ডেড লাইন ১০ ডিসেম্বর। আমান উল্লাহ আমান বলেছে ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়। তার এ ঘোষণার পর লুৎফর রহমান রিটনের একটি ছড়া মনে পড়ে গেল—সম্ভবত তিনি ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চ চলাকালীন ছড়াটি লিখেছিলেন। ছড়াটির শিরোনাম মন নেই তবে ছড়ার প্রথম দুইটি পঙ্ক্তি মনে আছে, যা এমন—
আমান উল্লাহ আমান, খালেদা জিয়ার কামান
ম্যাডাম আপনার কামান থামান।
তখনও আমান সাহেব হুঙ্কার ছেড়ে আওয়ামীলীগকে গালাগালি করতেন এর প্রেক্ষিতেই হয়ত ছড়াটি লিখেছিলেন। সে যা ই হোক দীর্ঘ দিন থেকেই দেশবাসী বিএনপির সরকার পতনের হাকডাক শুনে আসছে, কিন্তু গর্জনই সার, বর্ষণ আর হচ্ছে না। এবার যেহেতু একটা ডেডলাইন দিয়েছেন নিশ্চয়ই আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন। এবার একটা কিছু হবে বলে আশা করা যায়। দেশবাসী তাই ১০ ডিসেম্বর ডেডলাইনের অপেক্ষায় আছে, দেখা যাক কী হয়। তবে দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা এখানেও নানা খুঁঁত খুঁজছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেখলাম অনেকেই আমান উল্লাহ আমানের ডেডলাইনের ঘোষণার ছবিটি ট্রল করে প্রশ্ন রেখেছেন—‘‘কোন সালের ডিসেম্বর?’’
তবে আমি এমনটা তা মনে করি না। কেননা, বিএনপি হয়ত দেশের বা বিদেশের কারো কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েই ১০ ডিসেম্বরের ডেডলাইন দিয়েছেন। এই বক্তব্যের ধারাবাহিক সুর শোনা গেল দলটির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর কণ্ঠে। এ্যানী বলেছেন, ১০ ডিসেম্বর থেকেই সরকার আর কাজ করবে না। দেশ চলবে বিএনপির শীর্ষ নেতার কথায়। আমানউল্লাহ আমান এবং শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বিএনপির সিনিয়র নেতা তাদের কণ্ঠের এমন কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আমার এক বন্ধুর এ প্রসঙ্গে একটি কথা মোটেই হেলাফেলার নয়, তিনি বলেন, ‘‘রান না পেতে পেতে একজন ব্যাটার যখন হতাশায় ভোগেন, এবং রাগে ক্ষোভে উল্টাপাল্টা ব্যাট চালিয়ে আউট হয়ে যান। তেমনি বিএনপি প্রায় চৌদ্দ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে হতাশায় ভুগছে।’’ বন্ধুটির কথায় যুক্তি আছে তবে তা হয়ত কথার কথা। এই প্রসঙ্গ এখন থাক।
বাংলাদেশে ডেডলাইন দিয়ে সরকার পতনের ঘোষণা নতুন নয়। এর আগেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ৩০ এপ্রিল সরকার পতনের ডেডলাইন ঘোষণা করেছিলেন। এই সময়ে তার ট্রাম্পকার্ড তত্ত্ব রাজনীতিতে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই হয়নি। সেই ডেডলাইনের দিন তারেক-কোকো এবং হাওয়া ভবনের কুশিলবরা রাস্তায় ক্রিকেট খেলে জলিল সাহেবের ডেডলাইনকে উপহাস করেছিলেন।
একইভাবে এবারও বিএনপি নেতারা ১০ ডিসেম্বর কী করতে চান তা অস্পষ্ট এবং রাজনীতিতে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। তবে বিএনপির একাধিক নেতা সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে যেয়ে বলেছেন যে, একাধিক কর্মসূচির মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে আন্দোলনকে একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চান। তাদের যে পরিকল্পনা তার মধ্যে রয়েছে—
১০ ডিসেম্বরের আগে সরকারের ওপর ব্যাপক আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন যে, আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করলে সরকার একটি দুর্বল অবস্থায় পড়বে এবং এই দুর্বলতার কারণেই হয়ত শেষ পর্যন্ত সরকার পদত্যাগে বাধ্য হবে। তবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত যে অগ্রগতি হয়েছে সেই অগ্রগতিতে বিএনপি নেতারাই সন্তুষ্ট নয়। বরং বিএনপি মনে করছে যে, আন্তর্জাতিক চাপ যেন বৃদ্ধি পায় এজন্য আন্তর্জাতিক পরিম-লে যোগাযোগ করতে হবে। বিএনপি আশা করছে যে, ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে বড়ো ধরনের চাপ প্রয়োগ করবে এবং এই চাপগুলো যদি শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে তাহলে সরকারের জন্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
তারা আরও মনে করেন যে সম্প্রতি বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার দিকে যাত্রা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা, আঞ্চলিক রাজনীতি ও বাংলাদেশের শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা চাপে আছে এমন একটি ধারণা দেশের মানুষ তথা নেতাকর্মীদের দিতে চাইছে বিএনপি নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি দেশের অভ্যন্তরে নিজেদের শক্ত অবস্থান দেখানোর মাধ্যমে সরকারকে নমনীয় হতে বাধ্য করতে চাইছে।
