জীবনের অধিকার নারীর ক্ষমতায়ন, সমতায়ন, নারী মুক্তি বা নারী স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ হতেই হবে। কারণ আর কিছু নয়, পূর্ণকালীন দুটো জীবন একসঙ্গে চালাতে হয় নারীকেই। সন্তানধারণসহ সংসার জীবন এবং পেশাগত জীবন। এক্ষেত্রে নারীর ভেঙে পড়ার, হাল ছেড়ে দেবার বা ক্ষয়ে যাবার দৃষ্টান্ত অনেক। একই সঙ্গে সাফল্যের শিখর যাঁরা ছুঁয়েছেন তাঁদের দৃষ্টান্ত এবং তাঁদের পরামর্শ নারীকে শুধু পথ দেখাবে না, সমাজটাও সুন্দরের পথে নিয়ে যাবে।
প্রতীক বর্ধনের অনুবাদে প্রকাশিত (দৈনিক প্রথম আলো, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯) দ্য সিইও ম্যাগাজিন জুলাই সংখ্যায় আজকের কর্পোরেট বিশ্বের পুরুষ রাজত্বে শত শত কোটি ডলারের কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব পালনে এক নারীর সাফল্যের কথা পড়েছি আমরা। নিজের জীবনে সফলতার মূল কারণগুলো বলেছেন তিনি। এই কারণগুলোই আজ বিশ্বনারীর জন্য উপদেশ। ইন্দ্র নুয়ি বলেছেন, নারীর কর্মজীবনের পথ চিরকালই বন্ধুর ছিল। আমরা অতীতকাল নির্ণায়ক শব্দটা তুলে নিচ্ছি। কারণ এ পথ এখনও সর্বত্র মসৃণ নয়। কারণ হিসেবে নুয়ি নিজের কাজের প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন প্রধান নির্বাহীর কাজটা যেমন পূর্ণকালীন, তেমনি মায়ের কাজটাও পূর্ণকালীন। নুয়ি ভারতের প্রেক্ষাপটে যা বলেছেন আমাদের জন্য তা সর্বাংশে প্রযোজ্য। নুয়ি বলেছেন, ঘরের মেয়ে বা বউ হওয়াও পূর্ণকালীন কাজ। সব ভ‚মিকায় নারী দারুণ কাজ করবে তা ভাবা পাগলামো। অন্য কথায় অসম্ভব। অর্থাৎ একই সঙ্গে দুটি ক্ষেত্রে পূর্ণকালীন কাজ সাফল্যের সঙ্গে করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তাঁর উপদেশটি হচ্ছে সঠিক জীবনসঙ্গী বেছে নিতে হবে নারীকে। জীবনসঙ্গীর সহযোগিতা পাওয়া না গেলে নারীর পক্ষে কিছু করে ওঠা সত্যিই কঠিন। এক জীবনে সঠিক জীবনসঙ্গীই প্রকৃত পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম।
সামাজিক স্তরভেদে ‘সঠিক জীবনসঙ্গী’র রূপ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু প্রভাবক শক্তি হিসেবে সর্বস্তরে তাদের গুরুত্ব সমান। মানতে হবে আজকের নারী আর চারদেয়ালের বন্দীশালায় ফিরবে না। যে কারণে হোক, যেভাবে হোক সে বাইরে বেরিয়েছে। তার জন্য একের পর এক দরোজাও খুলে যাচ্ছে। কিন্তু বানের জল শুধু পলি নিয়ে আসে না। এক যাত্রায় পৃথক ফল বা বিপরীত ফলও ফলে। হাজার একটা সমস্যা তৈরি হবে। কিন্তু হতোদ্যম বা হতাশ হলে চলবে না। সঠিক জীবনসঙ্গী নির্বাচনের বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। চলার পথটিকে মসৃণ, নিষ্কণ্টক ও নিরঙ্কুশ করার জন্য এটিও একটি উদ্যোগ হওয়া চাই। নুয়ি নারীর সুন্দর জীবনের কথা ভেবেই কথাটা বলেছেন। সংসারের নিত্যকর্মের ভারবহনে বা ভার লাঘবে সঠিক জীবনসঙ্গী নিজেকে তৈরি করবেন, কর্মক্ষেত্রে তার এগিয়ে যাবার পথের সঙ্গী না হতে পারেন অন্তত বাধা হবেন না কখনো। সেই সঙ্গে নারী তাঁর ভালোবাসার, ভালোলাগার ক্ষেত্রগুলোর পরিচর্যার সুযোগ পাবেন। আনন্দময় সংসারের আঙ্গিনায় হেসে-খেলে সঠিক পরিচর্যায় শিশু বড়ো হবে। বেড়ে উঠবে। মানুষ হবে।
ফেরদৌস আরা আলিম : শিক্ষক ও কলাম লেখক/ সময়ের বিবর্তন