১
বিগত ২৩ আগস্ট আদিবাসী সাঁওতালদের জন্য একটি মাইলফলক। এ দিনটিতে সাঁওতালদের মধ্যে থেকে প্রথম সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তি হয়েছেন অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১২৩৩ জনের মধ্যে একজন। দেশের জেলা শহরগুলোতে আদিবাসী সাঁওতাল আইনজীবীদের উপস্থিতি লক্ষণীয় হলেও সুপ্রীম কোর্টের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়েছেন অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু। উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর থানার জলাহার গ্রামের অধিবাসী অ্যাডভোকেট টুডু। অ্যাড. প্রভাত টুডুর পিতা শ্যাম টুডু এবং মা রাজোবালা মুরমুর ৭ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। শ্যাম টুডু একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে বেশ সুপরিচিত। আমনুরা মিশন স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন, বর্তমানে অবসরে। জলাহার থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিল প্রায় ৩ কিলোমিটার, তিনি নিজে যেতেন এবং গ্রামের ছেলে-মেয়েদেরও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন শিক্ষালয়ে। সরকারের বৃত্তি পেতেও স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। সর্বশেষ নিজ গ্রামে নিজের জমি প্রদান করে ‘জলাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ স্থাপনে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। শিক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য উপজেলা প্রশাসন ‘আলোর পথিক’ সম্মানে ভূষিত করেছেন। মা রাজোবালা মুরমু র্যাপিড পি আর কর্তৃক ২০২০ সালে রত্নগর্ভা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
১৯৮৫ সালে জন্ম নেওয়া প্রভাত টুডু’র জীবন বৈচিত্র্য সংগ্রামী হলেও শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছেন শিখরে। আদিবাসীদের স্বাভাবিক আর্থ- সামাজিক পরিস্থিতির মতোই টুডুকে অতিক্রম করতে হয়েছে দারিদ্র্যতা, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবহেলা এবং পদে পদে থাকা প্রতিবন্ধকতাসমূহ। তিনি জানাচ্ছিলেন, ‘আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে, আদিবাসীরা নানা ছুতোয় মামলা-মোকাদ্দমায় জড়িয়ে পড়ছেন; অবশেষে নিজেদের নাড়ি পোতা জায়গা থেকে স্থানচ্যুত হচ্ছেন প্রতিনিয়তই। আমি আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইকে উজ্জীবিত করতে চাই। এছাড়াও সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করে আইনিভাবে সর্বোচ্চ সহযোগিতা ও বিচার নিস্পত্তিতে মৌল তথ্যাদি সরবরাহ করে নিরীহ আদিবাসীদের দক্ষিণে দাঁড়াতে চাই। অ্যাডভোকেট টুডু আদালতের পাশাপাশি সচেতন বাড়াতে গড়ে তুলেছেন ‘উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম’, তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। আমরা তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
২
অস্ট্রেলিয়ার প্রথম আদিবাসী খেলোয়াড় ফেইথ টমাস ১৫ এপ্রিল, ২০২৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৫৮ সালে ইংল্যান্ডের নারী দলের বিপক্ষে একটি টেস্ট খেলেছিলেন টমাস, খেলোয়াড়ি জীবনে ফাস্ট বোলার ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার মেয়েদের টেস্ট ক্রিকেটের ৪৮তম খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। ক্রিকেট খেলোয়াড় ফেইথ টমাস ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়েছেন যে কোনো খেলাতেই জাতীয় দলে ডাক পাওয়া প্রথম আদিবাসী হিসেবে। ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুর পূর্বে ক্রিকেট ছাড়াও নার্সিং পেশাতেও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। অস্ট্র্রেলিয়ার আদিবাসীদের ‘স্টোলেন জেনারেশন’ বা চুরি যাওয়া প্রজন্মের একজন ছিলেন টমাস। সরকারের নীতি অনুযায়ী, আদিবাসী পরিবারের কাছ থেকে সন্তান ছিনিয়ে নিয়ে একটা প্রজন্মকে বড়ো করা হয়েছিলো শ্বেতাঙ্গ পরিবারে। ১৯৩৩ সালে নিপাবুন্নায় জন্ম নেওয়া টমাসের মূল নাম ছিল টিন্নিফা। তার মা ছিলেন আদিবাসী, বাবা ছিলেন পোলিশ। টমাসের বেড়ে ওঠা ফেইথ কোল্টহার্ড নামে, সাউথ অস্ট্র্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স রেঞ্জার্সের কোর্নে। শৈশব কেটেছে ঘরে বানানো ব্যাট ও পাথর দিয়ে ক্রিকেট খেলতেন টমাস। ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের ক্রিকেট খেলার শুরু প্রসঙ্গে টমাস বলেছিলেন, ‘একবার তাঁর চোখে এসে বল লেগেছিল। ক্ষুব্ধ টমাস এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি এরপর থেকে এমন জোরে বল করবেন যে সেটি থেকে ব্যাটারদের নিজেকে রক্ষা করতে হবে।’ খেলোয়াড়ি জীবনের দ্বিতীয় ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেন টমাস। রাজ্যদলের হয়ে তিনটি ম্যাচ খেলার পরই জাতীয় দলে জায়গা হয়। সে বছর অস্ট্র্রেলিয়ান একাদশে ডাক পেয়ে প্রথমবারের মতো ট্রেনে করে অ্যাডিলেড থেকে ব্রিসবেন গিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচেই ক্রিকেট বোদ্ধাদের মুগ্ধ করে তোলেন। ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ম্যারি ডুগানকে বোল্ড করেছিলেন, স্টাম্প নাকি উইকেট কিপারের মাথার ওপর দিয়ে গিয়েছিল। ডুগান বোল্ড হওয়ার পর হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘জীবনে এমন কিছু দেখেননি।’ ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে গর্ভবতী অবস্থায় নিজের শেষ ম্যাচটি খেলেন টমাস। বার্নার্ড টমাসকে বিয়ে করার পর ফেইথ কোল্টহার্ডের নাম হয় ফেইথ টমাস। ২০১৯ সালে অস্ট্র্রেলিয়ার ক্রিকেট ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবদানের জন্য টমাসকে অর্ডার অব অস্ট্র্রেলিয়া খেতাবে ভূষিত করা হয়। অস্ট্র্রেলিয়ার দ্বিতীয় আদিবাসী খেলোয়াড় হলেন জেসন গিলেস্পির, অভিষেক হয়েছিল ১৯৯৬ সালে এবং দ্বিতীয় নারী আদিবাসী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট খেলেছেন অ্যাশলেই গার্ডনার। তার স্মরণে নারী বিগ ব্যাশের দল অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার্স প্রতিবছর পার্থ স্কর্চার্সের বিপক্ষে ফেইথ টমাস ট্রফির ম্যাচ খেলে। টমাসের মৃত্যুতে ক্রিকেট অস্ট্র্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী নিক হকলি বলেছিলেন, ‘ফেইথ টমাস ক্রিকেট ও সম্প্রদায়ে অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। তাঁকে জানার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছিল বা যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন, সবার জন্যই এটি অনেক দুঃখের দিন। অস্ট্র্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করা প্রথম আদিবাসী নারী হিসেবে ফেইথ সবার জন্যই প্রেরণা ছিলেন। আমাদের খেলায় গভীর এক ছাপ রেখে গেছেন তিনি।’
৩
প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন দেশটির মাওরি আদিবাসী সম্প্রদায়ের নারী ডেম সিনডি কিরো। ২০২১ সালে ২১ অক্টোবর ওয়েলিংটনে দেশটির পার্লামেন্টে গভর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। নিউজিল্যান্ডে আলংকারিক রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন গভর্নর জেনারেল। দেশটিতে ব্রিটিশ রাজপরিবারের হয়ে সাংবিধানিক ও আনুষ্ঠানিক নানা কাজও করতে তাঁকে। এককালে ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল নিউজিল্যান্ড। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নিউজিল্যান্ডের অভিবাসী ও প্রান্তিক বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দেন সিনডি কিরো। এ সময় মাওরি ও ব্রিটিশ পরিচয়ের কারণে নিজে গর্বিত বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নতুন অভিবাসী ও সাবেক শরণার্থীদের সঙ্গে যুক্ত থাকব। এছাড়া নিউজিল্যান্ডকে নিজেদের দেশ হিসেবে বেছে নেওয়া মানুষদের থেকে আমরা যে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি পেয়েছি, সেগুলো উদ্যাপন করব।’ প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন বলেন, ‘আমি জানি এই পদে প্রথম মাওরি নারী হিসেবে আপনি এটা মাথায় রেখেছেন যে, আপনার কর্মকাণ্ড দেশের সব স্তরের মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়।’ নিউজিল্যা-ের জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ মাওরি আদিবাসী সম্প্রদায়।
