নব আনন্দে বিমল ছন্দে
বন্দী তোমারে আদরে;
হে নব অতিথি, মঙ্গলগীতি
মরমে মধুর ঝংকারে।
… … …
রাজ অধিরাজ গোয়ালে শয়ন,
কোথা আজি তব রত্ন সিংহাসন
এস এ হৃদয়ে, পুজিব যতনে
ভক্তি কুসুম সম্ভারে।
―বিলাসচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
পরম মানব আমাদের মুক্তিদাতা প্রভু যীশু খ্রীষ্টের স্বর্গ থেকে মর্তে আগমন অর্থাৎ মানব রূপে আমাদের মুক্তির জন্য এই পৃথিবীতে আগমন। এই আগমনী দিন অর্থাৎ যীশু খ্রীষ্টের এই জন্মদিনে সবাইকেই শুভেচ্ছা। শুভ বড়দিন। আজকের এই দিনে মানে ২৫ শে ডিসেম্বর পৃথিবীর সকল দেশেই এই আগমনী উৎসব পালন করা হচ্ছে।
আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের মৃত্যুর পরেও প্রায় ৩০০ বছর এই জন্মদিন পালন করা হয়নি। তখন শুধু পুনরুত্থান পালন করা হতো। মানে মৃত্যু থেকে জীবিত হওয়ার দিন পালন করা হতো। তাই তো সেই সময় সবচেয়ে বড় পর্বই ছিল পুনরুত্থান। ৩০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩৬৫ দিনের ১৩৫ দিনই যীশুর জন্মদিন ও পুনরুত্থান দিন পালন করা হতো। আর সেটা বিভিন্ন মাসের বিভিন্ন তারিখেই করা হতো। একসময় রোম সম্রাট কন্সটানটাইন যীশুর নিদিষ্ট জন্মদিন ধার্য করতে চাইলেন। সেই সময়টা ছিল পৌত্তলিক আমল। আর তখন পৌত্তলিকরা ১৭-২৩ ডিসেম্বর সূর্যদেবের উৎসব পালন করতো। কন্সটানটাইন যখন খ্রীষ্টকে হৃদয়ে গ্রহণ করলেন আর তখন তিনি ১৭-২৩ ডিসেম্বরই যীশুর জন্মদিন পালন করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তাই করতে শুরু করলেন। এতে অনেক মতবিরোধ দেখা দিলে অনেকে সেই অনুষ্ঠানে আসতেন না। কেননা সেটা ছিল একমাত্র পৌত্তলিকদের জন্য অনুষ্ঠান। তখন সর্বশেষ ৩৬১ খ্রীষ্টাব্দে পোপ জুলিয়াস ২৫ শে ডিসেম্বরকে ধার্য করেন বড়দিন হিসেবে যা আজও চলছে।
আজ সেই দিন, শুভ বড় দিন, ভালোবাসার দিন, অন্যকে নিজের সর্বোচ্চ ভালোটুকুই দেওয়ার দিন। কেননা ঈশ্বর তাঁর সর্বোচ্চ ভালোটুকুই আমাদের দিয়েছিলেন সম্ভাব্য এই দিনেই। তাঁর নিজে সন্তানকে উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের পাপ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে। ঈশ্বর যুগে যুগে কত ব্যবস্থাই না পাঠিয়েছেন কিন্তু তার সব কিছুই যেন মানুষের পালন করা খুবই কঠিন। আর তাই তিনি এই সহজ পথটা পাঠালেন অর্থাৎ নিজের সন্তান কে এই পৃথিবীতে পাঠালেন। তাঁর সৃষ্টি এই মানুষের জন্য তিনি কতোই না চিন্তা করেন। ঈশ্বর যেহেতু তাঁর সব থেকে ভালোটুকু আমাদের জন্য দিয়েছেন তাই তো আমাদেরকেও তাই করতে হবে। মানে নিজের সর্বোচ্চ ভালোটুকুই বিলিয়ে দিতে হবে, যেন তিনি সন্তুষ্ট হন। আর তবেই হবে আমাদের বড়দিনের সার্র্থকতা।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন আজ তাঁর জন্মদিন, আর একথা কি বলবো পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে? অন্তরে যে দিনটা ধরা পড়ে না, সেই দিনের উপলব্ধি কি কাল গণনায় পাওয়া যায়? যে দিনটা সত্যের নামে ত্যাগ করেছি। যে দিনটা অকৃত্রিম প্রেমের। আর সেই প্রেমের কারণে মানষুকে ঘৃণা না করে ভাই বলে বুকে তুলতে পেরেছি। সেই দিনই তো পিতার—পুত্র আমার জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন। আর তাই তো সেই দিনই বড়দিন। আর তা যে মাসের যে দিনই হোক না কেন। আসলে আমরা যেদিন অন্য কোনো মানুষকে নিজের বুকে নিজের করে তুলতে পারবো আমাদের জন্য সেটাই হবে বড়দিন।
