বিবিসি’র ২৯ অক্টোবরের তথ্যানুযায়ী, তিন বছর আট মাস পর আবারো হরতাল কর্মসূচিতে ফিরে গেল বিরোধী দল বিএনপি। ২৯ অক্টোবর, ২০২৩ বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকারের পদত্যাগের দাবিতে হরতাল-অবরোধ পালন করেছে, দিনটি ছিল রবিবার। ২৮ অক্টোবর যুগপৎ আন্দোলনে রাজপথে নামলে সরকার কঠোর হস্তে দমন করেন, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২৯-৩০ দেশব্যাপী অবরোধ-হরতাল পালনে বাধ্য করে। অতঃপর নেতা-কর্মীদের মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগের ১ দফা দাবি আদায়ে আবারও দুই দিনের (নভেম্বর ৫-৬) অবরোধ ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ৪৮ ঘণ্টার হরতালে সহমত পোষণ করেছে গণ অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ জামায়েত ইসলাম, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, এনডিপি, এলডিপি, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ, জামিয়াত উলেমা-ই ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এবং গণতন্ত্র মঞ্চ। আলাদাভাবে ৫ নভেম্বর রবিবার চট্টগ্রামে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয়। কয়েক দফা অবরোধ-হরতালের পর ১২-১৩ নভেম্বর ( রবিবার-সোমবার) পুনর্বার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার গঠন, আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানসহ সকল রাজবন্দী এবং ওলামা-মাশায়েখের মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার দাবিতে আবারো অবরোধ-হরতালের আহ্বান জানায়। সরকার পদত্যাগের সকল জল্পনা-কল্পনা ছিন্ন করে ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করলে বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এদিনই নভেম্বর ১৯ ও ২০ তারিখ রবিবার ও সোমবার সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি এবং তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তথ্যানুযায়ী বিএনপি সর্বশেষ হরতাল ডেকেছিলো ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ফলাফল প্রত্যাখ্যানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। আর সেই হরতালের আহ্বান হয়েছিল ৩ বছর ১০ মাস ১১ দিন পর। অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৩ই ডিসেম্বর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছিল বিএনপি।
হরতাল শব্দটিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে — ‘হর’ কথাটি গুজরাটি যার অর্থ প্রত্যহ এবং ‘তাল’ অর্থাৎ তালা; সুতরাং হরতাল শব্দের অর্থ হলো প্রতি দরজায় তালা দেওয়া। বিক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য যানবাহন, হাট-বাজার, দোকান-পাট, অফিস-আদালত ইত্যাদি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করা। বেসরকারি এক হিসাবে দেখা গেছে ১৯৯৬ সালের ৩১ মার্চ থেকে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জাতীয়ভাবে ৩৭বার রোববার হরতাল, ৪১বার রবিবার রাজধানী কেন্দ্রিক, ১৬৬ বার রবিবার আঞ্চলিক ও স্থানীয়ভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। বিগত ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০২ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত ১১বার জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে রবিবার হরতাল পালিত হয়েছ। এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতানেত্রীবৃন্দ প্রায় ২১ বার জাতীয় ও আঞ্চলিক হরতাল পালন করেছে।
খ্রিষ্ট ধর্ম বিশ্বাসীদের সাপ্তাহিক উপাসনার দিন হচ্ছে রবিবার। এ দিনের সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বিভিন্ন সময় গির্জায় খ্রিষ্টানুসারীরা উপস্থিত হয়ে ধর্মীয় উপাসনার রীতি-নীতি পরিপালন করে থাকেন। এ দিন উপাসনায় উপস্থিতি বাধ্যতামূলক না হলেও ঐচ্ছিক নয়। রবিবার হরতাল আহ্বান এড়াতে খ্রিষ্টিয়ান সমাজের নেতৃবৃন্দ প্রেস বিজ্ঞপ্তি, সংবাদপত্রে লেখালেখি এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের সবিনয় অনুরোধ করেছেন কিন্তু আদৌ আপোশহীন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা এই মাইক্রোসকপিক সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকারের প্রতি সামান্যই দৃষ্টিপাত