৪
বান্দরবানের প্রেন চ্যং ম্রো যিনি ফুটবলে মিনিটে ২০৮ বার পায়ের টোকা দিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্বীকৃতি পেয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্সেস বিভাগের ছাত্র প্রেন চ্যং ম্রোর বসত ভিটা বান্দরবান উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের লামারপাড়ায়। তিনি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় থেকে প্রথমে জেলা ও পরে বিভাগীয় দলের হয়ে জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলেছেন। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ‘মোস্ট ফুটবল (সকার) টো ট্যাপস ইন ওয়ান মিনিট’ ক্যাটাগরিতে প্রেন চ্যং ম্রো পূর্বের রেকর্ডকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২২ সালের ৩ মে আবেদন করেন। আগে এক মিনিটে সর্বোচ্চ ১৯৭ বার টোকা দেওয়া কুমিল্লার কনক কর্মকার রেকর্ড করেছিলেন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুন্তাকিমুল ইসলাম এক মিনিটে ২০৭ বার টোকা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাকে ডিঙিয়েছেন প্রেন চ্যং ম্রো। ২৪ এপ্রিল প্রমাণ হিসেবে ফুটবলে এক মিনিটে ২০৮ বার টোকা দেওয়া ভিডিও চিত্র ধারণ করেন, অতঃপর প্রয়োজনীয় প্রামাণ্য চিত্র এবং দলিলপত্র পাঠিয়ে দেন। প্রায় ছয় মাস পর আদিবাসী প্রেন চ্যং ম্রো ৫ নভেম্বর তাকে গিনেস ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষ স্বীকৃতির বিষয়টি অবহিত করেন। ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর বলেছিলেন, ‘এমন অর্জন সত্যিই অন্যরকম গর্বের ব্যাপার আমাদের জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। …উপাচার্যকে বিষয়টি অবগত করে এই শিক্ষার্থীকে যতটুকু সম্ভব আমরা অভিনন্দিত করার চেষ্টা করব।’
৫
২৩ বছর বয়সি জাসপার লালখুমসাং বম দেশে ও বিদেশে মিক্সড মার্শাল আর্টের সাতটি আসরের শিরোপা জয় করে তাক লাগিয়েছেন। বক্সিং, কারাতে আর জুডোর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা মিক্সড মার্শাল আর্টের রিং যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য কঠিন ক্ষেত্র। এই খেলায় ক্ষিপ্রতা, শারীরিক সক্ষমতা আর কৌশলের সমন্বয় থাকতে হয় খেলোয়াড়ের। মুহূর্তের অসতর্ককতায় প্রতিপক্ষের হাতে ধরাশায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে জাসপার লালখুমসাং বম কঠিন এই লড়াইয়ের ময়দানে পা রেখেই নিজেকে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরেছেন। বান্দরবানের কেওক্রাডং পাহাড়ের পাদদেশে তার বাড়ি। ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ছাত্র জাসপারর স্বপ্ন সাধনা কেওক্রাডংকে ছাড়িয়ে যাওয়া। মিক্সড মার্শাল আট লড়াইয়ের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আসরের নাম আলটিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপ বা ইউএফসি। এখন পর্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এই আসরে বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় অংশ নিতে পারেননি। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে দেশে এমএমএর অপেশাদার পাঁচটি আসরে খেলে সেরা হয়েছেন। ২০১৯ ও ২০২০ সালে ভারতে পেশাদার দুটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন, দুটি আসরেই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ইতোমধ্যেই বিদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। জাসপারের লক্ষ্য হচ্ছে, ইউএফসিতে প্রতিযোগী হিসেবে নাম লেখানো এবং আসরে খেতাবও জেতা। বিশ্বসেরা হয়ে দেশের পতাকা তুলে ধরতে চান বিশ্বমঞ্চে। ২৪ বছর বয়সি ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা ছিপছিপে শরীরের জাসপার সম্পর্কে বাংলাদেশ মিক্সড মার্শাল আর্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমএ)-এর কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমদ বলেছেন, ‘জাসপার আমার ছাত্র ছিলেন। …তাঁর উচ্চতা ও ওজন এমএমএর জন্য খুবই অনুকূল।’