বড়দিন অর্থ মহা ত্যাগের দিন বা ত্যাগের ফসল তোলার দিন এইটা। পিতা ঈশ্বর তার সন্তান প্রভু যীশুকে পৃথিবীর সব মানুষের জন্য বলি উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত করলেন। আর সবচেয়ে যিনি বেশি ত্যাগ করেছেন তিনি হলেন ঈশ্বর নিজেই। আমাদের জাগতিক বাবা-মায়ের পক্ষে কি তা সম্ভব? কখনোই নয়। যেমন লেখা আছে যোহন ৩ : ১৬ কারণ ঈশ্বর জগৎকে এমন প্রেম করলেন যে তাঁর একজাত পুত্রকে দান করলেন, যেন যে কেউ তাঁকে বিশ্বাস করে সে বিনষ্ট না হয় কিন্তু অনন্ত জীবন পায়। আর এটাই হলো বড়দিন। অনন্ত জীবন পাওয়ার দিন। যদি আমি হৃদয়ে বিশ্বাস করি ও মুখে স্বীকার করি যে তিনি আমাদের পাপের জন্য মরেছেন এবং কবরস্থ হয়েছেন এবং তিন দিন পরে মৃত্যুকে জয় করে কবর থেকে উঠেছেন। চল্লিশ দিন তিনি এই পৃথিবীতে অনেকের সাথে দেখা দিয়ে স্বর্গে উঠে গেছেন এবং এখন তিনি ঈশ্বরের ডান দিকে বসে আছেন। তিনি আবার আসবেন আমরা যারা বিশ্বাসী তাদেরকে নিতে। আর তাই তো এই দিনে সকল ভাব অহংকার ত্যাগ করে সাধারণের সাথে এক হওয়ার বা নীচে নেমে আসার দিন।
আমরা বড়দিনকে নম্রতার প্রতিক ও সমর্পণকারীর দিন হিসেবেও বলতে পারি। কেননা মরিয়মের সেই নম্রতা ও সেই ত্যাগ তাই প্রমাণ করে। কেননা সেই সময় মরিয়মের প্রাপ্য শাস্তি ছিল পাথরের আঘাতে মৃত্যু। আর তা তিনি জানতেন। আর জেনেও নম্রতার সুরে দূতকে বললেন। আমি প্রভুর দাসী আপনার বাক্যানুসারে আমার প্রতি ঘটুক। তাই তো মরিয়মের মতোই আমাদেরকে জীবনের সব থেকে বড় বিপদ জেনেও নম্র থাকতে হবে। আবার বড়দিন হলো পূর্ণ বিশ্বাসের দিন। কেননা যোশেপের মতো মানুষ ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আনলেন। আর যেটা ছিল তার জন্যেও সেই সময় খুবই খুবই কষ্ট কর। ভাবতে পারেন আপনি হলে কী করতেন। আবার এটা সাধারণ মানুষদের সম্মানের দিন কেননা মুক্তিদাতার সংবাদ প্রথমে রাখালরাই পেয়েছিল। আমরা যাদের অবজ্ঞা ও অবহেলা করি সব সময়। যারা অবহেলিত তারাই প্রথমে জানলো যে মুক্তিদাতা জন্ম নিয়েছে। আবার তাও আবার গোয়াল ঘরে।
মাদার টেরেজা কি বলেছেন জানে? তিনি বলেছেন, ‘আমি যখন পরম মমতায় কুষ্ঠ রোগীর সেবা করি। তাদের ক্ষতগুলো মুছিয়ে ঔষধ লাগিয়ে দিই। তখন মনে করি যে আমি যীশুরই সেবা করছি।’ আমরা কতজন এমন মানসিকতা নিয়ে এই বড়দিন পালন করি? আমাদের মধ্যে কতজনেরই বা সেবার মানসিকতা আছে। আসলে যার যার জায়গা থেকে নিজ নিজ কাজেই অন্যের সেবা করা সম্ভব। আজকের এই বড়দিনে আমাদের হৃদয়কে গড়ে তুলতে হবে নতুন আঙ্গিকে, নতুনভাবে। মনের অন্ধকার দূর করে আলো জ্বালাতে হবে, যেন সেই আলো অন্য সবাই দেখতে পায় এবং তারাও আলোকিত হতে পারে। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন। আর আমাদের মনে উদয় হোক অকৃত্রিম ভালোবাসা। উপচে পড়–ক আমাদের জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি। ঈশ্বর আমাদেরকে মনের দুয়ার খুলতে সাহায্য করুন।