করেছেন। বাংলাদেশে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বাহাই, শিখ, সাংসারেক, সারণা, ক্রামা, অপকোপা, ধার্মেস, সানামাহি প্রভৃতি ধর্ম সম্পর্কে সংবিধানে বলা হয়েছে— ‘…প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলামের শুক্রবার জুম্মার দিনের মতো বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সাপ্তাহিক উপাসনার দিন হলো রবিবার। রবিবার হরতাল-অবরোধ দেশে-বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে। দেশের বিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা হরতাল-অবরোধ আহ্বান করে দেশের পবিত্র সংবিধান ও জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা লঙ্ঘন করে চলেছেন। আমাদের পবিত্র সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদের ১.ক-তে বর্ণিত রয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে। রবিবার হরতাল-অবরোধ করে খ্রিষ্টানুসারীদের পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং হয়েছে। যেমন—গাড়ি-ঘোড়া না থাকার ফলে কেউ চার্চে যেতে পারেন না, আর গেলেও রাস্তা-ঘাটে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। ফলে আমাদের সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ১৮ তে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। নিজ ধর্ম অথবা বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা এবং একাই অথবা অপরের সঙ্গে যোগসাজশে ও প্রকাশ্যে বা গোপনে নিজ ধর্ম বা বিশ্বাস শিক্ষাদান, প্রচার, উপাসনা ও পালনের মাধ্যমে প্রকাশ করার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।’ রবিবার হরতাল-অবরোধ দিয়ে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাকেও অবমাননা করা হচ্ছে।
আরেকটি বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ৭ জানুয়ারি রোববার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করেছে। ইতিপূর্বেও একই ঘটনার অবলোকন করেছি, একাদশতম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রবিবার। দশম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি রবিবার। এটিও খ্রিষ্টানুসারীদের কাছে পীড়াদায়ক। আমরা সর্বদাই শ্রবণ করেছি, ভোটদান হবে উৎসবমুখর পরিবেশে; সেদিন ভোটদানের জন্যই সবাই হৈ হুল্লোড় করবে, সেক্ষেত্রে ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্নের দিকটিও বিবেচনা করা আবশ্যিক।
কিন্তু কেন এই রবিবার? রবিবার হরতালকে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সব সময় সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বাড়তি সুবিধাদি দিতে চেষ্টা করে থাকেন। শুক্রবার-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির সাথে রবিবার হরতাল বা অবরোধ দিলে সর্বমোট ৩ দিন ছুটি দাঁড়ায় এবং কর্মঠ অফিসারগণ বাড়ি কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের সারপ্রাইজ দিয়ে থাকেন। প্রধান বিরোধী দলসহ সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীগণকে সবিনয় অনুরোধ জানাই, দেশের পবিত্র সংবিধান ও মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাকে লঙ্ঘন করবেন না। দয়া করে রবিবারকে হরতাল-অবরোধ মুক্ত রাখুন।
একদা বিশ্বব্যাংক হিসাবে কষেছিল, প্রতিদিন রাজনৈতিক হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ কিংবা অন্য কোনো কারণে একটি কর্মদিবস অফিস-আদালত ও কলকারখানার চাকা বন্ধ থাকলে জাতীয় লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ কোটি মার্কিন ডলার। অতীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, হরতাল-অবরোধ না থাকার সুফল হিসেবে রাজস্ব আয় বেড়েছিল প্রায় ২২ শতাংশ। এমনকি রপ্তানি আয়ও বেড়েছিল প্রায় ২৭ শতাংশ। তারপরও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো হরতালকে গণতান্ত্রিক অধিকার বলে হরতাল ডাক দিয়ে যাচ্ছেন। হরতাল-অবরোধ যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার, তেমনি হরতাল না মানার অধিকারও জনগণের আছে। তাই বলে হুমকি, জোরপূর্বক কিংবা যানবাহনের ক্ষতি এবং ধর্মীয় অধিকারকে ক্ষুন্ন করে হরতাল-অবরোধে বাধ্য করা সুস্থ চিন্তা হতে পারে না। হরতাল-অবরোধের বিকল্প খোঁজ করুন, সরকারের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে দেশবাসী একাত্মতা ঘোষণা করবে।