১৮ই অক্টোবর নাচোল বিদ্রোহের প্রধান পুরোধা সাঁওতালদের রাণীমাতা খ্যাত ইলামিত্র’র জন্মবাষির্কী পালিত হচ্ছে নাচোলে। তাঁর জন্মবাষির্কীতে সাঁওতাল, উরাঁও, মাহালী, মুণ্ডাসহ স্থানীয় অধিবাসীরা উপস্থিত থাকছেন। এই নাচোল থেকেই একজন সাঁওতাল নেতা আমার কাছে ফোন করে ইলামিত্রের অনেক ইতিহাস জানতে চেয়েছিলেন, কারণ সেদিন তাঁকে ইলামিত্র সম্পর্কে দু-চারটি কথা বলতে বলা হয়েছিল। টেলিফোনেই অনেক তথ্য দিয়েছিলাম, অনেক তথ্যই প্রদান করা সম্ভবপর হয়নি। তাই তো বিবেকের দায়বদ্ধতায় ইতিহাস থেকে কিছু তথ্য তুলে দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।
নাচোল বিদ্রোহের শৌর্যবীর্যের চেয়ে অত্যাচার, নির্যাতনের কাহিনী অত্যন্ত দুঃখজনক এবং মর্মর্স্পী। বিদ্রোহের নায়িকা ইলা মিত্র ধরা পড়লে তাঁকে মুখোমুখী হতে হয়েছে কঠিন নরক যন্ত্রণার। তার সেই অবর্ণনীয় ঘটনাগুলোর সন্ধান পাওয়া যায় আদালতে দেওয়া জবানবন্দি থেকে। ইংরেজি লেখা তাঁর বক্তব্যটি এখানে হুবহু তুলে দেওয়া হলো—‘‘I am innocent. I know nothing about this case. I was arrested on 7.1.50 at Rahanpur. On the morning of 8.1.50 I was carried at the Nachole police station from Rahanpur. As soon as I arrived at the Nachole police station the constable put me into the thana cell keeping on assulting. When I was put into cell, the officer in charge told me ‘you willl have confees everything about the murder otherwise you will be made nacked’. I replied nothing. Then I was kept in the cell in absolutely nacked condition having taken away my cloth, boluse and pattycoat. I was not given any food even I was not given water to drink on that day i.e. 8.1.50 the constables injured on my head by the gun to get words from me. The officer in charge was present infront of the cell. Than there was profuse bleeding from my nose, but I did not speak anything. I was given cloth in the afternoon to put on that day about 12 o. Clock at night I was brought to probably in the quarter to the Daroga sabid from the cell, it may be any other house. To extract a confession from me. I was pressed with bamboo my leg. They told, ‘you are given Pakistani injection.’ At that time my mouth was tied up with napkin. At that time I did not speek anything. My hair was torn up I was again put into the cell as I did not speak anything. The constable took my by hoding to gether I could not walk due to bamboo pressing. After taking me into the cell on that night Daroga told the sepoys. As she has not yet spoken bring four boiled eggs then she must confess. The 4 or 5 sepoys made me lie flat and one pushed on boiled egg into my private parts. Than I fell some burning sensation and become senseless. On 9.1.50 towards the nursing I regain my sense and the Daroga and a few constables againcome before the cell. The Daroga said ‘you will still say nothing and gave me a kick on my belly with his boot but I said nothing, ‘Then a nail was put into my right toe, even than I said nothing. From that time I remained in half concious state & fell flat. At that time