তাদের ধারণা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সরকার নমনীয় হয়ে বিএনপির সব দাবি না হলেও নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি মেনে নেবে বলেও আশা করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তাঁদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এমনটা জানা যায়। এমন একটি পরিস্থিতি আগামী ১০ ডিসেম্বরের আগে তৈরি হতে পারে এমন ধারণা বিএনপি ছড়িয়ে দিতে চায়। আর এসব কারণেই বিএনপি ১০ ডিসেম্বরে লক্ষ্য স্থির করেছে। আর এটাই এখন নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার ট্রাম্পকার্ড।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংবাদ প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত বিএনপির প্রস্তাবিত কর্মসূচির জানা গেছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—অবরোধ, লংমার্চ, জেলা থেকে জেলায় রোড মার্চ, ঢাকা থেকে বিভাগীয় শহরে রোড মার্চ, ৬৮ হাজার গ্রামে একই দিন গণমিছিল। নেতাদের প্রস্তাবে আরও রয়েছে, ১০ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার কর্মসূচি প্রদান এবং ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লার নেতারা প্রশাসন ও পুলিশকে চাপের মধ্যে রাখার প্রস্তাব করেছেন।
কোনো কোনো নেতার পরামর্শ—আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘আইনবিরোধী’ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে কেন্দ্রীয় নেতারা যেন সব সমাবেশে তাদের অনুরোধ জানান। তবে সমাবেশে অংশগ্রহণে বাধা পেলে নেতাকর্মীদের প্রতিরোধ করার অনুমতি দেওয়ার জন্যও প্রস্তাব করেছেন বিএনপির তৃণমূল নেতারা। প্রয়োজনে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যুক্ত বলেও প্রচারের প্রস্তাব রয়েছে কোনো কোনো নেতার। এছাড়াও কর্মসূচির মধ্যে নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি রাখার প্রস্তাবও এসেছে জোরালোভাবে।
বিএনপি যে দলীয় কর্মসূচি প্রণয়ন করেছেন একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির এটা রাজনৈতিক অধিকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলে দিয়েছেন বিএনপির কোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা না দিতে, সাথে এ-ও বলে দিয়েছেন যে, বিএনপি যদি ২০১৪ সালের মতো নাশকতা, অগ্নিসন্ত্রাসের মতো হটকারী কর্মসূচি গ্রহণ করে তবে কোনো অবস্থাতেই তাদেরকে ছাড় দেয়া হবে না। তাদের মনে রাখা উচিত এখনও ২০১৪ সালের বিএনপি জামাতের অগ্নিসন্ত্রাসের দাগ মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন রাজনীতিতে বিএনপি শেখ হাসিনার কাছে রাজনৈতিক কৌশল শিখতে হবে প্রধানমন্ত্রী চমৎকার বলে দিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা নয়, গ্রেফতার নয়। আর অমনি বিএনপি ঝাপিয়ে পড়লো রাজপথে। কেন তিনি তা করলেন? আমার মনে হয় বিশ্ববাসীকে এই ম্যাসজে দেয়া সরকার বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো বাধা সৃষ্টি করছে না।
আর রাজনৈতিক কর্মকা-ের আড়ালে যদি আবার বিএনপি জামায়াত ও তাদের মিত্ররা নাশকতা বা ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয় তা হলে তাহলে আওয়ামী লীগের বদলে বিদেশিদের কাছে বিএনপির প্রকৃত মুখোশ উন্মোচিত হবে। তাছাড়া নির্বাচনের এখনো প্রায় ১ বছর ৩/৪ মাস বাকী। এই দীর্ঘ সময়ে আন্দোলনের মাঠে শক্তি ক্ষয় করে বিএনপির দীর্ঘ এই পথ পারি দেবার সামর্থ্য নেই। নির্বাচনের অনেক আগেই শক্তি ক্ষয় করে বিএনপি দরকষাকষির জায়গায়ও থাকতে পারবে না।
তা ছাড়া দলের প্রধান উজিরে আযম ও সেনাপতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামী। কাণ্ডারিবিহীন বিএনপি নিবন্ধনহীন জামাত এবং দুই চার সদস্যের ভূঁইফোড় দল নিয়ে কতটুকু করতে পারবে শেখ হাসিনার তা ভালো করেই জানা আছে তাই তিনি নাটাইয়ের সুতো ঢিলে করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাচ্ছেন তারা কতটুকু এগুতে পারে, সব দেখে শুনে বুঝে অলআউট এ্যাকশনে যেতে চাইছে সরকার। বাংলাদেশের ইতিহাসে গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর মতো বিএনপির কোনো ইতিহাস নেই তারা সবসময় পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে অভ্যস্ত আর তা করে বিভিন্ন অপশক্তির সহায়তায়।
পরিশেষে এই বলেই শেষ করতে চাই যে, সম্প্রতি এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ‘বিএনপি জোট’ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে আমির ডা. শফিকুর রহমান। সেই বক্তব্যের ভিডিও এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা, কৌতূহল ও প্রশ্ন দেখা দেয়। তবে অনেকেই মনে করছেন এটা বিএনপি জামাতের নতুন কৌশল। কেননা, বিএনপিকে অনেক দাতাদেশ জামায়াত ছাড়ার কথা বলেছে। তাই জামাতের আমির ডাক্তার শফিকুর রহমান এই ঘোষণা দিয়েছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ দেশের সচেতন মহল মনে করছেন এই ঘোষণা আইওয়াস ছাড়া কিছু নয়। এর প্রমাণও মিলেছে সম্প্রতি চট্টগ্রামে বিএনপির গণসমাবেশে জামায়াতের নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি দেখে, যা বিভিন্ন পত্রিকার খবরের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হবে।
মাহবুবুল আলম : কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
[কলামটি সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তন বর্ষ ৬, সংখ্যা ৩৩, ২৪ অক্টোবর ২০২২ প্রকাশিত]