সৃষ্টির শুরু হতে পৃথিবীতে কতই না অজানা রহস্য রয়েছে, যার অনেক কিছুই ভেদ করা মানুষের পক্ষে এখনও সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর জানার রয়েছে অনেক বাকি। আমাদের বাংলাদেশও কি কম রহস্যময়? এখানেও লুকিয়ে আছে রহস্যময় কিছু স্থান, যা মানুষের কাছে আজও অনাবিষ্কৃত। সে রকম কিছু রহস্যময় স্থানের কথা।
বগা লেক
বান্দরবানের কেওকারাডংয়ের আগে বগা লেক। বম ভাষায় বগা মানে ড্রাগন। বমদের রূপকথা অনুযায়ী—একদিন আকাশ থেকে নেমে আসে এক আজব প্রাণী। ড্রাগনের মতো দেখতে। নানা অলৌকিক কাণ্ড ঘটানো আজব জীবকে মানুষ ডাকতে শুরু করে বগা। রুমা এলাকার একটা পাহাড়ের গুহায় আস্তানা বানিয়ে নেয় বগা। বগাকে খুশি করতে নিয়মিত নানা ধরনের জীবজন্তু উপহার দিতে থাকে মানুষ। হঠাৎ গ্রাম থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করল শিশুরা। সম্প্রদায়ের নেতাদের সন্দেহ, কাজটা বগার। সব সম্প্রদায় থেকে বেছে বেছে সাহসী জওয়ানদের নিয়ে গঠন করা হলো একটা দল। তীর, ধনুক, বল্লম, লাঠি আর মশাল নিয়ে রাতের অন্ধকারে দলটি হানা দিল বগার গুহায়। গুহার মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষের রক্ত আর হাড়গোড় দেখল। বুঝতে বাকি রইল না কারো, কী ঘটেছে। ওই বগাই যত সর্বনাশের মূল। একসঙ্গে বগার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যুবকরা। কোনো জাদুবিদ্যা দেখানোর আগেই বগা হলো কুপোকাত। কুলিয়ে উঠতে না পেরে পালানোর জন্য রথে উঠে বসল বগা। রথে আগুন ধরিয়ে দিল যুবকরা। সেই আগুনে পুড়ে মরল বগা। আর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে থর থর করে কেঁপে ওঠল গুহা। ভেঙে পড়ল পাহাড়। তৈরি হলো বিশাল এক গর্ত। ওই গর্তটাই বগা হ্রদ।
বগা লেকের অন্য নাম ড্রাগনের হ্রদ। বগা লেকের পুরো নাম বগাকাইন হ্রদ। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে কেওক্র্যাডং পর্বতের গা ঘেঁষে হ্রদটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় দুই হাজার ফুট। চোঙা আকারের আরেকটি পাহাড়ের চূড়ায় বগা লেকের অদ্ভুত গঠন দেখতে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো। লোক কথার বিস্ফোরণের সঙ্গে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মিল পাওয়া যায়। কোনো কোনো ভূতাত্ত্বিক মনে করেন, বগাকাইন হ্রদটি হয় মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ নয় তো মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের কারণে এর সৃষ্টি। এর পানি অম্লধর্মী। কোনো জলজ প্রাণী এখানে বাঁচতে পারে না। বাইরের কোনো পানি এখানে ঢুকতেও পারে না, আবার আশপাশে পানির কোনো দৃশ্যমান উৎসও নেই। এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে হ্রদের পানি যখন ঘোলাটে হয়, আশপাশের ছোট ছোট জলাশয়ের পানিও ঘোলাটে হয়ে যায়। এর তলদেশে একটি গরম পানির প্রবাহ আছে। গরম পানি বেরোনোর সময় হ্রদের পানির রং বদলে যায়। স্থানীয়দের কাছে হ্রদের গভীরতা আর পানি বদলটাই রহস্য। হয়ত আন্ডার গ্রাউন্ড রিভার থাকতে পারে। বগা লেক আগ্নেয়গিরি থেকে এর সৃষ্টি কি না এ নিয়ে ভূতত্ত্ববিদগণ নিশ্চিত নন। তবে এর গভীরতা সর্বোচ্চ ৩৫ মিটার তারা পরিমাপ করেছেন।
গানস অব বরিশাল
