২৭ জানুয়ারি-১৯২২ সালের এ দিনটিতেই সংঘটিত হয়েছিল ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অংশ ঐতিহাসিক সলংগা বিদ্রোহ। ব্রিটিশদের শোষণ আর জিঘাংসার শিকার হয়ে সিরাজগঞ্জের তৎকালীন সলংগা হাটে সেদিন নির্মমভাবে শহিদ হয়েছিলেন হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতা। যাঁদের শাহাদাতের রক্তপিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে ভারতবর্ষ থেকে এক সময় শোষণের হাত গুটাতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা। এবং এই আন্দোলন, সংগ্রামের পথ ধরেই কিছুকাল পরে আমরা পেয়েছি স্বাধীন একটি ভূখ–বাংলাদেশ। পেয়েছি একটি মানচিত্র আর লাল সবুজের পতাকা।
ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সলংগা বিদ্রোহ ও হত্যাকা- অমোচনীয় এক অধ্যায়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে এই অধ্যায় বরাবরই আলোচনার বাইরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের জীবন-বিলানোর তেজস্বী এ সংগ্রামের আখ্যানকে।
সলংগা ছিল তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার বর্ধিষ্ণু একটি বাণিজ্যিক জনপদ। সপ্তাহে দুই দিন বড়ো ধরনের হাট বসত সেখানে। দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীরা এসে পণ্য কেনা-বেচা করতেন স্থানীয়দের সঙ্গে।
তখন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের সময়কাল। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত জনতা দলমত নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন উপমহাদেশের মাটি থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়নের তাগিদে। এরই সূত্র ধরে বিদেশি পণ্য বর্জন করে দেশি পণ্য ব্যবহারের সংগ্রাম শুরু করেন তাঁরা।
তরুণ নেতা মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার সলঙ্গা হাটে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলেরই সন্তান। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ছিল তাঁর বাড়ি। এতদঞ্চলে আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ পণ্য বর্জন ও বেচা-কেনা বন্ধ করতে সাধারণ জনতাকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন দুর্বার আন্দোলন। তাঁদের দাবি ছিল, সলংগার হাটে ব্রিটিশ কোনো পণ্য বেচা-কেনা চলবে না। সলংগার হাট হবে কেবল স্বদেশি পণ্যের হাট।
১৯২২ সালের ২২ জানুয়ারি ছিল শুক্রবার। শুক্রবার সলংগার হাটবার। মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ সিদ্ধান্ত নিলেন এই হাটবার থেকেই বন্ধ করতে হবে বলেতি পণ্যের বেচা-কেনা। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের কর্মীদের নিয়ে তিনি হাটে নামেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় আপামর জনতা। ব্রিটিশদের অনুগত ব্যবসায়ীরা বিলেতি পণ্য বর্জনে অস্বীকৃতি জানায়। খবর যায় স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে। তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে লাল পাগড়িধারী পুলিশের সশস্ত্র এক ফোর্স। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন তদানীন্তন পাবনা জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট আরএন দাস এবং জেলা পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা-প্রশাসক এসকে সিনহা।
পুলিশের সংখ্যা ছিল ৪০ জন। কিন্তু প্রত্যেকেই রাইফেলধারী। অপরদিকে জনতার সংখ্যা ছিল অগুণতি। কিন্তু সকলেই নিরস্ত্র।
সলংগা হাটের গো-হাটায় ছিল বিপ্লবী স্বদেশিদের অফিস। মাওলানা তর্কবাগীশ তখন অফিসেই ছিলেন। পুলিশ স্বদেশিদের অফিস ঘেরাও করে তর্কবাগীশকে গ্রেপ্তার করে। আর এতেই খেপে যায় আপামর জনতা। তারা অফিসের বাইরে অবস্থান নিয়ে নিজেদের প্রাণপ্রিয় নেতার মুক্তির দাবিতে মুহুর্মুহু শ্লোগান দিতে থাকে। ব্রিটিশদের অনুগত লালপাগড়িধারী হিন্দু পুলিশ বাহিনীর প্রতি তাদের প্রচ- আক্রোশ ঝরে পড়ে শ্লোগানে শ্লোগানে।
