বড়দিন, বড়দিন, বড়দিন, দিনটি আসলে বড় নয়। কিন্তু এটি একটি আনন্দের দিন, আর সেই আনন্দ, সমস্ত মানব জাতির জন্য। এই আনন্দ হল পরিত্রাণের আনন্দ। শুভ বড়দিন হল যীশু খ্রিস্টের জন্মদিবস উপলক্ষে উদ্যাপিত বার্ষিক খ্রিস্টান উৎসব, যা বিশ্বব্যাপী ২৫ ডিসেম্বর পালিত হয়। যদিও ২৫ ডিসেম্বরের ঐতিহ্যবাহী তারিখটি ২৭৩ অ.উ (অহহড় উড়সরহর) হতে এখনো বর্তমান। সূর্যকে সম্মানকারী দুটি পৌত্তলিক উৎসবও সেদিন উদযাপিত হয়েছিল এবং সম্ভবত ২৫ ডিসেম্বর পৌত্তলিকতার প্রভাব প্রতিহত করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। আজ অবধি কিছু লোকেরা শুভ বড়দিন নিয়ে অস্বস্তি বোধ করে কারণ তারা মনে করে যে সেদিনে অনুষ্ঠিত পৌত্তলিক উৎসবগুলি এটিকে কোনোভাবে কলঙ্কিত করেছে। তবে খ্রিস্টানরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করেছেন যে সুসমাচার কেবল সংস্কৃতিকে ছাড়িয়ে যায় না, এটি রূপান্তর করে। A.D. ৩২০-এ একজন ধর্মতত্ত্ববিদ এই সমালোচনার জবাব দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমরা এই দিনটিকে পবিত্র হিসাবে গ্রহণ করি, সূর্যের জন্মের কারণে পৌত্তলিকদের মতো নয়, যিনি সূর্যকে তৈরি করেছিলেন তাঁর কারণে।’’ (এই বিষয়বস্তুটি ড্যান গ্রাভসের ‘ Christmas Eve’ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।)
অপরদিকে, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বাইবেল ও খ্রীষ্টধর্ম বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দিনে আমাদের মুক্তিদাতা প্রভু যীশু খ্রীষ্ট স্বর্গধাম থেকে মানব জাতিকে পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য ধরাধামে নেমে এলেন এবং আমাদের মতো অধম পাপীদেরকে ত্বরালেন। এই দিনটিতে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকা বড় বিষয় নয়, এটি তখনই স্বার্থক হবে যখন আমরা আমাদের মুক্তিদাতা প্রভু যীশুকে আমাদের এই ছোট গোশালায় (হৃদয়ে) স্থান দিতে পারব।
কেন প্রভু যীশু খ্রীষ্ট এ জগতে এসেছিলেন?
প্রভু যীশু খ্রীষ্ট স্বর্গীয় রাজ সিংহাসন ছেড়ে, এই পৃথিবীর পাপী মানুষকে ভালোবেসে, পাপীদের খোঁজে, পাপীদের কাছে এসেছিলেন তাঁর পরিত্রাণের বার্তা নিয়ে। তিনি পাপীদের জানিয়েছেন স্বর্গরাজ্যের কথা, পথ দেখিয়েছেন নতুন জীবনের ও নতুন সমাজের।
তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন প্রেমের অমৃত বাণী। তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন প্রেমের অমৃত বাণী। তিনি বিশ্বের প্রত্যেকটি পাপী মানুষকে জানিয়েছেন তাঁকে অনুসরণ করার আমন্ত্রণ।
যীশু খ্রীষ্টের জন্ম কীভাবে হয়েছিল?