the Daroga said, I am again coming at nitht if even at that time you do not speak then you will be raped by constable one after another. Then at that night (9.1.50) Daroga and a few sepoys come before the cell at dead of night. In order to extract a confession from me they again threatend me with rape. I said nothing. At that time really 3 or 4 constable held me and one begain to rape me. I said nothings. After a while I become senseless. Next day i.e. on 10.1.50 in the morming I regained my sense and found my private parts bleeding profusely. The cloth was entirely smeared with blood. That day (10.1.50) I was brought of Nawabgonj from Nachole police station. As soon as I entered the gate the sepoys gave me slapping on my cheek. As I was unable to move at that time the court inspector and a few constable carried me into the cell. At that time I was laid up with fever and still there was haemorhage then doctor of the place i.e. the government doctor come and took my temperatiure which counted 105. I told him about the bleeding when he replied tomorrow you will be examined by a lady doctor and then the treatment will follow. From that time I am given medicine for fever etc. I was suppllied with two blankest at night. On the morning of 11.1.50 lady nurse of the government hospital examined my internal parts but I do not know what report she submitted. At that time the cloth which was smeared with blood was taken away and a clean cloth was given. From that time I was living in the cell and was under the treatment of the medical officer of Nawabgonj. In the mean time there was senseless bleeding and the temparature was high all the time and occassionally I am told that I would be taken else where. I replied, I am very much unless and unable to go then. I was assulted with lathis by the sepoys and taken to the stretcher and was brought to another house. I did not say anything even there. The sepoys took my signature by force on a plain paper. At that time I had high temparature and was in half conscious form journey is my conditions form began to grow worse. Then on 7.1.50 I was kept in the local government hospital and from there on 21.1.50 I was brought of Rajshahi Central Jail by a stretcher and was kept there in hospital I did not speak any thing in any circumstance. I shall not adduce and evidence. No female guard of warder was kept with me from 7.1.50 till prior to my coming to Rajshahi jail i. e upto 21.1.50. Sd/ Ila Mitra. ’’