৬
দক্ষিণ এশিয়া কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপের ষষ্ঠ আসরে ২টি স্বর্ণপদক জয়ী হয়েছেন রুইতম ম্রো ও সংক্যউ মারমা। এছাড়াও ২৩টি পদক ছিনিয়ে এনেছেন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আসর থেকে। বান্দরবানের মহামুণি শিশুসদনের ছয়জন কিশোরী ও দুইজন কিশোর অংশগ্রহণ করেছিলেন ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত গেমসে। দুইজন স্বর্ণপদক, ৩টি রৌপ্য ১০টি ব্রোঞ্জ পেয়েছে। শিশু সদনে পড়াশোনার পাশাপাশি কারাতে শিক্ষাও প্রদান করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী জ উ প্রু মারমা সাফ গেমসে দুইবার স্বর্ণপদক জয় করে এনেছিলেন।
৭
শেরপুর নালিতাবাড়ীর চাটকিয়ার সেন্টু হাজংয়ের নাম অত্র এলাকার কৃষকদের মুখে মুখে শোভা পাচ্ছে। ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা থেকেই উদ্ভাবন করেছেন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান। দীর্ঘ বছর থেকেই একক প্রচেষ্টায় দেশী পাইজাম ধানের সঙ্গে ভারতীয় রঞ্জিত (পাইজাম) ধানের সংকরায়ণ করছেন। সাত বছর ধরে প্রচেষ্টায় বিআর ১১ ধানের সঙ্গে স্থানীয় জাতের চিনিশাইল ধানের সংকরায়ণ করে ২০১৬ সালে উদ্ভাবন করেন ‘সেন্টুশাইল’, নিজের নামের সাথে সংযুক্ত করে নামকরণ করেছেন। বাড়ির আঙ্গিনায় ছোটো একটি গবেষণাগার তৈরি করে বুদ হয়ে আছেন সেন্টু হাজং। দীর্ঘ ১৭ বছরে উদ্ভাবন করেছেন ২৩ ধরনের নতুন ধান। সর্বশ্রেণীর কৃষক ধানগুলো চাষাবাদ করে সুফল পাচ্ছে। ২০১৯ সালে ব্যাপক গবেষণার ফলস্বরূপ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হোন সেন্টু ২১। ইতোমধ্যেই একক প্রচেষ্টায় ২৩ প্রকারের দেশী নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। পাইজাম একর প্রতি ফলন হয়ে থাকে ৩৫/৪০ মন আর সেখানে সেন্টু হাজংয়ের সেন্টু-২১ একরে ৬০/৭০ মন। বীজতলা তৈরি থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত সেন্টু-২১ উৎপাদনে সময় লাগে ১৫০ থেকে ১৫৫ দিন; আর পাইজামের সময়কাল ১৬০ দিন। পোকামাকড়ের আক্রমণও অপেক্ষাকৃত কম। ধান চাষের ক্ষেত্রে একর প্রতি ৮০ কেজি ডিএপি, ৬০ কেজি পটশা ও ৪০ কেজি ইউরিয়া সার প্রদান করতে হয়। ধান বিজ্ঞানী সেন্টুু হাজং প্রথম ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি মিডিয়ার আলোতে আলোকিত হয়ে পড়েন। সেন্টুু হাজংয়ের উদ্ভাবিত সাতটি ধানের নাম দেওয়া হলেও বাকি জাতগুলোর এখনো দেওয়া হয়নি। পাইজামের সঙ্গে বিনা ৭ ধানের সংকরায়ণ করে সেন্টুু হাজং যে ধান তৈরি করেছেন, তার নাম দেওয়া হয়েছে সেন্টুু ১ ‘সুনালো’। দুধবিন্নির সঙ্গে মার্কাবিন্নি সংকরায়ণ করে সেন্টু ৪ ‘বিশালীবিন্নি’। তিনি চিনিশাইল, তুলসীমালা, চাপাল, পাইজাম, বাইশমুঠি, হরি, স্বর্ণলতা ও রঞ্জিত ধানের সঙ্গে সংকরায়ণ করে নতুন জাতের ধানের বীজ উদ্ভাবন করেছেন। তার উদ্ভাবিত ধানগুলো কতক বাতাসে হেলে পড়ে, আর কতকগুলো পড়ে না। নালিতাবাড়ির সেন্টুু হাজং ধান সংকরায়ণ করে মাটির টবে সেই ধানের বীজ রোপণ করেন। গাছ হলে সেখান থেকে মুঠি মুঠি বীজ সংরক্ষণ করেন। আমন মৌসুমে সেই বীজ ছোটো ছোটো আকারে খেত (প্লট) তৈরি করে চাষাবাদ করেন। এভাবে নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন চলতে থাকে। অভাবের কারণে সেন্টুু হাজং মাধ্যমিক পাস করার পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। ২০০৫ সালে একটি বেসরকারি সংগঠন পাহাড়ি দরিদ্র কৃষকদের নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন শিখিয়েছিল তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। সেটাই সেন্টুর মধ্যে ঘুমন্ত উদ্ভাবক সত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। এরপর ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। সেন্টু হাতের মাধ্যমে পরাগায়ন ও নির্বাচনে (হ্যা- পলিনেশন অ্যা- সিলেকশন) এককভাবে একক প্রচেষ্টায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেন্টু হাজংয়ের অভিব্যক্তি হচ্ছে, ‘এ কাজে আগ্রহ ও অনেক ধৈর্য লাগে। ধান নিয়ে পড়ে থাকায় প্রথম প্রথম লোকজন এটাকে পাগলামি মনে করতেন। এখন কৃষকেরা দারুণ খুশি। নতুন ধরণের ধান নিয়ে আসা অনেকটা নেশার মতো হয়ে গেছে। কৃষক তাঁর ধান চাষ করে যখন লাভবান হন, তখন তাঁর দারুণ লাগে।’ তার প্রত্যাশা একজন ধান বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি এবং দেশব্যাপী উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষাবাদ ছড়িয়ে দেওয়া। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর কবির বলেন, ‘সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবিত স্থানীয় জাতের সেন্টু-২১ ধান চাষে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ রয়েছে। চাষীরা ফলনও ভালো পাচ্ছেন। এই ধান আমরা আগামী আমন মৌসুমে ট্রায়াল হিসেবে চাষ করবো। ফলাফল দেখে সরকারিভাবে অনুমোদনের জন্য বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে পাঠানো হবে।’
৮
আদিবাসী রাধাবতী দেবী কলাগাছের সুতা দিয়ে ‘কলাবতী’ শাড়ি তৈরি করে সাড়া জাগিয়েছেন। বান্দরবান জেলার জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেছে কলাগাছের সুতা দিয়ে শাড়ি তৈরি উদ্যোগটি। এ বছরের জুলাই মাসে জেলা প্রশাসক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কলাগাছের তন্তু থেকে তৈরি কলাবতী শাড়ি উপহার দিয়েছেন। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কলাগাছের তন্তু থেকে মণিপুরী নক্সার এই শাড়ি তৈরি করেন তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী। ১৯৯২ সালে থেকে মণিপুরী শাড়ির কারিগর হিসেবে কাজ করে আসছেন মৌলভীবাজারের রাধাবতী দেবী। বাল্যবিবাহের শিকার রাধাবতী দেবীর স্বামীর সাথে বুনিবোনা হয়নি বেশিদিন, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে স্বামীকে ডিভোর্স দেন। আর বিয়ে করেননি, থেকেছেন বাবা-মার সাথে; মৃত্যুর পর ভাই-বোন, কাকিদের সঙ্গে। বলেছেন, বান্দরবানে গিয়েই প্রথম জানতে পারি কলাগাছ থেকে সুতা তৈরি করা যায়। এর আগে জীবনে কলাগাছের সুতা চোখে দেখিনি। নক্সাবিহীনভাবেই সমস্ত ভয়কে জয় করেই ১৩ হাত শাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হই, জেলা প্রশাসক তিবরীজি নিজেই নামকরণ করেন কলাবতী শাড়ি। একটি শাড়ি তৈরিতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় ব্যয় হয় কিন্তু এটি তৈরি করতে সময় লেগেছে পুরো ১৫ দিন। ৬৫ বছর বয়সী রাধাবতী দেবী স্বপ্ন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, যেখান থেকে নতুন প্রজন্মরা শাড়ি বানানো শিখবে। নিজের অর্থায়নে কুলানো সম্ভবপর হচ্ছে না বিধায় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন।
দেশে কিংবা বিদেশে আদিবাসীদের জ্ঞান, কর্মদক্ষতা, প্রতিভার বিকাশকে সম্মান জানালে সত্যিই প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠীই উৎসাহিত ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে আদিবাসীরা মনে করেন, দেশকে দেওয়ার আমাদের কিছুই নেই; এই ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে সুযোগও সৃষ্টি করা আবশ্যিক। সরকারের প্রতিটি বিভাগই আদিবাসীদের বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে ছাইয়ের মধ্যেই আগুনের সন্ধান পাওয়া সম্ভব এবং সেটিই হবে আদিবাসীদের জন্য পরম পাওয়া। আসুন, আদিবাসীদের সম্মান করি, সুযোগ প্রদান করি এবং তাদের প্রতি যত্নবান হই।