শীতের প্রখরতা তখনও তেমন কাটেনি। মার্চের শেষ ভোর বেলা বেশ ঠান্ডা পড়ে। লেপে মুড়ি দিয়ে থাকতে হয়। গায়ের উষ্ণতা ও লেপের উষ্ণতা মিলে এক ওম ওম আমেজে ঘুমের পরেও ঘুম আসে না, শুয়ে থাকতে বড্ড ভালো লাগে। শীতের এই আমেজটা উপভোগ করতে বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায় না। সকাল হয়ে এলেও অফিসের তাড়া থাকলেও শুয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগে। মনে মনে ভাবছিলাম স্ত্রীর কাছ থেকে বাজারে যাওয়ার তাড়া না পেলে আর একটু ঘুমাবো। স্ত্রীলোকদের যা স্বভাব অতি প্রত্যুষে উঠে গিয়ে সংসারিক কাজে নিমজ্জিত হতে ওদের কি যেন উৎসাহ না তাড়না তা আজও বুঝতে পারিনি। ও উঠলে ভয়ে ভয়ে থাকি। চা বানিয়ে কখন যে আমাকে, বিছানা ছেড়ে উঠে আসার হুকুম জারি করবে। প্রথমে ভাবতাম এইভাবে আজ্ঞাবহ হতে হতে আমি ভে ধে হয় স্ত্রৈণ হয়ে পড়ব। কি জানি হয়ত ভুল বললাম, ওপরে হাক ডাক যাই করি না কেন মনে মনে আমি যে আজ্ঞাবহ হয়ে গেছি ইতিমধ্যে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। তাই বলে সেটাকে গলা ফাটিয়ে স্বীকার করা যাবে না। কারণ পুরুষত্ব বলে এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। সেটা তো জাহির রাখতে হবে। সত্য কথা বলতে কি, বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁত ব্রাশের তাগিদটা স্ত্রীর কাছ থেকে আসবে বলে অপেক্ষায় ছিলাম। হঠাৎ করে মোবাইলটা বেজে উঠল, হঠাৎ করে মনটা খিচরে উঠল। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ফোন, ‘‘আমি এক মহা সমস্যায় পড়েছি, তুই তাড়াতাড়ি আমার বাসায় চলে আয়’’ বলেই সে ফোনটা রেখে দিল। দিন শুরুর প্রস্তুতির পরিকল্পনাটি ছিন্ন হয়ে গেল। দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে পড়লাম, স্ত্রীর করা অনুশাসন‘‘কিছু মুখে না দিয়ে তুমি ঘর থেকে বের হবে না অবশ্যই।” বের হতে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় হয়ে গেল।
রাস্তায় বের হয়ে দেখি বাসের সংখ্যা যথেষ্ট কম। আমি থাকি উত্তরায়, বন্ধুর বাড়ি মগবাজার। বাসে গেলে দেরি হয়ে যাবে ভেবে। বন্ধুকে ফোন দিলাম, কিন্তু আশ্চর্য বন্ধুর কোনো সাড়া পেলাম না। দুশ্চিন্তাটা আরও বেড়ে গেল, ভাবতে শুরু করলাম কি বিপদ এসে আবার বন্ধুর জীবনে দেখা দিল। তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য একটা সিএনজি ঠিক করলাম। অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। কি এমন হতে পারে, যাওয়ার পথে সিএনজি থামিয়ে এটিএম বুথ থেকে কিছু টাকা তুললাম। কারণ জানি যেকোনো বিপদে অর্থের প্রয়োজনটা সত্য। বিভিন্ন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বন্ধুর বাসায় এসে কড়া নাড়লাম। বাইরে কোনো লোকের উপস্থিতি ছিল না। ভাবলাম যাক বাঁচা গেল। কেউ হয়ত মারা যায়নি। দরজা খুলতে বন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। বন্ধুকে সান্ত¡না দিতে দিতে বললাম আরে কাঁদিস পরে সমস্যাটা কী একটু খুলে বল। দেখলাম বন্ধুপত্নী বোবা নয়নে এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। ভাবি প্রথম শুরু করল, ‘‘শিউলিকে কাল রাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না’’। শিউলি ওদের বড়ো মেয়ে, ম্যাট্রিক দিয়েছে, দু-একদিনের মধ্যে রেজাল্ট পাওয়ার কথা। সে ছিল চোখে পড়ার মতো ষোড়শি সুন্দরি! এক চক্রে মাথা ঘুরে গেল, আমি ধপ্ করে চেয়ারে বসে পড়লাম।
