বর্তমান শিক্ষা জীবনমুখী নয়। এতে জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় নেই। ফলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে না। শুধু তাই নয় শিক্ষা ব্যবস্থা জীবন বিমুখ হওয়ায় বেকারত্বও বাড়ছে। সম্প্রতি শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিবর্তনের কথা শোনা যাচ্ছে তা শিক্ষার্থীদের কীভাবে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করবে, বেকারত্ব দূর হবে, বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ তৈরি হবে সব শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের মৌলিক দিক সম্পর্কে ভালভাবে বুঝতে ও জানতে পারে সে বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রেখে কোর্স ক্যারিকুলাম তৈরি করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এবং বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ হিসাবে গড়ে উঠবে তেমনি তারা শিকড় থেকে শিখরে উঠতে পারবে যা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় অত্যন্ত কঠিন।
বর্তমান সরকার যে নতুন করে শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছেন এবং ইতিমধ্যে পাইলটিং বা পরিক্ষামূলকভাবে দেশের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। নতুন এই শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ও বিশ্বমানের নাগরিক তৈরি করা। বর্তমান যে শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান তা নিয়ে অভিজ্ঞ, জ্ঞানী-গুণী ও শিক্ষাবিদদের মাঝে নানা ধরনের প্রশ্ন থাকলেও দেশে শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ। পাশ করা ও শিক্ষিত হওয়া যে এক কথা নয় এটা আমরা স্বীকার করতে চাই না। পাশের হার দেখে আমরা উৎফুল্ল হই। ভাবি শিক্ষায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পাশ ও মেধার বিকাশকে এক করে ফেলি। আমরা শিক্ষায় আপোস করলেও উন্নত রাষ্ট্র কখনও তা করে না। তবে কি সরকার শিক্ষার আপোস থেকে বেরিয়ে এসে একটি নতুন শিক্ষাক্রম চালু করছেন। যদিও এ নতুন শিক্ষাক্রম ইতিবাচক কিছু বিষয়ের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষায়। যেহেতু মাধ্যমিক পর্যায়ে কোনো বিভাজন থাকছে না তাই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যারা বিজ্ঞান পড়বে তাদের পক্ষে সীমিত জ্ঞান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞানের বিষয় গুলো আয়ত্ব করা কঠিন হতে পারে যা শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারাবে। তাই এই সমস্যগুলোকে সমনে রেখে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা দরকার।
বিখ্যাত মনীষী এফএইচ হারবিসন বলেছেন, মূলধন, আয় এবং ভৌত সম্পদের কোনোটাই একটি জাতির সম্পদ নয়। শুধু মানব সম্পদই একটি জাতির আসল সম্পদ হিসেবে পরিগণিত। মূলত শিক্ষাই একটি জাতিকে মেধা মনন সৃজনশীলতায় দক্ষমানব সম্পদে পরিণত করতে পারে। সমকালীন বিশ্বে মেধা মনন, জ্ঞানের যে বিস্তরণ ঘটেছে এর মূলে শিক্ষা। একটা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। কারণ একমাত্র শিক্ষাই একটি জাতির অগ্রগতির মূল সোপান। জাতীয় জীবনের অগ্রগতির মূলমন্ত্র হচ্ছে শিক্ষা। বিশ্বায়নের এ যুগে সমাজ ও যুগের প্রতি লক্ষ রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে শিক্ষার মনোন্নয়নের দিকে অবশ্যই নজর দিতে হয় যা প্রতিটি রাষ্ট্র এভাবেই শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করে। শিক্ষা পদ্ধতির মূল লক্ষ্য এর সুফল পাওয়া। এ কারণেই শিক্ষা নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। শিক্ষাই হচ্ছে চলমান প্রক্রিয়া। সংবিধান যেমন পরিবর্তনযোগ্য, তেমনি শিক্ষা পদ্ধতিও। যখন কোনো রাষ্ট্রে নতুন এক ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে তখন এ ব্যবস্থাকে কিভাবে ফলপ্রসু করা যায় কিভাবে আরও অর্থবহ করা যায় সেদিকে অবশ্যই রাষ্ট্রকে নজর দিতে হয়।
শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত কচিকাঁচা শিশু, কিশোরের দিকে লক্ষ রেখে পাঠ্যপুস্তুক প্রণয়ন করতে হয় যাতে করে বইয়ের বোঝা যেন তাদের বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কারণ বিদ্যে কোনো গেলানো বস্তু নয়, অর্জনের বিষয়। তাই জোর করে কোনো বিষয় চাপিয়ে দিয়ে তা থেকে সুফল অর্জন করা যায় না। সেচ্ছায় যা কিছু করা যায় এর ফল হয় দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু চাপিয়ে দিয়ে এর ফল দীর্ঘস্থায়ী হয় না তা যেকোনো মুহূর্তে ভুলে যেতে পারে। শিখনফল স্থায়ী করতে হলে অবশ্যই শিক্ষার্থীর গ্রহণ করার সক্ষমতার দিকে নজর দেয় জরুরি। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জিত হচ্ছে না বলে অনেক শিক্ষাবিদরা মনে করেন।
বইয়ের আধিক্য কখনো শিক্ষার গুণগত মান বাড়াবে না। আমরা চাই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পৃথিবী জয় করুক। মেধা সম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে উঠুক। আর শিক্ষা হচ্ছে অর্জনের বিষয় তাই এই অর্জনটা নির্ভর করে একজন শিশুর মনের ধারণ ক্ষমতার ওপর।
তাই শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত কচিকাঁচা শিশু-কিশোরদের বয়স, ধারণ ক্ষমতার দিকে লক্ষ রেখে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন করতে হয় যাতে করে বইয়ের বোঝা তাদের বিকাশ ও জ্ঞানার্জনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। একটি বিষয় আমাদের গুরুত্ব দেয় উচিত যে জ্ঞানই যেহেতু শ্রেষ্ঠ সম্পদ তাই তা অর্জনের পথ যেন সহজ হয়, সরল হয়।
