বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যেও মানুষের মধ্যে সামান্যতম অপরাধবোধ কমেনি। জাতীয় পর্যায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য প্রমাণাদির পরিচয় সেটিই বহন করে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, সাত মাসে ১৭ ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়ে মারা গেছেন, হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ১০ জনকে, হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ১১ জনকে, ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩০ জনের ওপর, শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়েছে ৬ জনের, এ কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন, জোরপূর্বক অপহরণ করা হয়েছে ২৩ জনকে, ভাঙচুর করা হয়েছে ২৭টি প্রতিমা, নিখোঁজ রয়েছেন ৩ জন। স্বল্পতম সময়ে ২৩টি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে, জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ করা হয়েছে ৭ জনকে, বসতভিটা ও শ্মশান দখলের চেষ্টা করা হয়েছে ৭৩ বার, পুরোপুরি দখল হয়েছে ২৬টি, গ্রামছাড়া করা হয়েছে ৬০ টি পরিবারকে ও দেশত্যাগের হুমকি দেওয়া হয়েছে ৩৪ জনকে।
আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম এক নেতা অভিযোগের সুরেই বলেছেন, ‘বর্তমানে আদিবাসীদের জীবন সংকটাপূর্ণ হয়ে পড়েছে এবং তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে চরম অবনতি ঘটছে। আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সময় আদিবাসীদের অত্যাচার, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, জাল-দলিল, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, মিথ্যা মামলা, লুটপাট জবর দখল, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ নানা নির্যতান নিপীড়িনের শিকার হয়ে আজ তারা সর্বশান্ত ও ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা বারবার ঘটছে। আদিবাসীরা এখন নিজ দেশে পরবাসীর ন্যায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। আদিবাসীদের ওপর নিপীড়িন, ভূমি দখল, উচ্ছেদ, ধর্ষণ, হত্যা মামলায় থানা পুলিশ, স্থানীয় অসৎ জনপ্রতিনিধি ও ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীদের পক্ষাবলম্বন করে সহায়তা করে আসছে। ফলে আদিবাসীরা আরও অসহায় হয়ে পড়েছে।’ আদিবাসী সাঁওতাল, উরাঁও অধ্যুষিত অঞ্চলের প্রাণপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি বর্তমান মন্ত্রীপরিষদের অন্যতম সদস্য খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার এমপি নির্বাচনী এলাকায় বক্তব্যেও আমাদের প্রতি সংকেত বহন করে। তিনি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা থাকলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, আমাদের ইজ্জত সম্মান আছে, শেখ হাসিনা না থাকলে আওয়ামী লীগ নেই, আমাদেরও অস্তিত্ব থাকবে না’ (সোনার দেশ ৭.১১.২০২০)।
পর্বত পাদদেশের জেলা কক্সবাজারের মেয়ে লাকিংমে চাকমা। পরিবারের সাথে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর পাওয়া যায় হাসপাতালে, জীবিত নয় মৃত। সপ্তম শ্রেণীর মেয়ে লাকিংমের পরিবার টেকনাফ শীলখালীর চাকমাপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। চর্তুদশী মেয়ে লাকিংমে ভালোবাসার জালের ফাঁদে পড়ে শিকার হয়েছে বাল্যবিবাহের, বছরান্তে জন্ম দিয়েছে আরেক শিশুর। পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ হাফেজকে অবহিত করা হয়েছিল; অপরদিকে এই ইউপি সদস্যের সুপারিশেই স্থানীয় চেয়ারম্যান বয়স বাড়িয়ে সনদপত্র হস্তান্তর করেছেন। মেয়েটির বাবা লালা অং চাকমা খোঁজাখুজির পরও সন্তানের হদিস না মেলাতে টেকনাফ মডেল থানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন, থানাও তার বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হয়নি। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি। পরবর্তীকালে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। সত্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে দায়িত্ব প্রদান করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। পিবিআই’য়ের প্রাপ্ত প্রতিবেদনে মেয়েটি নিজে চলে গেছে বলেই উল্লেখ করা হয়। কারণ হিসেবে পুলিশ কর্মকর্তা যুক্তি খাড়া করেছেন, যারা এ অপহরণের সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা মেয়েটির আত্মীয়। অপহৃতের সময়কালীনই লাকিংমে’কে ধর্মান্তরিত করা হয়।
