গত আট বছরে সোনালী ব্যাংক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন খুলনার পাট ব্যবসায়ীরা। পাট রফতানির নামে ব্যাংকের ছয়টি শাখা থেকে নেয়া এ ঋণ আর ফেরত দেননি তারা। বিতরণকৃত ঋণের প্রায় সবই এখন মন্দমানে খেলাপি। আদায় করতে না পারলেও খুলনার এ পাট ব্যবসায়ীদের আবার নতুন করে ঋণ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক তদবির ও চাপের কারণেই ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভুঁইফোঁড় অনেক ব্যবসায়ীকে ঋণ দিতে বাধ্য হয় সোনালী ব্যাংক। ঋণ নেয়ার পর অনেক গ্রাহকই ব্যাংকের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি। যে ১১২ পাট ব্যবসায়ীক ঋণ দেয়া হয়েছিল, তাদের ১০৮ জনের ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
এ ১০৮ ব্যবসায়ীর একজন মো. সিরাজুল ইসলাম। পাটের বেপারি থেকে হঠাৎ করেই ২০০৬ সালে রফতানিকারক হয়ে ওঠেন তিনি। ভেজা পাট সরবরাহের কারণে পরিচিতি পান ‘ভেজা সিরাজ’ নামে। গত ১০ বছরে এ ব্যবসায়ী শুধু সোনালী ব্যাংক থেকেই ঋণ নিয়েছেন প্রায় শতকোটি টাকা। ব্যাংকার, রাজনীতিকসহ প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে এ ঋণ বের করে নেন তিনি, যা ভিন্ন খাতে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেয়া এ ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি।
সিরাজুল ইসলামের দাবি, কাঁচা পাট রফতানি বন্ধ থাকার কারণে এ খাতের সব ব্যবসায়ীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে একটি নীতিমালা দিয়েছে। আশা করছি, এর মাধ্যমে আমরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারব। তবে তিনি পাট রফতানির নামে নেয়া ঋণ অন্য খাতে বিনিয়োগের অভিযোগ অ¯^ীকার করেন।
সিরাজুল ইসলামসহ মোট ১১২ জন পাট ব্যবসায়ীকে খুলনায় সোনালী ব্যাংকের ছয়টি শাখা থেকে দেয়া হয় ১ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে খুলনার করপোরেট শাখা, দৌলতপুর কলেজ রোড শাখা ও স্যার ইকবাল রোড শাখার বিতরণকৃত ঋণের প্রায় শতভাগই খেলাপি।
সোনালী ব্যাংকের চলতি বছরের ৩১ আগস্টের তথ্যমতে, ব্যাংকটির খুলনা করপোরেট শাখা কাঁচা পাট রফতানি খাতে ৫২ ব্যবসায়ীকে মোট ৩৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩৮১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এ খাতে শাখাটির বিতরণকৃত ঋণের ৯৯ দশমিক ৪৮ শতাংশই চলে গেছে খেলাপির খাতায়।
মূলত সিসি প্লেজ, সিসি হাইপো, পিসিসি ও ব্লক হিসাবের বিপরীতে কাঁচা পাট রফতানিতে এ ঋণ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৬৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে সিসি প্লেজ হিসাবের বিপরীতে। গুদামে মজুদ পাটের জামানতের বিপরীতে প্লেজ ঋণ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের একাধিক তদন্তে দেখা যায়, কাগজপত্রে থাকা পাটের হিসাবকে মূল ধরে অধিকাংশ প্লেজ ঋণ দেয়া হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসন্ধান করে অনেক গ্রাহকের গুদামেই পাট পায়নি। শূন্য গুদাম জামানত রেখে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লোপাট করা হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তরিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কাঁচা পাট ব্যবসায়ীদের দেয়া ঋণের সিংহভাগই খেলাপি হয়ে গেছে। পাট রফতানি করতে না পারার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি গ্রাহকদের ঋণ ব্লক হিসাবে রেখে নতুন ঋণ দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্তে আগেও কাঁচা পাট রফতানিকারকদের খেলাপি ঋণ ব্লক হিসাবে রেখে নতুন ঋণ দেয়া হয়েছে। সে ঋণও আদায় হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে তা চ‚ড়ান্ত করা হলেও খেলাপি গ্রাহকরা সেটি মানতে নারাজ। তারা আরো সুযোগ-সুবিধা দাবি করছেন।
চলতি বছরের ২ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ’ থেকে কাঁচা পাট রফতানিকারকদের সমস্যা সমাধান বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নীতি ও আর্থিক প্রণোদনা শাখার উপসচিব মৃত্যুঞ্জয় সাহা ¯^াক্ষরিত একটি নির্দেশনাও এতে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, কাঁচা পাট রফতানিকারকদের ৩১ মার্চ ২০১৭ ভিত্তিক ঋণের স্থিতি নিরূপণ করে দুই বছরের মরাটরিয়াম সুবিধাসহ ১০ বছরে পরিশোধের সুযোগ দিয়ে ব্লক হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে। ব্যাংকগুলোর প্রতি আট দফা নির্দেশনাসংবলিত ওই সার্কুলারে ব্লক হিসাবে নেয়া খেলাপি গ্রাহকদের নতুন করে ঋণ প্রদানের নির্দেশ রয়েছে।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) চেয়ারম্যান ও দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ সৈয়দ আলী চলতি বছরের ২৬ ফেব্রæয়ারি অর্থমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে কাঁচা পাট রফতানিকারকদের সব বকেয়া ও দেনা একটি সুদবিহীন ব্লক হিসাবে স্থানান্তরপূর্বক ১০ শতাংশ সহায়ক জামানতের ভিত্তিতে ২৫ বছরে পরিশোধের সুযোগ দাবি করা হয়। এ আবেদন নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানসহ বিজেএ নেতারা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ব্যবসায়ীদের দাবিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক দ্বিমত পোষণ করলে এ নিয়ে দরকষাকষি শুরু হয়। পরে খেলাপি পাট ব্যবসায়ীদের ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ করে দিতে আটটি নির্দেশনা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সোনালী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি শাখার মধ্যে চারটিই খুলনার। এর মধ্যে খুলনার করপোরেট শাখায় ৮১২ কোটি, দৌলতপুর করপোরেট শাখায় ৪৭১ কোটি, দৌলতপুর কলেজ রোড শাখায় ৩৪৩ কোটি ও খালিশপুর শাখায় ৭১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। মোট ১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে এ চার শাখা চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৫৭ কোটি টাকা।