আমেরিকার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ন্যাশনাল সেন্টার অব এডুকেশনের এক গবেষণার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিশুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তাদেরকে মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দেয়। এ চাপ বলতে মানসিক, পড়াশুনা বিষয়ক। পারিবারিক, সামজিক, সব ধরনের চাপ বোঝানো হয়েছে। এ গবেষণায় বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে বেশি চাপ অনুভূত হয়েছে পড়াশুনার চাপ। তাই এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, আজকের শিশুদের ওপর যেভাবে ওপর যেভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে পড়াশুনার ক্ষেত্রে তাতে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একটি বিষয়ে আমরা অনেকেই গুরুত্ব দিতে চাই না যে, শুধুমাত্র পুঁথিগুত বিদ্যায় যে কোনো বয়সের শিক্ষার্থী মানসিক বিকাশ পরিপূর্ণতা পায় না। আর মানসিক বিকাশ যদি বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে শিশুরা বেশিদূর যেতে পারবে না। আমাদের শিশুদের নিয়ে যে, স্বপ্ন রয়েছে তা বাস্তবায়নে শিশুদের চলার স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করা সমীচীন নয়। তাই নতুন শিক্ষাক্রম যেন সব ধরনের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনে সহজতর হয় সে দিকটা চাপিয়ে দেবার বিষয় নয়। শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক হওয়া উচিত। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা বিভিন্ন বিষয়গুলো সহজ সরল, প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত হওয়া দরকার। তাই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে এ প্রসঙ্গে বিশ্ব কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, সহজ, সরল কোমলমতি শিশুদের জন্য কোনো রচনা শিশুর মতোই সহজ, সরল হওয়া দরকার। নয়তো প-শ্রম হয়।
শিশুতোষ সাহিত্য ভাষাগত দিক দিয়ে যেমন সহজ সরল হওয়ার দাবি রাখে, বিষয় বৈগুন্যেও তেমনি সহজ সরল হওয়া চাই। শিশু লেখার অর্থ খুঁজে না, যুক্তি-তর্কের ধার ধারে না। সে বিস্মিত হতে জানে আনন্দ পেতে জানে, বসে বসে লাভ লোকসানের অঙ্ক কষে না তাতেই তার সার্থকতা সে গভীর ভাবের কোনো কবিতা পছন্দ করে না। তার পছন্দ হালকা চালের লঘু ছন্দের ছড়া। কিন্তু তাদের তো বইয়ের বোঝা, প্রাইভেট কোচিংয়ে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে শিশুদের শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে যারা আমাদের আশার প্রদীপ, ভবিষ্যতে তারা আমাদের দেশকে আলোকিত করবে। জ্ঞানই হচ্ছে সম্পদ, আবার জ্ঞানই হচ্ছে শক্তি। তাই সে জ্ঞান ও শক্তির আধারে পরিণত করতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ শিশুদের, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। তাই রাষ্ট্রকেই শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা ও শিকড় থেকে শিখরে উঠার অনুকূল পরিবেশও সর্বজনীন শিক্ষাক্রম (শিক্ষার্থী) তৈরি করতে হবে। আমাদের লাখ শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যেতে হবে জ্ঞান, মেধা অর্জনের সামনের দিকে। আমাদের মনে রাখতে হবে পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক কথা নয়। আমাদের ভাষা শিক্ষা সংস্কৃতিতে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে হবে এবং নিজেকে বিকশিত প্রতিষ্ঠিত করতে হবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে। আমাদের লাখ শিক্ষার্থী শিকড় থেকে শিখরে উঠে এবং বাণিজ্যকরণের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সরকারি নজরদারি বাড়ানো দরকার। একজন শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস ও মনের জোর বাড়াতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা মনের জোর বাড়ানো যায়। নতুন শিক্ষাক্রম ভবিষ্যতে আমাদের প্রজন্মকে নতুন ও ভালো কিছু দিতে পারে না। তারা শিখরে উঠতে পারে।
শিক্ষার্থীর মনের জোর আত্মবিশ্বাস মেধা বিকাশের সহায়ক। একাজগুলো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠ্য দানে জাগ্রত করা যায়। সারা বিশ্বে যেসব দেশ আজ মাথা উঁচু করে আছে এবং সামাজিকভাবে উন্নতি করেছে সেসব দেশে বরাবরই শিক্ষার মান ছিলো ভালো। ভারত, নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকার উন্নতির মূলে রয়েছে শিক্ষার মান ও উন্নত ধরনের শিক্ষা পদ্বতি। সেসব দেশেও প্রায় শতভাগ পাশের চিত্র রয়েছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার মান এতটা উন্নত যে, একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত পক্ষেই মেধা, সৃজনশীলতা অর্জন করে নিজেকে প্রস্তুত করেছে প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে টিকে থাকার লড়াইয়ে। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে বহির্বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে শতভাগ পাশ আমাদের শিক্ষার মান হয়েছে নিম্নমুখী। কিন্তু উন্নত রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষার মানের প্রশ্নে তারা কোনদিন আপোষ করেননি।
সবার আগে শিশুদের নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ এরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই আমাদের শিক্ষাথীরা যেন নতুন শিক্ষাক্রমে শিকড় থেকে শিখরে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে শিক্ষায় সব ধরনের অনিয়ম দূর করা যেমন জরুরি তেমনি কোর্স ক্যারিকুলাম সে লক্ষ্যেই প্রণয়ন হওয়া বাঞ্চনীয়।
মোহাম্মদ নজাবত আলী : শিক্ষক ও কলাম লেখক।