এই কিংবদন্তি নেত্রী ১৯২৫ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম থেকেই অন্যায়-অন্যায্য ও অধিকারহারাদের সাথে লড়েছেন, সংগ্রাম করেছেন জীবনভর। নাচোল বিদ্রোহের সময়কালে ধৃত নেত্রী সরকারের পুলিশ বাহিনীর শত নির্যাতন, অত্যাচারের মুখে কখনো মুখ খুলেননি। নির্ভিক ও দৃঢ়চিত্তে সমস্ত বর্বরতাকে পরাজিত করেছেন। জানা যায়, ইলা মিত্রসহ ২৩ জনকে আসামী করে নাচোল থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল যা পরবর্তীতে বিজ্ঞ দায়রা জজ রাজশাহীতে বিচারের জন্য সেশন কমিট হয় যা সেশন কেস নম্বর ১/৫১ (জানুয়ারি) এবং ১/৫২ (জুলাই) নম্বরে লিপিবদ্ধ হয়। যার ধারা যথাক্রমে—১৪৭/৩০২/১৪৯/৩৩৩/ পি.পি.সি এবং ধারা ১৪৭/৩০৪/পার্ট ১/১৪৯/৩৩৩/৩৪ পি.পি.সি। এ দুটি সেশন কেসই পাশাপাশি বিচার নিষ্পন্ন হয় বিজ্ঞ বিচারিক আদালতে। বিজ্ঞ দায়রা জজের নাম ছিল এস আহমেদ। মামলা সেশন এ কমিট করেন বিজ্ঞ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ মিয়া। মামলার বাদি ক্রাউন নবাম আসামী যথাক্রমে ইলা মিত্র, অনিমেষ লাহিড়ী ওরফে সাগর বাবু, আজাহার শেখ, বৃন্দাবন সাহা, শুকরা কামার ওরফে শুকচাদ কামার, রবি কর্মকার, রঙ্গ মাঝি ওরফে রঙ্গা সরেন, দেওয়ানি রায়, সুখ বিলাশ সিং, চুতার মাঝি, ইন্দু মাঝি, চুনুর মাঝি, ভাদু মণ্ডল ওরফে ভাদু বর্মণ, দুখু মণ্ডল ওরফে দুখা সরেন, উপেন কোচ, মঙ্গলা, ইন্দ্রিয়া মুরমু ওরফে ইন্দ্রা মুরুম, রিনা বর্মন ওরফে খোকা, ভুটু মাঝি, কালু রায়, স্টিফেন মারডি ওরফে গোপাল মার্ডি, গোপল চন্দ্র সিং ও সুমাই সরেন।
এই মামলায় বিজ্ঞ দায়রা জজকে বিচার কাজে সহায়তা করেন নিম্নে উল্লেখিত ৯ জন জুরি—
রাজশাহী কলেজের প্রফেসর সৈয়দ আহমেদ, ভোলাহাট হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক বাবু গজেন্দ্রনাথ দাস, নওগাঁর ধামুইরহাট থানার দেবীপুরের জাফর উদ্দীন ম-ল, নবাবগঞ্জ শঙ্করবাটি এম ই. স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান, রাজশাহী চারঘাট থানার বাউশার আব্দুল মজিদ সরকার, নওগাঁর পোরশা থানার পারইলের আব্দুল রহমান শাহ চৌধুরী, চশনাজিরপুর হাই মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক সাজেদুর রহমান, রাজশাহীর চারঘাট আড়ানীর সহকারী শিক্ষক বাবু জিতেন্দ্রনাথ অধিকারী, ও জসীম উদ্দিন আকন্দ, শিক্ষক, ভাঙ্গাইল হাইস্কুল নওগাঁ। উল্লেখ্য, সমাজে যারা এলাকায় ভালো মানুষ ও বিচক্ষণ তেমন ব্যক্তিদের নিয়ে জুরি বোর্ড গঠন করা হতো।
ওই মামলায় আন্দুল আজিজ প্রসিকিউটর হিসেবে ক্রাউন অর্থাৎ রাষ্ট্র পক্ষে ছিলেন। অপরদিকে অভিযুক্তদের পক্ষে ছিলেন বিজ্ঞ আইনজীবী বাবু বীরেন্দ্রনাথ সরকার, প্লিডার; ওয়াই কামাল, কাউন্সেল ও নরেন্দ্রনাথ মুন্সি, কাউন্সেল। পাশপাশি উপরেউল্লেখিত আরেকটি সেশন কেস নম্বর ১/৫২ (জুলাই) মামলার কিছু উপাত্ত উল্লেখ করা হলো—এই মামলায় ২১ জন আসামীভুক্ত ছিলেন। তারা হলেন যথাক্রমে ইলা মিত্র, অমিনেশ লাহিড়ী ওরফে সাগর বাবু, আজাহার শেখ, বৃন্দাবন সাহা, সুক্রা কর্মকার ওরফে সুকচান্দ কর্মকার, রবি কর্মকার, রংগা মাঝি ওরফে রঙ্গা সরেন, দেওয়ানি রায়, সুখবিলাস সিং, চুতার মাঝি, চুনু মাঝি, ভাদু মণ্ডল ওরফে বর্মণ, দুখু মাঝি ওরফে দুখু সরেন, উপেন কোচ, মংলা মণ্ডল, ইন্দ্রিয়া মুরমু ওরফে ইন্দু মুরমু ওরফে তেনু মাঝি, সুরেন বর্মণ ওরফে খোকা, ভুটান কিস্কু ওরফে ভুটান মাঝি, গোপাল মারাণ্ডি ওরফে স্টিফেন মারডি, গোপালচন্দ্র সিং ও সুমাই সরেন। এই সেশন কেসের ৭ জন জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন—রাজশাহী কলেজের প্রফেসর ড. কিয়ামউদ্দিন, রাজশাহীর চারঘাট বাউসার শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুল জলিল, নওগাঁর বদলগাছি থানার ভাণ্ডারপুরের মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার ডা. ঘাসির উদ্দিন, নওগাঁর চাক্তা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হাদেস আলি, রাজশাহীর চারঘাট থানার আলাইপুরের মাজদার রহমান খান, নাটোরের বাসুদেবপুর হাইস্কুলের