একটা অনুষ্ঠান, সত্যেন সেন গণ সংগীত উৎসব পাবনা। কোনো উৎসব তা কেমন হবে বোঝা যায় সেখান কার মঞ্চে বসা মানুষগুলোকে দেখেই। এই মহতি অনুষ্ঠানের সভাপত্বি করেন পাবনা জেলা উদীচীর সম্মানিত সভাপতি কাজী মারুফা, উদীচীর হাল ধরে থাকা ঢাকা কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আসা কেন্দ্রীয় কমিটির গুণী মানুষ অমিত রঞ্জন দে দাদা ও গোলাপ ভাই, পাবনা উদীচীর সম্মানীত সাধারণ সম্পাদক দিবাকর চক্রবর্তী দাদা। সামনে উপবিষ্ট ছিলেন প্রগতিকে লালন করা আমার সহযোদ্ধা অনেক ভাই ও বোন। আমার শ্রদ্ধেয় জ্যেঠা, যার জীবনের বেশি সময় উদীচী, ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপের মতো প্রগতিশীল চিন্তার সাথে জড়িত এবং যার বিচরণ ছিল সংস্কৃতি, শিক্ষা, আইনপেশা, লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, একুশে পদক প্রাপ্ত গুণী মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা রনেশ মৈত্র ও তার সহধর্মিণী মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা পদক প্রাপ্ত পূরবী তালুকদারসহ, অন্যান্য গুণী মানুষ। সবাইকে ঈশ্বরদী উদীচীর পক্ষ থেকে আমি আমার সংগ্রামী আভিনন্দন জানাই। আমার মতো একজন নগন্য মানুষ উদীচীর মতো প্ল্যাাটফর্মে বড়োই বেমানান। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যারা আমাকে আপনাদের মতো গুণী মানুষদের পাশে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। একুশে পদক প্রাপ্ত একটা গণ-সংগঠন আরেক জন একুশে পদক পাওয়া গুণী মানুষকে ও মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পাওয়া গুণী মানুষকে সম্মাননা দিচ্ছেন এটা কম গৌরবের বিষয় নয় । অমøান দত্ত আভি দাদা খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করে গান নৃত্য গণসংগীতসহ কবিতা আবৃতি ও আলোচনা অনুষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মী ভাইদেরসহ সকলকে আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
১৯০৭ সালের ২৮ শে মার্চ ঢাকা জেলার টংগীবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামের সেন পারিবারের আলো হয়ে আসা মানুষটিই আমাদের উদীচী সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিপ্লবী সত্যেন সেন। ঈশ্বরদী উদীচীর পক্ষে এই মহান মানুষটিকে জানাই বিপ্লবী অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তার সহযোগী রনেশ দাসগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সাবকে, যাদের ত্যাগ আজ আমাদেরকে একত্রে বসতে সাহায্য করেছে। ১৯৬৮ সালের ২৯ শে অক্টোবর, শিল্পী সংগ্রামী সত্যেন সেনের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী নিপীড়িত মানুয়ের গান গাইবার অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। আজ অবধি তা সুনামের সাথেই চলছে।
১৯৭১ সালের হাজারো মুক্তি সংগ্রামীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, মিলে মিশে যুক্ত হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে। শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সকল মুক্তিকামী মানুয়ের রক্ত ধারা মিশে ছিল, আমাদের স্বাধীনতার জন্য আত্ম বলিদানের মধ্যে। লক্ষ মানুষের পরম আত্মদানের মধ্য দিয়ে, পাওয়া স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে, শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে সংস্কৃতি বিকাশের পথ হবে বন্ধন মুক্ত, সেই আশাই ছিল কিন্তু আজ ৫০ বছরেও তার আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। আজ আবার নতুনভাবে মুক্তির ব্রত নিয়ে, হতাশা নৈরাজ্য ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে জেগে উঠে, শৃঙ্খলিত মানুষদের জাগতে উদ্বুদ্ধ করতে, উদীচীকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এই কালরাত্রে যারা শহিদ হয়েছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন, যারা স্বাধীনতার পক্ষে জীবন উৎসর্গের ব্রত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আমার সেই মা ও বোন যারা তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন আমাদের মুক্তির জন্য, তাদের সবাইকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, উদীচীকে পুনঃজাগরিত হওয়ার আশা ব্যক্ত করি।
উদীচী একটা অসাম্প্রদায়ীক, প্রগতিকামী, সেচ্ছাসেবী জাতীয় গণ সাংস্কৃতিক সংগঠন। সমাজ ও সভ্যতার ক্রম বিকাশ, শক্তি, শ্রমের সাথে সাংস্কৃতির সেতুবন্ধনই হলো উদীচী। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে অবাধ আত্ম বিকাশ, ভাব ও সংস্কৃতির আদান প্রদানের নিশ্চয়তা বিধান ও স্বাধীনতাকে জন জীবনে ফলপ্রসূ করে তোলার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করাই উদীচীর লক্ষ্য। যা জীবনমুখী, যা সমাজ ও মানুয়ের প্রকৃত কল্যাণ কাজ করে, উদীচী সেই সংস্কৃতিই লালন করে। ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায় ও জাতিসত্তা নির্বিশেষে সারা দেশবাসীর মধ্যে নিবিড় ভ্রাতৃত্ব বোধ সম্পর্কে বিশ্বাসী। কোনো কোনো স্থানে যুদ্ধ চলমান। আমাদের মনোযুদ্ধ চলছেই । আর যুদ্ধ হলো বিশ্ব মানর, মানবতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির দুষমন। তাই উদীচী যে কোন যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও বিশ্ব শান্তির পক্ষে তার সাংস্কৃতির কর্মকা- চালাতে সব সময়ই তৎপর থাকবে।
অলোক মজুমদার : চিকিৎসক ও লেখক; বিশেষ প্রতিনিধি সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তন।