আজ থেকে প্রায় ২০১৮ বছর পূর্বে যীশু খ্রীষ্ট প্যালেস্টাইন দেশে জন্ম গ্রহণ করেন। ঐ সময়ে সেই দেশের লোকেরা খুব কষ্টভোগ করছিল, আর ঈশ্বরের লোকের বিদেশী রোমীয় শাসকদের আইন-কানুন মেনে চলতে হত। তারা অপেক্ষা করছিল ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞার বিষয়ে কারণ তিনি তাদের পূর্ব পুরুষদের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাদের জন্য একজন রাজা দিবেন। ঈশ্বর সেই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করার জন্য মরিয়ম নামক একজন কুমারীর কাছে গাব্রিয়েল দূতকে পাঠালেন।
গাব্রিয়েল দূতের কথানুসারে পবিত্র আত্মার মাধ্যমে মরিয়মের গর্ভ হলো এবং ঈশ্বর তনয় ঈশ্বরের নিরূপিত সময়ে এই পৃথিবীতে আসলেন।
বড়দিনের আনন্দ
যীশু খ্রীষ্টের জন্ম এক দিকে আনন্দের দিন, অপরদিকে দুঃখ-কষ্টের দিন। পবিত্র বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে যে, খ্রীষ্টের জন্মের সময়ে রাজা হেরোদ দুই বছরের নিচে যত বালক ছিল সকলকেই হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন এবং তার আদেশ সৈন্যরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। এখন ভাবুন এই মর্মান্তিক অবস্থা! কত মায়ের কোল যে খালি হয়েছিল তার পরিসংখ্যান আমার জানা নেই কিন্তু ঘরে ঘরে যে আর্তনাদ, হাহাকার, ক্রন্দন ছিল তা বলাই বাহুল্য। এই দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও কিন্তু অনেকে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন তা লক্ষণীয়।
প্রথমত : আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন মরিয়ম, কারণ তিনি হবেন জগতের ত্রাণকর্তার মাতা (লূক ১: ৪৫-৪৭) ;
দ্বিতীয়ত : আনন্দ করেছিল মরিয়মের জ্ঞাতী ইলিশাবেৎ ও তাঁর জঠরের সন্তান যোহন বাপ্তাইজক। কেননা যীশুর সংবাদে যোহন মাতৃগর্ভে নেচে উঠেছিলেন এবং ইলিশাবেৎ আনন্দে মরিয়মকে প্রভুর মাতা বলে সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন ( লূক ১:৪২-৪৩)
তৃতীয়ত : মাঠের রাখালেরা স্বর্গদূতের মুখে যীশুর জন্মের সংবাদ শুনে আনন্দে মেতে উঠেছিলেন এবং যীশুর পায়ে প্রণাম জানিয়েছিলেন (লূক ২:৮-২০)
চতুর্থত : পূর্ব দেশের পণ্ডিতবর্গ। আকাশের তারা গণনা করে যীশুর জন্মের সংবাদ জানতে পেরেছিলেন এবং যীশুর নিকটে এসে আপনাদের ধনকোষ খুলে তাঁকে মূল্যবান উপহার সামগ্রী দিয়ে প্রণাম জানিয়েছিলেন ( মথি ২:১১-১২)।
খ্রীষ্টেতে প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা, আজ পণ্ডিতবর্গ দামি উপহার দিয়ে প্রণাম জানিয়েছেন যীশুর ঐ রাঙ্গা চরণে। আজ আমরা প্রভু যীশুর চরণে কী উপহার দিব?
বড়দিনের আনন্দ তখনই স্বার্থক হবে যখন যীশুকে আমাদের ছোট গোশালায় (হৃদয়ে) স্থান দিতে পারব।
তাই আসুন, এই বড়দিনে আপনি/আমি আমরা সকলেই যীশুর চরণ কমলে আমাদের হৃদয়কে উৎসর্গ করি এবং প্রভুকে বলি, প্রভু এই তো আমরা তোমার অধম সন্তানেরা, আমাদের জীবনে তোমার কী পরিকল্পনা তা তুমি কর ‘প্রকাশ’।
কেন আমরা ২৫ শে ডিসেম্বর উদযাপন করব?
