আমি দান চাই না, অধিকার চাই। একা থাকতে চাই না, মিলেমিশে থাকতে চাই। শান্তিতে বাস করতে চাই। বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে এই দেশেই গর্বের সাথে বাস করতে চাই। সুস্থভাবে বাঁচতে চাই । চোরাগোপ্তা হামলা বা মামলায় বা সাম্প্রদায়িকতার বলি যেন আর কেউই না হয় সেই দিকে আমাদের দৃষ্টি রাখতে চাই। আসলে আমরা কি সত্যিই জনগণ? জনগণের আসল সংজ্ঞাটা কী তা আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে আজ।
গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটা মায়ের পোস্ট দেখলাম, তিনি বলছেন, আমার বাচ্চর জন্ম দিতে আমি যে কষ্ট পাইনি, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছি বাচ্চার জন্ম সনদ তৈরি করতে। আমাদের দেশের বড়ো বড়ো নেতাগণকে মাঝে মাঝেই তাদের বক্তৃতায় বলতে শুনি, আমরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। কেউ বা বলেন, জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করে আমাদের অধিকার ফিরিয়ে আনবোই। কেউ বা বলছেন, জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা দুর্নীতি রুখবোই। আমাদের ইসি বলেছেন, জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া আমাদের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কাউকে আবার বলতে শুনি, জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে আমাদের যেকোনো সংকট মোকাবেলা করা কোনো কঠিন কাজ নয়। আবার সংবিধান আমাদের বলেছে, সকল ক্ষমতার উৎস একমাত্র জনগণ। আমি আসলে বুঝতেই পারি না যে আসলেই এই জনগণ বলতে কী বোঝায়। আসলে কারা এই জনগণের আওতায় পড়ে? আমরা তো অন্যের অবদান স্বীকার করতে কোনোদিনই শিখিনি। কারো অবদানের জন্য ধন্যবাদ দেওয়াও শিখিনি। কারো কাজের অবদানের চিহ্নসরূপ তার মৃত্যুর পরেও তাকে স্মরণ করা শিখিনি। শুধু শিখেছি নিজেকে কীভাবে বা কোন কৌশলে টিকিয়ে রাখা যায়।
আজ নিয়মের জালে আর কুটিলতার ফাঁদে যেভাবে আমরা আটকে যাচ্ছি, তাতে নিজের বিপদ হয়ত নিজেই ডেকে নিয়ে আনছি বলে আমার মনে হচ্ছে। নিয়ম অবশ্যই ভালো কিন্তু নিয়মের মধ্যে যে ফাঁকগুলো আছে তা বন্ধ না করলে নিয়মের যে স্বাদ, তা কখনোই পাওয়া যাবে না। নিয়ম আসছে আর সামাজিক ব্যাধিগুলো জ্বল জ্বল করে ভেসে উঠছে চোখের সামনে। আমরা আজ অনেকেই নিয়মের অনিয়মে আটকে আছি। আমাদের উচিত শুধু নিয়মেই নয়, নিজেকেও সৎ কাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুলে, সুস্থ ধারার মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
সারাদেশে সকল কর্মকা-ই যেন সামনের দিনের জন্য অস্থিতিশীলতার বীজ রোপন করছে বলে মনে হচ্ছে। বড়ো বড়ো উন্নয়ন যে হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু এত উন্নয়নের পরেও আমরা কেন শান্তি পাচ্ছি না। বিদ্যুৎ নিয়ে কতই না হিসেব-নিকেশ দেখি পত্রিকা খুললেই। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তাই তো বুঝতে পারি না। বিদ্যুৎ যে থাকে না, এটা তো সত্যি কথা, সেজন্য আমাকে প্রতিদিনই জেনারেটর ব্যাবহার করতে হয়, আমাদের প্রতিষ্ঠান চালানোর স্বার্থে। আমাদের দেশে নাকি বিদ্যুতের চাহিদা ১৫৮০০ মেগাওয়াট। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা নাকি আমাদের ২৬৮৫১ মেগাওয়াট। তাহলে কি আমাদের মতো মনুষের মনে হতে পারে না যে এই তথ্যটা ভুল। এত সক্ষমতার মাঝে তো এত লোডশেডিং থাকার কথা নয়। আবার এই সক্ষমতাকে বসিয়ে বসিয়ে প্রতি বছর প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে আমাদের তহবিল থেকে, তা অবশ্যই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মাথা বিক্রি করা টাকাই হয়ত হবে অথবা আমাদের কর ও ভ্যাটের টাকা। আবার আমাদের সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ও নাকি আমাদের ৪৫% সক্ষমতাকে ও শীতের মৌসুমে তা বেড়ে নাকি ৭০% সক্ষমতাকে বসিয়ে রেখে টাকা গুণতে হয়। প্রথম আলো, ২৯ জুলাই ২০২২।
এত সক্ষমতা থাকতেও কেন যে এত লোডশেডিং তাই তো বুঝতে পারি না। আবার এই উৎপাদন সক্ষমতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথেই দাম বেড়েছে, লোকসান বেড়েছে, ভর্তুকি বেড়েছে, আবার লোডশেডিংও বেড়েছে। বিগত এগার বছরে বিদ্যুতের দাম প্রায় দশ বার তো বেড়েছেই। আবার উৎপাদন সক্ষমতার জন্য গত তিন বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকাও নাকি গুনতে হয়েছে বা হবে। অনেক জায়গায় নাকি এখনো সক্ষমতার বিপণন লাইনই চালুই হয়নি। আবার তা আদৌ দরকার হবে কিনা তাও জানা নেই। আবার নাকি প্রায় ১২ বছর পর ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং, ১০ বছর পরে আইএমএফ’র কাছে ধারের আবেদন, ডলারের দামের সাথে দেশীয় মুদ্রার দামের এই যে পার্থক্য, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন গতি, জ¦ালানির অভাবে কারখানা সেচ ও পেট্রোল পাম্প অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা, এই যে গত তিন মাসের যে চিত্র পত্রিকা খুললেই আমাদের চোখে পড়েছে, তা কি আমাদের জন্য অশনি সংকেত বহন করে না। মনের কষ্টগুলো জমে থাকতে থাকতে আবার তা জনবিস্ফোরণ হয়ে দেখা দেবে না তো। এটাই এখন ভাবার বিষয়।
অলোক মজুমদার : চিকিৎসক ও লেখক;
বিশেষ প্রতিনিধি সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তন।