ভাবির বক্তব্য এই ‘‘গতকাল সকালে আপনার ভাই অর্থাৎ আমার বন্ধু ওর কাছ থেকে খুব ভালো পরীক্ষার ফল আশা করছে বলে জানিয়ে ছিল”; ‘‘আমার বন্ধুদের জানিয়েছি তুই খুব ভালো ফল করবি। তোর রেজাল্ট সম্পর্কে অনেকেই খবর চাইত। ভালো ফল না করলে আমি তাদের কী উত্তর দিব। তুই যেভাবে চেয়েছিস আমি সেভাবে সব কিছুর ব্যবস্থা করেছিলাম, তার ফল যদি আমি না পাই তাহলে আমি কীভাবে মুখ দেখব”।
আমার মেয়ে শিউলিকে আমি খুব ভালো করে জানি ওর মতো এত ভালো মেয়ে আর হয় না। গত ছয় মাস খুব পরিশ্রেম করেছে। ভালো ফল সে না করে পারে না। আমার বন্ধুকে বলললাম, তুমি কাল সকালে যে সমস্ত কথা শুনিয়েছিলে সেটাইই তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করেছে। তাই সে পালিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে কোথায় সে পালালো তা বুঝে উঠতে পারছি না। সম্ভাব্য সব জায়গায় ফোন করে জেনেছি, সেসব জায়গায় সে যায়নি। এই বয়সে সে যদি কিছু না বুঝে কিছু একটা করে ফেলে তাহলে আমাদের জীবন ছারখার। আমার বন্ধুটি এতক্ষণ চুপ করে ছিল, সে প্রায় গম্ভির স্বরে শাসনের কণ্ঠে, আমি বলেছি আমি তো ওকে কোনো গাল-মন্দ করিনি। আমার আশার কথা ওকে জানিয়েছি মাত্র। আমার আকাক্সক্ষাটা ওকে জানানো কি অপরাধ। আমার প্রত্যাশা কথা ওকে জানিয়েছি। কিন্তু তুমি সেই থেকে কি ওকে কম কথা শুনিয়েছ, ভয় দেখিয়ে শাসিয়েছ। আজকের ঘটনার জন্য তুমিই দায়ী। আমি না হয় একটু কর্কশ ভাষায় আমার প্রত্যাশার কথা ওকে জানিয়ে ছিলাম। তুমি তো মা হিসাবে একটু কোমল করে ওকে বুঝাতে পারতে। এখন আমরা কী করব। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল ওকে খুঁজবার জন্য কি পুলিশের সাহায্য নিব। আমি বললাম দেখ কার কম দোষ কার বেশি, ভুল-ত্রুটি নিয়ে বিচারের সময় এটা না; ওর যে সমস্ত ঘনিষ্ট বান্ধবী রয়েছে তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ করতে হবে। ওদের কার ফোন নাম্বার কি তোমার কাছে আছে? ভাবি বললেন, না তা নেই। আমার বন্ধু চিৎকার করে বলে উঠলেন, কেবল মা হলেই হলো, মেয়ে কোথায় যায় না যায় তাদের ফোন নাম্বারটাও সংগ্রহ করে রাখতে পারনি। চিৎকার করে মাথা গরম করে কাজ হবে না। বন্ধুটি নিরাশ স্বরে বলল, আমি যে কী করব আমি কিছু বুঝতে পারছি না। বললাম চল ওদের ফোন নাম্বার জোগাড় করি। ও বলল কোথা থেকে যোগাড় করবি। আমি বললাম আয় আমার সাথে। বললাম ও যেখানে কোচিং করত চল ওখানে আগে যাই, বন্ধুটি কিছু আশা পেল বলে মনে হলো, কোচিং সেন্টারটি বেশি দূরে নয়। আমি নিজে ওকে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। এবার কাজ হলো কোচিং সেন্টারের স্যার ওর ঘনিষ্ট বান্ধবিদের ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। দেখুন কিছু খবর বের করতে পারেন কি না। আসার সময় স্যার একটা খুব সুন্দর কথা বললেন। ‘এই সমস্ত টিন এজারদের অবিভাবক হওয়া সহজ নয়, They have a delicate mind and life very much fragile you need to handle them with much care’। কথাটি মনে ধরেছিল বিধায় আজ তা বলতে পারলাম। মা-বাবা হিসাবে আমরা আমাদের সন্তানদের অনেক সময় শুধু শাসনই করে যাই। কিন্তু তাদের বয়সের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের মানসিক চাহিদা অনুসারে আমরা যোগান দিতে পারি না বিধায় তারা বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। আমরা কেবল ওদের দোষারোপে করি কিন্তু কদাচ নিজেদের দোষ ও অপারগতাকে মেনে নিয়ে যথার্থ অবিভাবক হয়ে উঠতে ব্যর্থ হই। বাবা-মা হওয়ার আগে আমি দেখেছি বিদেশি যুবক-যুবতীরা প্যারেন্ট হুট সম্পর্কে বহু বই পুস্তিকা পড়ে ফেলে ফলে শ্বশুর-শাশুড়ির অবর্তমানে বা নিজের মা-বাবার অনুপস্থিতিতে