৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। স্বাধীনতার পর অর্ধ শতাব্দী পার হলেও এদেশে শিক্ষকদের অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাস্তবায়িত হয়নি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন। প্রাথমিকের মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ তাঁর স্বপ্ন ছিল। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তির নতুন নতুন জ্ঞান আহরণে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য ও বিভেদ দূরীকরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ একটি সময়ের দাবি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, দেশ যেখানে ক্ষত-বিক্ষত, অর্থনীতির চাকা অচল, সেই সময়টিতে জাতির জনক প্রাথমিক শিক্ষার ভীত শক্ত করার জন্য দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে একযোগে জাতীয়করণ করে তাঁর দূরদর্শীতার স্বাক্ষর রাখেছিলেন, যার সুফল পাচ্ছে দেশবাসী। আবার সে ধারা বাহিকতায় জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরই সু-যোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২৬হাজার রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে আরেকটি নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পারেও মাধ্যমিক থেকে তদ্ধূর্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হবে না একথা ভাবা যায় না।
বিগত ৪৯ বছরে দেশে অনেক পরিবর্তন সাধীত হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি শুধু এদেশের বেসরকারি শিক্ষকদের। সরকারি চাকরিজীবী একজন পিয়নের বেতন একজন বেসরকারি শিক্ষদের চাইতেও বেশি।
করোনার এ মহামারিতে সমগ্রবিশ্ব যেখানে স্তব্ধ, শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে ধরাশায়ী, পিতামাতা যেখান সন্তানদের ভবিষৎ নিয়ে উদ্বিগ্নœ , সেখানে আমাদের সন্তানদের শিক্ষার মূল ধারায় ধরে রাখতে চালু হয়েছে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম। সরকারি-বেসরকারি সকল শিক্ষকগণ এই অনলাইন পাঠদানে অংশ গ্রহণ করছে। ক্লাসগুলোকে প্রাণবন্ত করতে সরকারি-বেসরকারি সকল শিক্ষকের প্রাণান্ত চেষ্টা অব্যাহত। শ্রেণি পাঠদান দেখলে সরকারি-বেসরকারি পার্থক্য বোঝার উপায় নেই। অথচ বেতনের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য। একই দেশে বসবাস করে একই সিলেবাস পড়িয়ে, একই কর্ম ঘন্টা অনুসরণ করে, একই প্রসাশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, সরকার অনুশ্রæত নিয়োগ পদ্ধতি অনুসরণ করে এ বৈষম্য এতদিন অব্যাহত থাকবে, তা বোধকরি সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও কোণোদিন আশা করেনি।
বর্তমান সরকার ২০২০-২০২১ সালকে মুজিব বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেশবাসী মুজিববর্ষ পালন করছি। এই মুজিববর্ষকে বেসরকারি শিক্ষকদের কাছে চিরস্মরণীয় করতে মাধ্যমিকসহ তদ্ধূর্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জোর দাবি জানাচ্ছি। আর এ জাতীয়করণে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সরকারের বেশি খরচ হবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরকারি করলেন তাতে প্রতিষ্ঠানের কোনো আয় ছিলনা, অনেক স্কুলেই ছিল না যথেষ্ট মেধাবী শিক্ষকের আনাগোনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ ইচ্ছাতে জাতীয়করণ করে তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিয়েছেন। আমরাও বেসরকারি শিক্ষকরাও তেমনি চাই জীবনের নিরাপত্তা। সারাজীবন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করে পরে নিজের জীবনসহ পরিবার নিয়ে থাকতে হয় চরম আর্থিক অনিরাপত্তায়। অর্থাভাবে অনাহারে অবহেলায় মরতে হয়।
জাতীয়করণ হলে সরকারি কোষাগার থেকে মোটেই খরচ হবে না বরং উদ্বৃত্ত থাকবে যা দিয়ে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করা যাবে। শুধু ব্যবস্থাপনা সূচারু রূপে করতে পারলেই সকল প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ সম্ভব। আর জাতীয়করণের করলে এর সুফর পাওয়া যাবে নিশ্চিভাবেই। যেসব সুফল পাওয়া যাবে-
(১) মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে।
(২) সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর হবে।
(৩) জ্ঞানার্জনে সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে।
(৪) শিক্ষকদের মনস্তাত্তি¡ক দূর্বলতা কাটিয়ে একাগ্রচিত্তে পাঠদান কার্যে অংশগ্রহন করতে পারবে।
(৫) দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সন্তানেরা কম খরচে লেখাপড়ার সুয়োগ পাবে।
(৬) গউএ এবং ঝ উএ অর্জন সহজ হবে, দেশ ২০৪১ উন্নত দেশে পরিনত হবে।
(৭) মেধাবীদের এ পেশায় আরও বেশি আসার সুযোগ তৈরি হবে।
(৮) জাতি গড়ার কারিগরদের নিজের জীবনসহ পরিবারের জীবন সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
আর এ কাজে সরকারি ব্যায় খুব একটা হবে বলে মনে হয় না। আমাদের এ সীমিত সম্পদের মধ্যে সম্ভব। আমরা একাজে
(১) প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গ্রহণকৃত একটি আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমাদিয়ে ফান্ড বৃদ্ধি করতে পারি। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কারিগরি ও মাদরাসা মিলে মোট শিক্ষার্থী আছে প্রায় ২ কোটি। আর এ ২ কোটি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসিক ২০ টাকা হারে বেতন জমা হয় তাহলে সরকারি ফান্ডে ১২ মাসে জমা পড়বে ৪৮০ কোটি টাকা।
( ২) প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কিছু স্থায়ী আয় আছে যার থেকে বার্ষিক কিছু অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে ফান্ড বৃদ্ধি করতে পারি।
(৩) ২ কোটি শিক্ষার্থী যদি ২০০ টাকা করে সেশন চার্জ সহ অন্যান্য চার্জ দেয় তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়বে ৪০০ কোটি টাকা।
(৪ ) ব্যয় সংকোচন নীতি পরিগ্রহ করা য়েতে পারে।
স¤প্রতি মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ নিয়ে অনলাইন টিভি ও ভার্চুয়ালে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে। সাবেক শিক্ষা সচিব এন আই খান মহোদয়ও তার প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তিনি আন্দোলন সংগ্রাম বাদ দিয়ে দেশে সকল শিক্ষক সংগঠনে নেতাদের এক টেবিলে বসে বিষয়টি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বুঝানো কথা বলেছেন।
স¤প্রতি কিছু সংগঠন ৫ অক্টোবর আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছে, যেটা জাতীয়করণ ধ্যান- ধারণার পরিপন্থী। বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষকদের জন্য একটি পবিত্র দিন। আর এই দিনে আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া মানে জাতীয় করণের ধ্যান-ধারণাকে নস্যাৎ করে সরকারের জাতীয়করণে মানসিকতাকে ভুলুণ্ঠিত করা।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সকলে একত্রিত হয়ে গণতন্ত্রের মানস কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার কাছ থেকে জাতীয়করণ আদায় করা।
বিশ্বজিৎ রায় : শিক্ষক ও কলাম লেখক।