১.
সম্প্রতি আমাদের বাংলাদেশ সুখী দেশের তালিকার সূচকে বেশ এগিয়েছে, সাত ধাপ এগিয়ে এখন ৯৪ নম্বরে; পূর্বে ছিল ১০১ নম্বরে। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস’ রিপোর্টে ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে পরিতৃপ্ত হয়েছে; ভারতের অবস্থান ১৩৬ এবং পাকিস্তানের ১২১ নম্বরে। সুখের সূচকে দেখা যায়—দেশটির সামাজিক সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক উদারতা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মোট দেশজউৎপাদন জিডিপি, গড় আয়ু এবং দুর্নীতির মাত্রা বিষয়গুলোকে সামনে রাখা হয়। তবে এবারে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারিতে মানুষের সার্বিক পরিস্থিতিকে। করোনাকালীন বিলুপ্ত প্রায় আদিবাসীদের রক্ষায় স্বতন্ত্র কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। সরকারের উপেক্ষায় আদিবাসীরা নিজ নিজ জনগোষ্ঠীকে রক্ষার্থে সচেতনতা গড়ে তুলেছিল। তথ্য মতে—প্রায় ৭৩টি জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসরত, এদের মধ্যে ৩৯টির মাতৃভাষা বেঁচে আছে; কোভিড-১৯ দুর্যোগকালীন সময়ে সরকারের সামান্যতম সহানুভূতিও চোখে পড়েনি। বরং চোখে পড়েছে আদিবাসীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক শান্তি সূচকেও সাত ধাপ এগিয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে শান্তি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৭তম এবং ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ২ দশমিক ০৬৮ স্কোর নিয়ে ৯১তম স্থানে উঠে এসেছে। অষ্ট্রেলিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস্ অ্যান্ড পিস (আইইপি)-এর সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিশ্বের স্বাধীন ১৬৩টি দেশ ও ভূখণ্ডের নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের নিরাপত্তা, সুরক্ষা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে নেয়া পদক্ষেপের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা তৈরি করে আইইপি। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সহিংসতার অনুপস্থিতি অথবা সহিংসতার ভয়কে ধরে তিনটি মানদণ্ড সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা, চলমান সংঘাত এবং সামরিকায়নের ওপর ভিত্তি করে এই সূচক তৈরি করেছে আইইপি। প্রশ্ন হচ্ছে—সবচেয়ে অনগ্রসর, পিছিয়েপড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে শান্তির ছোঁয়া কতটুকু লেগেছে! শান্তির সংজ্ঞা কি ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া, ধর্ষিত হলেও নীরবে সহ্য করা কিংবা ন্যায় বিচারের প্রত্যাশায় স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অবজ্ঞা, অবহেলার ও নির্মমতার শিকার!
মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ আরও ২ ধাপ এগিয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ১৮৯টি দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তালিকা প্রকাশ করেছে। ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম স্থান ছিলো বাংলাদেশের কিন্তু বর্তমানে এটি দুই ধাপ এগিয়ে ১৩৩তম স্থান পোক্ত করে নিয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আয় ও সম্পদের উৎস বৈষম্য, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও আর্থিকপ্রবাহ, যোগাযোগ, পরিবেশের ভারসাম্য ও জনমিতির তথ্য বিশ্লেষণ করে মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করে ইউএনডিপি। মানব উন্নয়ন সূচকে আদিবাসীদের চিত্র কী হতে পারে! আদিবাসীদের আবাস্থলগুলোতেই ইকোপার্ক, বন ও বনায়ন ধ্বংস করে আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবনচক্রকে ব্যাহত করা হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতার উদাহরণ ও পরিসংখ্যান সত্যিই পিলে চমকে যায়।
২.
উত্তরাঞ্চল থেকে আদিবাসী সাঁওতালদের কান্নার রোল যেন থামছেই না। গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের সাঁওতালদের চোখের লোনাজল ক্ষণিকের জন্যে শুকিয়েছে, এরই মধ্যে রাজশাহী গোদাগাড়ীর নিমঘুটু সাঁওতাল পল্লীর কান্নার রোল বিবেকবানদেরকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ধানের জমিতে পানির প্রত্যাশায় দিনের পর দিন প্রহর গুণেছে অভিনাথ ও রবি মারাণ্ডী কিন্তু বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ থেকে তারা পানি পায়নি, কারণ তারা সাঁওতাল। সাঁওতালদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকতে নেই। পরিবারের অনটন থাকলেই বিত্তবানদের কাছে কামলা খাটবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, ঋণ নেবে এবং জোঁকের মতো করেই শরীরের রক্ত চুষে চুষে নিঃশেষ করতে পারবে। ভয়েস রেইস করলে তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের হুমকি, স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের জীবননাশ এবং বিচারের দ্বার রুদ্ধ করে এলাকাবাসীদের সমর্থন আমরা জীবন দিয়ে উপলব্ধি করি। আমরা সোচ্চার কণ্ঠেই বলতে পারি, গভীর নলকূপ থেকে ধানের জমিতে পানি প্রাপ্তিতে আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যের অনেক প্রমাণই রয়েছে। আদিবাসী কৃষক অভিনাথ ও রবি মারাণ্ডী মৃত্যুতে সেটি পুনর্বার উম্মোচিত হয়েছে। নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত নিশ্চয়ই অন্যের ইঙ্গিতে চলেছেন, সেটিতে কী স্বার্থ ছিল! অপারেটর সাখাওয়াত আজ, কাল, পরশু এভাবেই দিনের পর দিন ঘুরিয়েছে, অপরদিকে উপযুক্ত সময়ে ধানে পানি দিতে ব্যর্থ হলে ফলন শূন্য অর্থাৎ জীবিত মানুষের মরণশূল। অভিনাথ ও বরি মরণের মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছে। শতাব্দীকাল থেকেই আদিবাসী সাঁওতালদের ওপর দমন-পীড়ন নীতি চলে আসছে; রাজশাহী গোদাগাড়ীর নিমঘুটু হচ্ছে এটির সর্বশেষ সংযোজন।
বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রশিদের ভাষ্য, ‘…পানির অভাবে তাঁদের জমির ধান মারা যায়নি। সেই শোকে তাঁরা বিষপান করেছেন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়’। যারা আদিবাসী, পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ শুধু তারাই অনুভব করতে পারে; উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নে এটুকুই বলা যেতে পারে যে, অভিনাথ ও রবির ক্ষোভ, অভিমান, দুঃখ বেদনা একদিনের নয়; অবশ্যই ইতিপূর্বেও রয়েছে অপারেটর সাখাওয়াত কর্তৃক তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা। রয়েছে জমির ধান ফলনের আফসোস ও উপেক্ষার অসহায়ত্ব। প্রকৌশলী রশিদের কণ্ঠে, ‘পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারেটরের কোনো অনিয়ম থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ একইরূপ বক্তব্য দিয়েছেন, গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানে আলমও। তিনি বলেছেন, ‘কীভাবে ঘটনাটি ঘটল, তাঁরা খতিয়ে দেখছেন। অভিযোগ সত্য হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে’। প্রশাসনের প্রতি আদিবাসীদের অনাস্থা যেন বেড়েই চলেছে। ন্যায় বিচারের দাবী না করে হতাশায় ব্যক্ত করেছেন তাদের মা সোহাগী সরেন, লাশের পাশে বসেই বিলাপ করেছেন, ‘আমাদের ওপরে এই অন্যায়ের বিচার করবে কে?’ আত্মীয় সুমিতা টুডুও আক্ষেপে বলেছেন, ‘আমরা কোথাও বিচার পাই না’। প্রশাসনের ‘আইনি ব্যবস্থা’ কী কথার কথাতেই পরিণত হবে নাকি ব্যতয় ঘটবে, সেটিই দেখার বিষয়।
স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায় রোজিনা হেমব্রম নলকূপের অপারেটর ও ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করেছেন। আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহবায়ক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি’র উপস্থিতিতে থানায় মামলা গৃহীত হয়েছে। হলফ করেই বলা যায়, সেদিন মাননীয় সাংসদ যদি না থাকতেন, তাহলে কোনোভাবেই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা এন্ট্রি করতেন না। আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি নিশ্চয়ই এবার কৌশলী হবেন, কৌশল হতে পারে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, নিকটজনদের প্রতি রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি। আদিবাসী সাঁওতালরা নৌকায় ভোট দিলেও তাদের প্রতি ন্যায় বিচারের কণ্ঠ কখনো কখনো একপেশে হয়ে দাঁড়ায়। দলীয় নীতি নৈতিকতার আলোকে যেমন ন্যায় বিচার হওয়া আবশ্যিক, রাষ্ট্রীয় আইনানুযায়ীও একজন নাগরিক হিসেবে আমরা ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করি।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ‘কাপেং ফাউন্ডেশন’র গবেষণায় উঠে এসেছে আদিবাসীদের ওপর নিপীড়নের ভয়ানক চিত্র। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সমতল ও পাহাড়ে মোট ২২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে চারজন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষণের চেষ্টা ছিল ১২টি। অপহরণ, পাচার ও নিগ্রহের ঘটনা ছিল একটি করে। শারীরিক হেনস্তার শিকার হন দু’জন। সব মিলিয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪২টি। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে মোট নিপীড়নের সংখ্যা ছিলো ৬২টি। এরমধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২০টি। আর দুই নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। শারীরিক হেনস্তার শিকার হন ১৬ জন। অপহরণের শিকার হন ছয়জন। আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি, শিশু থেকে শুরু করে নারী নির্যাতনের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর প্রথমত অস্বীকৃতি, মামলা না নেওয়ার প্রবণতা, তদন্ত সৎ ও সুষ্ঠু না হওয়ার মতো অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন হওয়ার তথ্য আমাদের নজরে এসেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর মহাসচিব নূর খান বলেছেন, ‘যে বছরটা অতিক্রম করেছি, সেই বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি এমন একটি জায়গায় উপনীত হয়েছে, সেটি আমাদের সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। একে বর্বরতার সঙ্গে আপনি তুলনা করতে পারেন। এযাবৎকালের মানবাধিকারের সঙ্গে যদি বিবেচনা করেন, তাহলে চরমতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর এটি’।
আমাদের বাংলাদেশ মানব উন্নয়ন সূচক, সুখ ও শান্তির সূচকে এগুলেও সাঁওতালসহ আদিবাসীদের জীবনযাপনে, নিরাপত্তায় কোনো রেখাপাত করতে পারেনি। ইট-পাথরের উন্নয়নের আড়ালে আদিবাসীদের কান্না যেন গুমরে গুমরে ওঠছে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করি—সামান্যতেই তাদের সুখ, অল্পতেই তাদের শান্তি; নিরন্তর শ্রমেই তাদের উন্নয়ন। রাষ্ট্রের প্রয়োজন শুধু তাদের প্রতি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা; ন্যায্য আচরণ করা।
মিথুশিলাক মুরমু : আদিবাসী বিষয়ক গবেষক ও লেখক।