একটি শিশুকে বড়ো করে তোলার দায়িত্ব স্বামী-স্ত্রীতে ভাগ করে নিতে হয়। ইংরেজিতে Terrible Two বলে একটা কথা আছে। যার অর্থ এই যে দুই বছরের শিশুরা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি চঞ্চল হয়ে থাকে। আর এই বয়সে আমাদের দেশে শিশুরা মা’র কাছ থেকে বেশি মার খেয়ে থাকে। জীবনে স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের শিশুরা অনেক সময় বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এবং এই বিকারগ্রস্ততা নিয়ে তারা বেড়ে উঠে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক শিশু স¦াভাবিক হয়ে যায়। আবার অনেক শিশু জীবনে কৈশোর ও যৌবনকালে সেই বিকারগ্রস্ততদের মানসিক জীবনে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে থাকে। আমরা অনেক সময় স্কুল পালানো ছেলে বাবা-মা টাকা চুরি করে হারিয়ে যাওয়া ঘটনাকে সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সব শিশুই এক রকম নয়। ছোটবেলার সেই বিকারগ্রস্ততা যখন তার অবেচেতন মনে ফিরে আসে তখন আমরা মনে করি, ছেলেটি পাগলামি করছে, কিংবা অবুঝের মতো কাজ করছে আমরা কেন বুঝতে পারি নাÑএকটি শিশু সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে তার মানসিক গঠনে, সাহায্য না পেলে অবস্থাটা এরকমই দাঁড়ায়। তাই ২ বছরের শিশুকে খুব সাবধানতার সাথে ভালোবাসা দিয়ে শাসন করতে হয়।
বান্ধবিদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল শিউলি তার এক বান্ধবির বাসায় পালিয়ে গেছে। সে বলেছে, রেজাল্ট ভালো হলে সে ফিরে আসবে, না হলে নয়। খবরটা শুনে আমার বন্ধু ও বন্ধুপত্নী যতটা খুশি হলো তার চেয়ে চেয়ে উদ্বিগ্ন হলো মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। সে এ-ও বলে গেছে, আমাকে খোঁজার চেষ্টা করা হলে আমি আর কখনই ফিরে আসব না। বন্ধুটি আমার হাত চেপে ধরে বলল, দোস্ত চল আমার সাথে আমাদের কুমিল্লায় যেতে হবে। একটা গাড়ি ভাড়া করে আমরা কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা হলাম। নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছানোর পর আমরা স্থির করলাম কড়া নেড়ে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমারা বাড়িতে প্রবেশ করব। আমাদের সংবাদ পেয়ে শিউলি যেন আর পালাতে না পারে। যাওয়ার আগে ওর রেজাল্ট জেনে নিয়েছিলাম ইন্টারনেট থেকে। আমার বন্ধু সেই রেজাল্ট দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, শিউলি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। বাসায় ঢুকেই আমার বন্ধুটি কোন ভূমিকা ছাড়াই বলল, মা শিউলি আয় তুই গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিস। গৃহকর্তা যিনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন। তিনি ঘটনা দেখে হতবাক্। বাবার কান্না শুনে কাঁদতে কাঁদতে শিউলি উপস্থিত। আমি আমার বন্ধুকে শক্ত করে ধরলাম। কেন সে পালিয়ে এসেছে। এই বিষয়ে ওকে আর প্রশ্ন করা যাবে না। বন্ধুটি আমার কথা রেখেছিল।
হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল, আমার অফিস থেকে খবর এসেছে। আমাকে জরুরিভাবে অফিসে যেতে হবে। বললাম, আমি কোনোভাবে যেতে পারব না। এ এক অসম্ভব ভালো গল্পের পরিণতি হলে পর আমি বাসায় ফিরে স্ত্রীকে সমস্ত ঘটনা বলে বিছানায় গা এলিয়ে একটু ঘুমাতে চেষ্টা করলাম তখন দুপুর প্রায় একটা সমকিছু এত তড়িৎ ঘটেছিল বলে, শুধু মধুরেণ সমাপয়েৎ হলে পর আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
ড. এলগিন সাহা : লেখক ও এনজিও ব্যক্তিত্ব।