একজন সচেতন পাঠক লক্ষ করলেই বুঝবেন যে, কতগুলো প্রশ্ন উদয় হয়েছে! নিজেকে প্রশ্ন করি, আমার-আমাদের ক্ষেত্রে এরূপ ব্যবহার করা হলে আমরা কী করতাম! সত্যিই একজন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু হলে এ দেশে তার পরিণতি কী হতে পারে, এটিও অন্যতম দৃষ্টান্ত। আমাদের বিশ^াস করতে কষ্ট হয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন কিংবা এলিট সদস্যদের নিয়ে গঠিত পিবিআই’য়ের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা বির্তকের জন্ম দিয়েছে। সবচেয়ে যে বিষয়টি আমাদেরকে বাক্রুদ্ধ করেছে, সেটি হলো ধর্মান্তরকরণ। আমার দেশের পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়োপ্রাপ্ত না হলে তাকে সাবালকত্ব হিসেবে গণ্য করা হয় না। ছেলে হোক মেয়ে হোক তার ভোটাধিকারও রীতিসিদ্ধ নয়। অর্থাৎ ছেলেমেয়েদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতা, নিজে নিজের কোনো বিষয়েই অভিভাবকের সম্মতি ব্যতিরেকে গ্রহণীয় নয়। মা-বাবা কিংবা অভিভাবক হিসেবে সমাজের ধারাবাহিকতায় যিনি দায়িত্ববান হয়ে থাকেন; অবশ্যই তার জানা আবশ্যিক।
এক্ষেত্রে যারাই ধর্মান্তকরণের প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত, প্রত্যেকেই আইনের আওতায় অভিযুক্ত এবং রাষ্ট্রকেই এ দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রীয় আইনকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা করার যে রীতি প্রচলিত হচ্ছে; এখনই সেটিকে শক্ত হাতে প্রতিহত করা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। লাকিংমে চাকমার অপমৃত্যু পুনঃ তদন্ত ও প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানবাধিকার সংগঠন, সামাজিক সংগঠন ও উন্নয়ন সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। লাকিংমে’র ঘটনা আমাদের অন্তর্দৃষ্টি উম্মোচন করেছে, পাহাড়ের কোণায় কোণায় নীরবে-নিভৃতে চলছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া। সংবিধানের ৪১. ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে’। অর্থাৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়, অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষকে নয়; এটি হতে হবে অবশ্যই সানুগ্রহে, আনন্দে ও ভালোবেসে।
পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কান্নার ধ্বনি ক্রমশই গুমরে গুমরে উঠছে, রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে সবুজ বেষ্টনীর প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। আভ্যন্তরীণ কোন্দাল, জাতিগত অসহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয়-রাজনৈতিক আধিপত্যের ত্রিমুখী লড়ায়ে সাধারণ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এক প্রকার অসহায় হয়ে পড়েছে। বহুল আলোচিত কল্পনা চাকমা’র অন্তর্ধান থেকে শুরু করে লাকিংমে’র অপমৃত্যু আমাদের প্রত্যেককের বিবেককেই নাড়া দিয়েছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন না হলে হৃদয়াকাশের পাহাড় অশান্ত থাকবে; হয়ত অশান্ত হৃদয়কে বোঝাতেই সীমান্ত অতিক্রম করতেও পিছপা হবে না। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করি, প্রতিটি ঘটনার রহস্যজাল উদ্ঘাটিত হোক, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আস্থার জায়গাটি বিনির্মাণে সরকার সর্বোচ্চ দৃষ্টি প্রদান করবেন।
মিথুশিলাক মুরমু : গবেষক ও লেখক।