১.
সদ্য স্বাধীন দেশের কর্ণধার হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭’র ৫ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে চর্তুথ ন্যাম সম্মেলনে যোগদেন। বৈঠক চলকালে স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সৌদি বাদশাহ ফয়সালের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছিল। আলোচনার একটি অংশ বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছিলেন কেন সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। কথাটি ছিল হুবহু এরকম ‘ ইউর এক্সেলেন্সি। আপনি জানেন যে, ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। আমি জানতে চাই, কেন সৌদি আবর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয়নি?’ বাদশাহ ফয়সাল উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি অসীম ক্ষমতাবান আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে প্রশ্নের জবাব দিই না। যেহেতু আপনি একজন মুসলিম, তাই আপনাকে বলছি—আপনি সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে Islamic Republic of Bangladesh করতে হবে।’ দৃঢ় কণ্ঠে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এই শর্ত বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে না। বাংলাদেশের জনগণের প্রায় অধিকাংশই মুসলিম। আমাদের প্রায় এক কোটি অমুসলিমও রয়েছে। সবাই একসাথে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে বা যুদ্ধের ভোগান্তিতে পড়েছে। তাছাড়া সর্বশক্তিমান আল্লাহ শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্যই নন। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। ইউর এক্সেলেন্সি, ক্ষমা করবেন, তাছাড়া আপনার দেশের নামও তো Islamic Republic of Saudi Arabia নয়। আরব
বিশ্বের একজন গুণী ও খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ প্রয়াত বাদশা ইবনে সৌদের নামে রাখা হয়েছে Kingdom of Saudi Arabia । আমরা কেউই এই নামে আপত্তি করিনি।’ অনাকাঙ্খিতভাবে সমাপ্ত হয়ে যাওয়া দু’নেতা বেরিয়ে যান, বঙ্গবন্ধু বের হতে হতে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘লা-কুম দ্বীন-কুম ওয়াল-ইয়া দ্বীন’ অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার।
২.
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের করাচিতে আইন পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সকল ধর্মের সমতা বিধান প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ দেশ ইসলাম, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই থাকবে এবং বাংলাদেশও থাকবে। হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর গত এক দশকে যে অত্যাচার হয়েছে তারও অবসান হবে।
৩.
১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে শাসনতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য অংশে ইসলাম ও সংখ্যালঘু সম্পর্কে বলা হয় খ) ‘সংখ্যালঘুরা আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সমান অধিকার ভোগ করবে। নিজেদের ধর্ম পালন ও প্রচার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনায় এবং নিজ নিজ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের অধিকার শাসনতান্ত্রিকভাবে রক্ষা করা হবে। স্বীয় ধর্ম ব্যতীত অন্য যে কোনো ধর্ম প্রচারের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তিকে কর দিতে বাধ্য করা হবে না। নিজ ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলে কোনো ব্যক্তিকে ধর্মসম্পর্কীয় কোনো নির্দেশ গ্রহণ অথবা কোনো ধর্মীয় উপাসনা বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে জোর করা হবে না।’
৪.
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-হিন্দু,-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না।’
৫.
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে ছিল, ‘আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ—যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’
৬.
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, আমি নির্দ্বিধায় উত্তর দিব, হ্যাঁ আমি মুসলিম এবং ধর্মনিরপেক্ষ। আমি এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং এটাও পূর্ণ ঈমানের সাথে বিশ্বাস করি যে, হযরত মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। আমি মদিনা সনদের সেই অমিয় বাণীও অনুসরণ করি জীবনে। সনদের চার নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে, কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।’ শেখ মুজিবুর রহমান মনে প্রাণে এটিকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন।
৭.
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের ২৫৮ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না এ ধারণা অনেককেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছেন, যারা সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করে এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনদিন কোন রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান।’
উপমহাদেশ তথা বিশেষ করে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার মেঘ বেশ কালো হয়ে উঠেছিলো। দেশ বিভাগের পর থেকেই নিজ দেশের সংখ্যালঘুরা সব সময়ই তটস্ত থেকেছে। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। পৃথক নির্বাচনসংক্রান্ত প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ যদি আমরা হিন্দু সংখ্যালঘুদের সমানভাবে গ্রহণ করে বিচার করি, দুনিয়ায় তাহলে বলতে পারব, হিন্দুস্তানে মি. নেহরু এবং মি. রাজেন্দ্র প্রসাদকে বলতে পারব, ডু জাস্টিস টু দ্য মাইনরিটিজ অব ইয়োর কান্ট্রি’ (স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড)। অর্থাৎ তোমরা সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায় বিচার করো…।
সাম্প্রতিকালে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের, সৈনিকদের, আদর্শধারীদের দ্বারা যে হারে সাম্প্রদায়িক ঘটনার অবতারণা হয়ে চলেছে, তাতে সন্দেহের দানা বাঁধে; সত্যিই কী তারা শ্রেষ্ঠ বাঙালির রাজনৈতিক দর্শনকে হৃদয়ে ধারণ করে! তথ্য-উপাত্ততে বার বার হোঁচট খেতে হয়। বঙ্গবন্ধু দেশের জনসাধারণকে ‘ভাই’ সম্বোধন করতেন, কতো আপন, কতো নিকটের; মানুষ হিসেবে মানুষকে গ্রহণ করার মানসিকতা অর্জন করতে হয়। কোটি কোটি মানুষের হৃদয় সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন, তাইতো তিনি বঙ্গবন্ধু। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা শেখ মুজিব (সৈয়দ মুজতবা আলী আর সন্তোষ কুমার ঘোষের সাথে আলাপকালে বলেছিলেন, কোলকাতার দৈনিক যুগান্তর ২৯ নভেম্বর ১৯৭২) পূর্বাহ্নেই বলেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ ও সেক্যুলার বাঙালি জাতির অস্তিত্বের রক্ষাকারী হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি এই ধর্মনিরপেক্ষতার চারা বাংলাদেশের মাটিতে পুুঁতে রেখে গেলাম। যদি কেউ এই চারা উৎপাটন করে, তাহলে বাঙালি জাতির স্বাধীন অস্তিত্বই সে বিপন্ন করবে।’ আসুন, বঙ্গবন্ধুর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে, শান্তি ও সৌহার্দ্যকে ধারণ করি। আমরা সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায় বিচার করি।
মিথুশিলাক মুরমু : গবেষক ও লেখক।