বন্যা প্রাকৃতিক হলেও এর ক্ষয়-ক্ষতির জন্য মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কার্যকলাপও সার্বিক প্রস্তুতির ঘাটতিও কম দায়ী নয়। বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় হঠাৎ বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরও অনেক কারণ রয়েছে। এই বছর এ নিয়ে তৃতীয় দফার বন্যার কবলে পড়েছে এসব জেলা। সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা বলেছেন, বহু বছরের মধ্যে তারা এত মারাত্মক বন্যার মুখোমুখি হননি। সবমিলিয়ে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছিলেন বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছির। নদী গবেষকরা বলেছেন, এবারের এই রকম আকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের অতিবৃষ্টি একটি বড়ো কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপদান কাজ করছে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প মেঘালয়ের পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে উপরে উঠে যায়। সেখানে ভারী হয়ে বৃষ্টি আকারে পড়তে শুরু করে। এছাড়া এই হঠাৎ বন্যার পেছনে চেরাপুঞ্জির এই প্রবল বৃষ্টিপাত প্রধান কারণ। এছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া- জলবায়ু বা বৃষ্টির ধরন বদলে গেছে। এখন বৃষ্টি হলে অনেক গভীর বৃষ্টি হয়।
প্যাসিফিকেও একটা ‘লা নিনো’ আছে। সেটাও অতিবৃষ্টির পেছনে ভ‚মিকা রেখেছে। আসামের চেরাপুঞ্জিতে যখন বৃষ্টি হয়, সেটা ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে তাহিরপুরে আসে। কিন্তু সেখানে এসে পানি তো আর দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে তখন সেটা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যা তৈরি করছে অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের আসামেও বন্যা এবং ভূমিধসের সৃষ্টি হয়েছে। আসামে বরাক ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে গুয়াহাটিসহ অনেক এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এমনকি নদীর পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়।
কিন্তু এবারের বন্যার পেছনে হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বের হতে না পারা প্রধান কারণ বলে বলছেন গবেষকরা। আর এজন্য তারা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন। প্রতি বছর উজান থেকে পানির সাথে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি আসলে সেটা উপচে আশেপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে। নদীর নাব্যতা নষ্টের জন্য ভারত অংশে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনকে দায়ী করছেন গবেষকরা বিশেষ করে ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্যতা সংকট তৈরি হচ্ছে। সেখানে গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি নদীগুলো ঠিকমতো ড্রেজিং না হওয়া, ময়লা-আর্বজনায় নদীল তলদেশ ভরে যাওয়া, ঘরবাড়ি বা নগরায়নের ফলে জলাভ‚মি ভরাট হয়ে যাওয়াটা ভীষণ ভাবে দায়ী।
আর এই কারণে মেঘালয় বা আসামে বেশি বৃষ্টিপাত হলেই সিলেট বা কুড়িগ্রাম এলাকায় বন্যা তৈরি হচ্ছে বলে গবেষকরা মনে করছেন। এবারের হঠাৎ বন্যার পেছনে মানুষের নিজেদের তৈরি বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমনÑসিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভ‚মি যেরকম ছিল, নদীতে নাব্যতা ছিল, এত রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি। ফলে বন্যার পানি এখন নেমে যেতেও সময় লাগে। আগে হয়ত জলাভ‚মি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারত। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট আর আমরা রোড করে ফেলেছি। ফলে পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারনে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে। বিশ্বকে বাসযোগ্য করার দায় উপেক্ষা করে উন্নত রাষ্ট্রগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে মাত্রতিরিক্ত কার্বন নির্গমন করে চলেছে। তাই বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত রাষ্ট্রগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে জোর তৎপরতা চালাতে হবে। অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ফলে মূলত বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যা একটি প্রাকৃতিক বাস্তবতা এবং ভাটির দেশে হিসেবে অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশ দিয়েই নামবে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নদ-নদীদখল সহ নাব্য কমে যাওয়ার ফলে অতিবৃষ্টির পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হয়।
তাপমাত্রা বাড়ার ফলে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ এলোমেলো হয়ে যায়। মৌসুমি বায়ু যতই বিস্তৃত হয় ততই বাড়ে বৃষ্টিপাতের অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বার্ষিক বৃষ্টি দিনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টিপাতের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বৃষ্টিপাতের ধরনও বদলে যাচ্ছে। অল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত অনিয়ন্ত্রিত বন্যায় রূপ নিচ্ছে। ভারতের পানি নীতিও বাংলাদেশের বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভ‚মিকা রাখে। শুষ্ক মৌসুমি বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রাখা এবং বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার ফলে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়। প্রতিবছর বন্যাকালীন জানমাল ও সার্বিক অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যার সময়ে জানমাল ও ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও সমাধানের প্রতি গুরুত্বারোপ করা দরকার। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পতিত হয়। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ও স্বার্ভভৌম ভ‚খÐটির জন্ম হওয়ার পর থেকে বন্যা নামে এই দুুর্যোগটি কম-বেশি প্রতিবছরই এ দেশের জানমালের ক্ষতির কারণ হয়েছে।