আমরা কেন বড়দিনের জন্য ২৫ শে ডিসেম্বর তারিখটি ব্যবহার করি তার জন্য দুটি নির্দিষ্ট তত্ত্ব রয়েছে।
প্রথমত, সেই দিনের লোকেরা এবং ধর্মগুলি কিছু সময়ের কাছাকাছি এক ধরনের ছুটি উদযাপন করেছিল। ইহুদি চানুকাহ থেকে প্যাগান শীতের সল্টিস থেকে জার্মানি ইউলে থেকে রোমান ডিয়েস নাটালিস সোলিস ইনভিটি (অবিচ্ছিন্ন সূর্যের জন্ম); গাছ, সাজসজ্জা, ইউল লগ, বিবিধ এবং উৎসব সহ উদযাপনের দিনগুলির সংখ্যার উল্লেখ করা মনে হয় যে খ্রিস্টানরা পাল্টা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসাবে যীশুর জন্মকে যুক্ত করেছিল এবং সম্ভবত পৌত্তলিক ছুটির দিনগুলির প্রথমদিকে পালিয়ে যায় বিশ্বাসী।
২৫ ডিসেম্বর ছিল মুক্তি, উপহার প্রদান এবং দীর্ঘতম রাতের পরে আলোর বিজয়ের শনিবার উৎসব। খ্রিস্টান এই পৌত্তলিক ঐতিহ্যের মধ্যে সত্যকে অন্তর্নিহিত দেখায় যা প্রতিফলিত হয়: খ্রিস্ট জগতের আলো, লূক ১ :৭৮-৭৯ পদে লেখা আছে: ‘‘কারণ আমাদের ঈশ্বরের দয়া ও করুণার উর্ধ্ব থেকে এক নতুন দিনের ভোরের আলো আমাদের ওপর ঝরে পড়বে। যাঁরা অন্ধকার ও মৃত্যুর ছায়ায় বসে আছে তাদের ওপর সেই আলো এসে পড়বে; আর তা আমাদের শান্তির পথে পরিচালিত করবে।’’
দ্বিতীয় তত্ত্বটি ২৫ শে মার্চ পশ্চিমা গির্জার দ্বারা মরিয়মের গর্ভে যীশুর জন্মের ঘোষণা বা নিষ্কলুষ ধারণা হিসাবে ‘গৃহীত’ তারিখের কেন্দ্রস্থলকে কেন্দ্র করে। ২৫ ডিসেম্বর ৯ মাস পরে এবং এইভাবে যীশুর জন্মদিন হিসাবে উদযাপিত। তারিখের সম্ভাব্য কারণ নির্বিশেষে, কনস্টান্টাইন রাজত্বকালে গির্জার ক্যালেন্ডার পশ্চিমে স্থাপন করা হয়েছিল, যখন পূর্বে গির্জাটি কিছু সময়ের জন্য জানুয়ারির ৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ক্রিসমাস বা বড়দিন উপলক্ষে আমাদের ত্রাণকর্তা প্রভু যীশু খ্রীষ্টের জন্য কী কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত?