১৭৫৭ সামে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ দখলের পরে বড়ো বড়ো শহর-বন্দরে অবস্থান নিতে থাকে। ১৮৭০ একজন ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট সর্বপ্রথম ‘গানস অব বরিশাল’ টার্মটা ব্যবহার করেন। তার লেখায় জানা যায়, ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসে বরিশাল থেকে দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর থেকে অদ্ভুত ধরনের কামান ফাটানোর শব্দ আসে। নেটিভেরা এই শব্দকে ‘বরিশাল কামান’ বলে ডাকে তাই উনি নাম দিলেন ‘গানস অব বরিশাল’। এ ধরনের রহস্যময় শব্দকে একত্রে বলা হয় মিস্টপুফাস। ১৮৮৬ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী বরিশাল, খুলনা, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, হরিশপুর প্রভৃতি এলাকায় বরিশাল গানস শোনা যেত। টি ডি লাতুশ ১৮৯০ সালে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বরিশাল গানস কেবল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ নয়, ব্রহ্মপুত্রের ব-দ্বীপেও শোনা যেত। সেই বিকট শব্দ ঢেউয়ের শব্দের চেয়ে কামানের গোলা দাগানোর শব্দের সঙ্গে বেশি মিল ছিল। কখনও একটি শব্দ আবার কখনও দুটি-তিনটি শব্দ একসঙ্গে শোনা যেত। ব্রিটিশরা প্রথম দিকে ভেবেছিল হয়ত ডাচ কিংবা পর্তুগিজ দস্যুরা বরিশালে কোনো গোপন ঘাঁটি করেছে। অন্য একদল গবেষকদের মতে, বঙ্গোপসাগরের গভীরে হয়ত কোন সাগর গর্ভস্থ আগ্নেয়গিরি কিংবা বিশালকায় খাল আছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ওখানে হয়ত কোন বিস্ফোরণ হয়। ব্রিটিশরা সাগরে উপকূলঘেঁষে সন্ধান করে কিন্তু কোনো সমাধানে আসতে পারে না। বিজ্ঞানীরা আজকাল ভাবেন, সাগর তীরে টেকটোনিক প্লেটের কোন মুভমেন্ট বা অন্য কোনো কারণে হয়ত এই জাতীয় শব্দের উৎপত্তি। এর স্বপক্ষে কোনো জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কবি সুফিয়া কামাল তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তার শৈশবে এ ধরনের আওয়াজের কথা বড়োদের মুখে শুনেছেন। তবে ১৯৫০ সালের পর এ ধরনের শব্দ আর কেউ শুনেছে বলে জানা যায়নি।
মৃত আগ্নেয়গিরি কিংবা অন্য কোন রহস্যই হোক না কেন ‘গানস অব বরিশাল’ এখনো রয়ে গেছে আনসলভড মিস্ট্রি হিসাবে।
চিকনকালা গ্রাম বা নেফিউপাড়া
মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু এবং দুর্গম গ্রামগুলোর একটি হলো এই চিকনকালা গ্রাম বা নেফিউপাড়া। এ অঞ্চলটি যেন একেবারেই পৃথিবীর বাইরের। মুরং অধ্যুষিত এই গ্রামটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থিত। জিপিএসের হিসাব মতে, এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৭০০ ফুট ওপরে অবস্থিত। গ্রামের লোকদের ধারণা, এখানে অতৃপ্ত অপদেবতাদের বাস আছে। প্রতি বছরই হঠাৎ কোনো একদিন বনের ভেতর ধুপধাপ আওয়াজ হয়। এই আওয়াজ শুনলে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বনের ভেতরে থাকা কাঠুরে বা শিকারির দল প্রাণ বাঁচাতে বন থেকে বেরিয়ে আসে। প্রতি বছরই দু-একজন পেছনে পড়ে যায়। তারা আর কোনোদিন গ্রামে ফিরে আসতে পারে না। কয়েকদিন পর গ্রামে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাতে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকে না। এক ধরনের আতঙ্ক আর ক্লান্তি ছেঁয়ে থাকে তাদের মুখম-লে। কিন্তু কী দেখে ভয় পেয়েছে, আর কীভাবে কোনো ক্ষতচিহ্ন ছাড়া মারা গেছে সেই রহস্য এখনো চিকনকালার লোকজন ভেদ করতে পারেনি।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড (Swatch of No Ground) খাদ আকৃতির সামুদ্রিক অববাহিকা বা গিরিখাত, যা বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানকে কৌণিকভাবে অতিক্রম করেছে। নামটি ব্রিটিশদের দেওয়া। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যেখান থেকে শুরু, সেখানে হঠাৎ পানির গভীরতা অনেক বেড়ে যায়। ব্রিটিশদের ধারণা ছিল, সমুদ্রের এই খাদে কোনো তল নেই। এ জন্যই এর নাম সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। এটি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত। গঙ্গা খাদ নামেও এটি পরিচিত। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের প্রস্থ ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার, তলদেশ তুলনামূলকভাবে সমতল এবং পার্শ্ব দেয়াল প্রায় ১২ ডিগ্রি হেলানো। মহীসোপানের কিনারায় খাদের গভীরতা প্রায় ১,২০০ মিটার।
ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরের নিচে কান্দা ও উপ-বদ্বীপ উপত্যকার আকারে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সাগর অভিমুখে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার সম্প্রসারিত হয়ে আছে। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের দিকে মুখ করে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের মোহনার কাছে বালুচর ও শৈলশিরার অবস্থিতি এই ইঙ্গিতই বহন করে যে, এই খাদ দিয়েই পলল বঙ্গোপসাগরের গভীরতর অংশে বাহিত হয়। বঙ্গীয় ডিপ সি ফ্যানের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে যে, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড অবক্ষেপপূর্ণ ঘোলাটে স্রোত এনে বেঙ্গল ফ্যানে ফেলছে। বঙ্গীয় ডিপ সি ফ্যানের অধিকাংশ পলল গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সঙ্গমস্থলে উদ্ভূত। এগুলো যথাক্রমে হিমালয়ের দক্ষিণ ও উত্তর দিক থেকে আসছে। বর্তমান অবস্থায় স্বল্প পরিমাণের ঘোলাটে স্রোত আর বালি সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের মাধ্যমে মহীসোপান থেকে গভীর সমুদ্রে পলল পরিবহণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে যে, প্লাইসটোসিন যুগে (২০ লক্ষ থেকে ১ লক্ষ বছর আগে) নিম্ন সমুদ্রপৃষ্ঠে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর পললের স্তূপ সরাসরি মহীসোপান প্রান্তে নির্গত হয়েছে। সোপান প্রান্ত ও সোপান প্রান্তের ঊর্ধ্ব ঢালে উৎপন্ন ঘোলাটে স্রোত ও নদী-প্রবাহের সম্মিলিত প্রভাব সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড গঠনের জন্য দায়ী। বঙ্গীয় ডিপ সি ফ্যানের লক্ষণ প্রমাণাদিও এই ধারণাকে সমর্থন করে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্লাইসটোসিন যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠ যখন নিম্নতর ছিল তখন বঙ্গীয় ডিপ সি ফ্যানে ঘোলাটে স্রোতের প্রভাবে অবক্ষেপণ সংঘটিত হতো। আর উপ-বদ্বীপটিতে পলল বণ্টিত হতো সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড থেকে উদ্ভূত আন্তঃসাগরীয় খাল (submarine channel) থেকে।
সমুদ্রের এ ভাগে এখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের জেলেরা মাছ ধরতে বেশিরভাগ ওই এলাকায় যান। এখানের পানির রঙের ভিন্নতা জেলেদের চোখেই প্রথম ধরা পড়ে। সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। প্রায় ৩ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এর বিস্তৃতি। ● ফিচার ডেস্ক
[সূত্র : এনসাইক্লোপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া]