শিক্ষক মোসলেম উদ্দিন আহমেদ ও রাজশাহী কলেজের প্রফেসর আব্দুল জাব্বার। এই মামলায় ক্রাউন পক্ষে পিপি ছিলেন আব্দুল আজিজ খান, বিজ্ঞ প্লিডার এবং তাকে সহায়তা করেন হাজী নিজাম উলমূলক চৌধুরী, বিজ্ঞ প্লিডার। আসামীগণের পক্ষের বিজ্ঞ ল-ইয়ার ছিলেন কামিনি কে দত্ত এবং তৎসহ অ্যাডভোকেট নরেন্দ্রনাথ মুন্সি এবং অ্যাডভোকেট বীরেন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখ। এই মামলায় ২১ জন অভিযুক্তের মধ্যে জুরিগণের মতামত এবং গৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণ পর্যালোচনাপূর্বক ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও জরিমানার আদেশ দেন বিজ্ঞ ট্রায়াল আদালত এবং ৫ জন খালাস পান। খালাস প্রাপ্তরা হলেন—চুতার মাঝি, দুখা মাঝি ওরফে দুখা সরেন, গোপাল মারডি ওরফে স্টিফেন মারডি, গোপাল চন্দ্র সিং ও সুমাই সরেন।
বিচারিক আদালতে বিজ্ঞ দায়রা জজ ছিলেন এস আহমেদ। রায় ঘোষণার তারিখ ৫ আগস্ট ১৯৫২। আলোচিত অপর সেশন কেস নম্বর ১/৫১ (জানুয়ারি) মামলায় বিজ্ঞ বিচারক অভিযুক্ত ইলা মিত্রসহ ২৩ জন আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন। আদালত দ.বি আইনের ৩০২/১৪৯ ধারায় উক্ত সাজা প্রদান করেন এবং অন্যান্য যথা ১৪৭/৩৩৩/৩৪ ধারায় পৃথক কোনো সাজা প্রদান করেননি। কারণ সর্বোচ্চ সাজা ভোগের আদেশ ৩০২/ ১৪৯ ধারায় প্রদান করেছেন। এই মামলায় রায়ে ঘোষণার তারিখ ১১ জানুয়ারি ১৯৫১। বিজ্ঞ দায়রা জজের ঘোষিত রায় বিক্ষুব্ধ ২৩ জন আসামী মহামান্য ইন দি কোর্ট অব জুডিকেচার অ্যাট ঢাকা ইন ইস্ট বেঙ্গল সমীপে আপিল নম্বর ১৭৬/১৯৫১ আনয়ন করেন এবং মাননীয় বিচারপতি জাস্টিস ইলিস এবং বিচারপতি জাস্টিস ইস্পাহানী আপিল গ্রহণপূর্বক কেসটি বিজ্ঞ নিম্ন আদালতে রিমান্ডে দেন পুনবির্চারের জন্য। বিজ্ঞ বিচারপতিদ্বয় সকল আসামিকে প্রদত্ত সাজার আদেশ সেট অ্যাসাইড করেন এবং সকল আসামিকে জামিনে মুক্তির আদেশ দেন মামলা নিস্পত্তি তক। আপিলের আদেশ হয় ৩ এপ্রিল ১৯৫২। আপিল মামলায় আপিলকারীদের পক্ষে আইনজীবী নিযুক্ত ছিলেন অ্যাডভোকেট দীনেশচন্দ্র রায় ও অ্যাডভোকেট বীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী। দি ক্রাউন পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট জেনারেল এ কে ফযলুল হক ও আবু মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ।
ঘটনার বিবরণ একটু সংক্ষেপে বর্ণনা না করলে বস্তুগত ত্রুটি থেকে যাবে। তাই বিস্ময়কর নাচোল এলাকায় সেই ১৯৫০ সালের ঘটনাটির সংক্ষেপে বর্ণনা দেওয়া হলো—নাচোলের তেভাগা আন্দোলন ছিল একটি গণ আন্দোলন। ভুখা-নাঙ্গা, আদিবাসী কৃষক জনগোষ্ঠীর এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন ইলা মিত্র। জোতদার ভূমিগ্রাসী মানুষের বিপক্ষে ইলা মিত্রের নেতৃত্বে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে তা একটি সমাজ পরিবর্তনের বিদ্রোহে রূপ নেয়। অন্তত ২৫০-৩০০ মানুষের সাথে পুলিশের এই পুলিশ এর সাথে থাকা স্বার্থন্বেষী মহলও এই বিদ্রোহী কৃষকদের সাথে যে বিরোধজনিত ঘটনা ঘটে তাতে একজন পুলিশ এর এসআইসহ ৪ জন নিহত হয়। নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন—নাচোল থানার এসআই তফিজুদ্দিন মোল্লা, নাচোল থানার কনেস্টবল শাহদাত আলম, কনেস্টবল নওয়াজেশ আলী ও কনেস্টবল তপেশ চন্দ্র আচার্য। এরা সবাই ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে জখম প্রাপ্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। রাজশাহী সদর হাসপাতালে ৯ জানুয়ারি ১৯৫০ এ এদের সকলের ময়নাতদন্ত করেন সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন ডা. এইচ রহমান।