সারা পৃথিবীব্যাপী শুরু হয়েছে ক্রিসমাস বা বড়দিন পালনের প্রস্তুতির মাস। অন্যান্য বছরের মতো এই বছর ক্রিসমাসের উৎসবটা মনে হয় খুব একটা জাঁকজমক হবে না। কারণ সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী গত এক বছর মহামারি করোনা রোগের আক্রমনে সব কিছু লন্ডভন্ড। ইতিমধ্যে কয়েক লক্ষ মানুষ এই মহামারি রোগের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে এবং এখনো মৃত্যু চলছেই। পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক পরিস্থিতি। লক্ষ লক্ষ লোক বেকার। এই রকম পরিস্থতিতে ক্রিমমাস পালন যে কতটা ভালো হবে তা এখন দেখার বিষয়। পরম করুণাময় ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ যে এই রোগে মৃত্যুর হার মাত্র ২%। তার এই অশেষ দয়ার কারণে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের জন্ম দিন উপলক্ষে আমাদের খ্রীষ্টানদের কাজ কী কী করা উচিত? সাধারণত ক্রিসমাস বা বড়দিন উপলক্ষে সবাই চেষ্টা করে বাহ্যিকভাবে নিজেকে একটু আলাদাভাবে তৈরি করতে। তারপরে চেষ্টা করে ঘর-বাড়িতে নতুনত্ব আনার। সবার নজর থাকে সান্তা ক্লজ, নতুন নতুন কাপড়-চোপড় এবং উপহারের দিকে। আর ক্রিমাস বা বড়দিনের কেক ছাড়া তো বড়দিন পালন হবে এটা কি হয়? এ তো গেল বাহ্যিক প্রস্তুতি। কিন্তু আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির কথা কি আমরা চিন্তা করি? আসলে কীভাবে আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি আমাদের নেওয়া উচিত? পবিত্র বাইবেল অনুসারে মানবজাতিকে পূণ্যের পথে পরিচালিত করার জন্য যীশু খ্রীষ্ট ঈশ্বর রূপে এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। যীশু খ্রীষ্টের জন্মের বহু বছর আগে থেকেই তাঁর এই আগমন বার্তা বিভিন্ন ভাববাদী মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছিলেন। পবিত্র বাইবেলের রোমীয় ৩ অধ্যায়ে আরে বলা আছে যে, জগতে সকল মানুষ পাপ করেছে। তাই এদেরকে পাপ থেকে উদ্ধার করবে কে? কোনো পাপী মানুষ অন্য কোনো পাপী মানুষকে উদ্ধার করতে পারে না। তাই এর জন্য প্রয়োজন একজন নিষ্পাপ লোকের। আর সেই একমাত্র নিষ্পাপ লোকটি হলো আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্ট। কারণ পবিত্র বাইবেল বলে তিনি জীবনে কোনোদিন পাপ করেনি। তার অনেক ক্ষমতা ছিল কিন্তু তারপরেও তিনি ক্ষমতার কোনো অপব্যবহার করেনি। তিনি তার পিতা ঈশ্বরের শক্তিকে ভালো কাজে ব্যবহার করেছিলেন। আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্ট চান আমরা পাপী হলেও কেউ যেন নরকে না যাই। তাই তিনি এই পৃথিবীতে আগমন করে আমাদের সবাইকে পাপ থেকে মন পরিবর্তনের সুযোগ দিয়েছেন। তার জন্ম হয়েছিল অলৌকিকভাবে পবিত্র আত্মার শক্তিতে কুমারী মারীয়ার গর্ভে। যা মানুষের পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব নয় তা ঈশ্বর পক্ষে সত্যি সম্ভব। তাই তার এই আশ্চর্য রূপে পৃথিবীতে আগমনের বার্তাই হলো আমাদের সবাইকে পাপ থেকে মন পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা সবাই কি সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছি? আসলে সত্যি কথা বলতে কি আমাদের প্রত্যেকেরই ক্রিসমাস বা বড়দিন উপলক্ষে এই আত্থ্যাধিক প্রস্তুতিটাই সর্বপ্রথম নেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা বেশির ভাগ মানুষ এই প্রস্তুতিটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বাহ্যিক প্রস্তুতিটাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি যা মেটেই ঠিক নয়। আমরা যদি আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিকে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিয়ে ক্রিসমাস বা বড়দিন পালন করি তাহলে পরম করুণাম ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি খুশি হয়ে আমাদের অনেক আর্শিবাদ বর্ষিত করবেন। আসুন আমরা সবাই খ্রীষ্ট ভক্তগণ সেভাবে ক্রিসমাস বা বড়দিন পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। আমেন…