ম্যাজিস্ট্র্যাট নির্বিচারে গুলির নির্দেশ দেন ফোর্সকে। ৪০টি রাইফেলের ৩৯টিই সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে। প্রতিবাদী জনতাকে লক্ষ বানিয়ে অনবরত চলতে থাকে গুলিবর্ষণ। যে রাইফেলটি গুলিবর্ষণ থেকে বিরত ছিল, তা ছিল একজন বাঙালি পুলিশের। ব্রিটিশের গোলামি করলেও এ পুলিশ সদস্যটি নিজের মাটির সঙ্গে গাদ্দারি করতে পারেননি সেদিন। বিবেক হয়ত তাঁকে বিরত রেখেছিল।
বাকি ৩৯টি রাইফেলের নির্বিচার গুলি বর্ষণে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাজা রক্ত আর নিথর লাশের স্তূপ জমে যায় সলংগার হাটে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত জনতা নিজেদের দাবি থেকে তারপরও একচুল সরেনি।
ঐ দিন প্রায় ১২০০ প্রতিবাদী মানুষ ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায়। আহত হয় ৪০০০-এরও বেশি। নিহতদের লাশের সাথে সংজ্ঞাহীন আহতদের উঠিয়ে নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ সিরাজগঞ্জের রহমতগঞ্জে গণকবর দেয়।
সলঙ্গা হাটের হত্যাকা-ের ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের চেয়ে বহুগুণ ভয়ংকর নৃশংস। অথচ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তথা শতাব্দির গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনা অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে চাপা পড়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯২২ সালের বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সলঙ্গা হত্যাকা-ের ঘটনা যেমন সবচেয়ে নৃশংস পাশবিক তেমনি নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক।
সেদিন সলঙ্গা হাটে নিরপরাধ জনতা ছিলেন নিরস্ত্র। তবে তাদের বুকে ছিল স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা, চোখে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন আর চেতনা। পুলিশ মদের দোকানের কাছে অবস্থান নেয় এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে আন্দোলনকারী এবং সাধারণ হাটুরে জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে কাপুরুষের মতো। ৩৯টি রাইফেলের নির্বিচার গুলি বর্ষণে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাজা রক্ত আর নিথর লাশের স্তূপ জমে যায় সলংগার হাটে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত জনতা নিজেদের দাবি থেকে তারপরও একচুল সরেনি। ব্রিটিশদের গ্রেপ্তারিতে রেখে যেতে চায়নি তাদের নেতাকে। সংবাদপত্রের উপর সে সময় বৃটিশদের কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, নায়ক এবং অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় বহুদিন ধরে সলঙ্গা হত্যাকা-ের খবর এবং সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
আজ প্রায় ১০০ বছর পর আজকের প্রজন্মের নিকট নতুন ও বিস্ময়কর মনে হতে পারে। এটা স্বাভাবিক কারণ তৎকালিন সেদিন পাবনা জেলার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা) সলঙ্গার হাটের যে গণ বিদ্রোহ ও হত্যাকা- ঘটেছিল তা নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। উপমহাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে পড়লে মনে হবে বাঙালি মুসলমানের তেমন কোনো অবদান নেই বললেই চলে। রহস্যজনকভাবে মুসলমানদের বীরোচিত কাহিনী বারবার এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও মুছেও ফেলা হয়েছে। ফলে দুঃখজনকভাবে সলঙ্গার ঘটনাটি ইতিহাসের ধুলায় চাপা পড়ে গেছে।
সলঙ্গা বিদ্রোহ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত লড়িয়ে দিয়েছিলেন। সলঙ্গার রক্তসিক্ত বিদ্রোহ শুধু বাংলার মাটিকে সিক্ত করেনি, সিক্ত করেছে সমগ্র উপমহাদেশ। যে রক্তে ভেজা পিচ্ছিল পথে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাতে সলঙ্গা বিদ্রোহের অবদান অনদ্বীকাট। সলঙ্গা বিদ্রোহে শহীদদের অমর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।