গত কয়েকদিনে ব্যাপক বৃষ্টিতে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলও মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ৪০ লাখের বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা ও বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগের ঝুঁকিতে পড়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের মতে বন্যা পরিস্থিতি দ্রæত অবনতি ঘটছে। শ্রাবণ মাস আসতেই বৃষ্টিপাত বাড়তে শুরু করে আর বৃষ্টির পানির সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি বাড়তে শুরু করে। দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমের এই সময়টায় চীন ও ভারত হয়ে বন্যার পানি ও পাহাড়ি ঢল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পৌঁছায়। এই অতিরিক্ত পানির চাপও বন্যার কারণ হয়ে থাকে।
এবারের বন্যার কারণে হাজার হাজার পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছে। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, ব্যাহত হয়েছে লেখাপড়া। শত শত গবাদিপশু মরে গেছে, ফসলের ক্ষেত ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার সঙ্গে অনেক জায়গায় আবার দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। বন্যার এ সময় নদীভাঙনে শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। বন্যা পরবর্তী গৃহহীন মানুষের নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে এবং কৃষকদের জন্য সাহায্য-সহযোগীতার ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমার এড়াতে পারব না। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার যেটুকু সামর্থ্য আমাদের হাতে আছে তার সবটুকু কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদ-নদী এদেশকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ নদ-নদী এখন দখল, দূষণ আর ভরাটের কবলে। কোনো কোনো নদ-নদী ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। কোনোটা আবার মৃতপ্রায়। খাল-বিলসহ সব ধরনের জলাশয় দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে অতিবৃষ্টিতে পানি যাওয়ার পথ থাকছে না। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়াতে নদ-নদীর ড্রেজিং করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
যদিও এ ব্যাপারে সরকার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নদ-নদী, খাল-বিলসহ সব ধরনের জলাশয় পরিকল্পনামাফিক রক্ষা করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলাসহ বন্যার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। বন্যাকালীন ও বন্যা পরবর্তী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়েও পরিকল্পনা থাকা জরুরি। তাৎক্ষণিক সমাধান শুধু নয়, প্রতিবছর হওয়া এ দুর্যোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ও ক্ষয়-ক্ষতি সর্বোচ্চ কমিয়ে আনার পথ খুঁজতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থাকে সম্মিলতি প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক বন্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের দেশে উজান থেকে পানি নামে উত্তর থেকে দক্ষিণে। এই রাস্তাটিও কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণে তৈরি। ফলে এটা হয়ত হাওরের পানি প্রবাহের কিছুটা বাধার তৈরি করছে, কিন্তু বন্যার এটাই একমাত্র কারণ নয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, হাওরে যেসব রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমে তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোই হাওয়ের পানি চলাচলে মূল বাধার তৈরি করছে। এরকম অনেক রাস্তা কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়া তৈরি করা হয়েছে। হাওরে যেসব সড়ক বা উন্নয়ন কর্মকাÐ হচ্ছে, তা পরিকল্পিতভাবে হয়নি। সেটা না হওয়ার কারণেই বন্যা এরকম তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনা হাওর এলাকায় বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোনো কারণে হাওরে বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তা খুব দ্রæত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। কিন্তু হাওরে এসব এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়নি। সেটা করা না হলে বাড়িঘর উঁচু করে তৈরি করতে হবে, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। সেটাও করা হয়নি। ফলে যখন এভাবে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে, সেটার ক্ষয়ক্ষতির অনেক বেশি হচ্ছে। চীনসহ অনেক দেশে স্পঞ্জ সিটি তৈরি করা হচ্ছে। এসব শহরে বন্যা হলে সেই পানি শহরের ভেতরেই জমিয়ে রেখে কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এবার বাংলাদেশে যেভাবে আকস্মিকভাবে বৃষ্টি বা পানির রেকর্ড ভেঙে বন্যা তৈরি হয়েছে, এরকম পরিস্থিতিতে বন্যা ঠেকানো খুব কঠিন।
রায়হান আহমেদ তপাদার