সাজা মাথায় নিয়ে ইলা মিত্র এলেন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। ৪ বছর ৪ মাস জেলের ঘানি টানলেন। গ্রেফতারের পরেই তো পুলিশী অত্যাচারে অসুস্থ ছিল। দায়রা জজ আদালতে বিচার চলাকালীন তাকে স্ট্রেচারে করে আনা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল ডাক্তার ও নার্স। সেই অসুখই দীর্ঘ ৪ বছর ধরে বেড়ে দারুণ আকার নেয়। প্রয়োজন হয়ে পড়ে সুচিকিৎসার। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদার সৌমেন্দ্রনাথ মিত্রের পুত্রবধূ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে এটা ভাবা যায় না। যেভাবেই হোক ইলা মিত্রকে মুক্ত করতেই হবে। সে সময় মুখ্যমন্ত্রী যুক্তফ্রন্ট পার্টির নেতা শেরে-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক। ইলা মিত্রকে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি পাবার চিন্তা ভাবনা চলছে। দেশের কয়েকজন কমিউনিষ্ট একত্রিত হলেন। এদের মধ্যে রাজশাহীর অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান (আতা মোক্তার নামে পরিচিত) এবং প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী, কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সিলেটের বসন্ত দাস, ময়মনসিংহের ত্রৈলক্ষ্ম্যনাথ চক্রবর্তী, বরিশালের ইমাদুল্লাহ লালা, কমরেড মনি সিংহ, কমরেড হাজী মোহাম্মদ দানেশ, কমরেড খোকা রায়, কমরেড সেলিনা বানু, কমরেড সামাদ এরাই খোঁজ পেলেন শেরে-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের ঘনিষ্ট বন্ধু বগুড়ার শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বর্ষীয়ান কংগ্রেসী নেতা শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে ‘তুই’ সম্পর্ক। শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বসন্ত দাস, এবং প্রভাস লাহিড়ী ৪ জন গেলেন মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের কাছে। উদ্দেশ্য ইলা মিত্রকে ছাড়ানো। সে সময় শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘দেখ ফলজু, তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি। তা না হলে ১৯৪৬ সালের ইলেকশনে তুই মুসলমানগো ধাওয়া খাইলি। মাত্র ৮ বছরের তফাৎ। আবার তুই মুখ্যমন্ত্রী হইছিস। অতো সতো বুঝি না। তুই এই ইলা মিত্ররে ছাইড়া দে। আমারা এখন চললাম।’ জবাবে মুখ্যমন্ত্রী শেরে ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক বললেন, ‘ওই শ্রীশ, তুই তো হারাটা জীবন খালি স্বদেশী করলি। কংগ্রেসী নেতা হইয়া আইজ আইসোস কমিউনিষ্ট নেতারে জেল থাইক্যা ছাড়াইবার দরবার লইয়া। তাও আবার মার্ডার কেসের আসামী। যাউগ্যা। শীশ, তুই অমাার কাছে কোনোদিনই কিছু যাস নাই। অহন তোরা যা। দেহি কি করতে পারি?’ এরপর ফজলুল হক চিফ সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলেন আজকের মধ্যেই রাজশাহীর সিভিল সার্জন জেল হাসপাতালে গিয়ে যেন কমরেড ইলা মিত্রের মেডিক্যাল পরীক্ষা করেন। সেই মেডিক্যাল রিপোর্টে যেন উল্লেখ করেন ইলা মিত্রের চিকিৎসা রাজশাহীতে আর সম্ভব নয়। এতেই কাজ হলো ৩ দিন পর পুলিশ প্রহরায় ইলা মিত্রকে ঢাকা নেয়া হলো। সরাসরি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, গঠিত হলো মেডিক্যাল বোর্ড। এ বোর্ডের প্রধান হলেন ডাক্তার কে এস আলম। মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক সুযোগমতো ডাক্তার এ এস আলমের সাথে আলাপ সেরে নিয়েছেন। মেডিক্যাল রিপোর্টে বলা হয় সাজাপ্রাপ্ত ইলা মিত্র নানা দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। পূর্ব বাংলায় এসব চিকিৎসা সম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রী এই মেডিক্যাল রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ করে আসামী ইলা মিত্রকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তির নির্দেশ দেন। ইলা মিত্র বিদেশ যাওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক গিয়েছিলেন সৌজন্য সাক্ষাতে। শেরে বাংলা ফজলুল হক সে সময় প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন সাংবাদিককেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। তিনি কমরেড ইলা মিত্রের মাথায় যখন হাত বুলিয়ে আদর করেন তখন ইলা মিত্রের চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। ফজলুল হকের মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে ‘বুঝছো মা শ্রীশ চ্যাটার্জীর অনুরোধটা ফালাইতে পারলাম না। বুড়াটা কবে মইররা যায় কে জানে? হেইর লাইগ্যা, তোমারে প্যারোলে ছাইড়া দিলাম। তোমারে আশির্বাদ করতাছি, কোলকাতায় নামীদামী ডাক্তার আছে ঠিক মতোন চিকিৎসা হইলে ভালো হইয়া যাইবে। তয় একটা কথা। ভালো হওনের পর কিন্তু আর ইস্ট বেঙ্গলে আইবা না—বুঝছো। কথাটা মনে থাকে যেন।’ হ্যাঁ, ইলা মিত্র মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের দেয়া কথা রেখেছিলেন। তিনি আসেননি ইস্ট বেঙ্গলে। তিনি এসেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী, নাচোল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী কিংবদন্তী ইলা মিত্র ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর রবিবার বিকাল ৪ টায় কোলকাতায় এক হাসপাতালে শেষ নিস্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বৎসর। একটা বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারিণী ইলা মিত্র কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য হিসেবে ১৯৪৩ খ্রি. থেকে ১৯৫০ খ্রি. পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে যাবার পর মুক্ত হন সিপিআই-এর সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ পার্টির জেলা কমিটি ও প্রাদেশিক কমিটির তিনি সদস্য ছিলেন। ১৯৬২-৭৮ খ্রি. পর্যন্ত চার বার তিনি মানিকতলা নির্বাচনী এলাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৭ ও ১৯৭২ খ্রি. তিনি বিধান সভার ডেপুটি কমিউনিষ্ট লিডারও ছিলেন। পশ্চিম বঙ্গেও ১৯৬২ ও ১৯৭০, ১৯৭১ এবং ১৯৭২ খ্রি. তিনি কারাবরণ করেছেন। ইতোপূর্বে বাবার চাকুরির সুবাধে কলকাতার বেথুন স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৪৪ খি. স্নাতক এবং ১৯৫৮ খ্রি. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনিই প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে ১৯৪০ খ্রি. অনুষ্ঠিতব্য জাপান অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ায় অলিম্পিক বাতিল হয়ে যায়।
আজো নাচোলের সাঁওতালরা গেয়ে থাকে, কয়েকটি পঙতি—
‘ইলা মিত্রওয়াক হ হ তে
সাঁওতাল আদিবাসীকো তেংগোলেনা
দাল কেদেয়াকো, তল কেদেয়াকো, ভরাও কেদেয়াকো জেহেলরে
সাঁওতাল আদিবাসী হালেডালে।’
(বঙ্গানুবাদ: ইলা মিত্রের ডাকে সাঁওতাল আদিবাসীরা দাঁড়িয়েছিল। তাঁকে মারা হলো, বাঁধা হলো, ঢুকানো হলো জেলখানায়। অন্যদিকে সাঁওতাল আদিবাসীরা হলো ছিন্ন-ভিন্ন।)
