সাম্প্রতিক সময়ে শিশুদের পাঠ্যবইয়ের কিছু অধ্যায় নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় বেশ সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এর মধ্যে ডারউনের মতবাদটি অন্যতম। এছাড়া আর একটা লোকদাবি উঠেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মন্দির-দেবতার ছবি বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। মুসলিম শাসক ও ধর্ম প্রচারকদের নাকি হেয় করে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। সমালোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু সপ্তম শ্রেণীর বিজ্ঞান বইটি। যে যেভাবে পারছে নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ধর্মপ্রাণ মানুষের দেশ। এই দেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ও মুসলিম সবাই মিলে মিশে বাস করে। উপমহাদেশের মানুষ অনেক বেশি ধর্ম প্রাণ হয়। ধর্মের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা সর্বদা অনেক বেশি থাকে। সেটা সু-দীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে। অনেক সময় দেখা কথায় কথায় আমরা ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ভুলে যাই। সবকিছুতে ধর্মকে মিশিয়ে ফেলি। এটাই কি আমাদের নৈতিকতা, এই কি আমাদের মূল্যেবোধ?
নৈতিকতা, ব্যক্তির ঐচ্ছিক আচরণের ভালোগুণই নৈতিকতা। নীতিবিদ ম্যুরের মতে, শুভের প্রতি অনুরাগ ও অশুভের প্রতি বিরক্তই হলো নৈতিকতা, নৈতিকতা আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, নৈতিকতা সর্বদা সত্যকে সত্য বলে। নৈতিকতা সর্বদা ধর্ম নিরপেক্ষ। সকল ধর্ম নৈতিকতা শেখায়। নৈতিকতার সাথে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কোনো সম্পর্ক নেই। যা আইন বিরোধী তা নৈতিকতা বিরোধী, যা নৈতিকতা বিরোধী তা আইন বিরোধী নাও হতে পারে। নৈতিকতা একজন ব্যক্তির মোরাল ম্যাপ। নৈতিকতা কখনো আপোশযোগ্য নয়।
মূল্যবোধ বিভিন্ন প্রকার হতে পারে, রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক, ধর্মীয়, গণতান্ত্রিক ইত্যাদি। কেউ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, এই বিশ্বাসটাকে আমরা ধর্ম বলে সম্বোধন করি। ধর্ম মানেই বিধাতার নিয়ম অনুসারে কোনো কিছুর উপর বিশ্বাস আনা। বিধাতার অনুগত্য স্বীকার করে এবং কোনো (বেহেস্ত বা স্বর্গ) প্রাপ্তির আশায় কোনো নিয়ম রীতি মেনে চলাই ধর্ম। ধর্ম মানে বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস বিভিন্ন বস্তু সম্পর্কে ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও জ্ঞানের সমন্বিত রূপ। বিশ্বাসের পার্থক্য ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে হতে পারে। কোনো বিষয়ে একজনের বিশ্বাস অন্য জনের বিশ্বাস থেকে কম কিংবা বেশি হতে পারে। বিশ্বাস গড়ে উঠে ধর্মকে কেন্দ্র করে, যেখানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বেশি পালন করা হয়, সেখানে বিশ্বাস ততবেশি স্থান দখল করে থাকে। অতীতে নৃবিজ্ঞানীরা ধর্মের বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে বেশি জোর দিতেন। তবে বর্তমানে ধর্মে আচারগত দিকটা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্রকৃতিতে বিরাজমান বস্তুসমূহ এবং তাদের মধ্যে সংঘটিত ক্রিয়া-বিক্রিয়া সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞানেই বিজ্ঞান। এই জ্ঞান ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে মানুষ প্রকৃতি বিরাজমান সৃষ্টিকর্তার দান সমূহের সমব্যবহার মাধ্যমে জাগতিক আরাম-আয়েশ ভোগ করে চলছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তু জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আধুনিক বিজ্ঞান বস্তুবাদ। অতিন্দ্রীয় জগৎ সম্পর্কে বিজ্ঞান নিশ্চুপ। বস্তুবাদী বিজ্ঞানে হাত-পা বস্তুজগতে বাঁধা। আধুনিক বিজ্ঞান বস্তুবাদি।
ঐশ্বরিক বিষয়ে জ্ঞানদানে আধুনিক বিজ্ঞান অক্ষম। বর্তমান বিজ্ঞানের নীতিমালা দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে উপলব্ধি করার ততটা সুযোগ নেই। বস্তুবাদি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিয়ে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব এবং কার্যাবলী প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। তাই অধিকাংশ বিজ্ঞানী স্র্রষ্টার ব্যাপারে নিশ্চুপ। কেউ কেউ অবিশ্বাসী। এখানে আধুনিক বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। কোনো বিষয়ে নিভুর্ল জ্ঞানই বিজ্ঞান।
জ্ঞানের সকল শাখায় বিদ্যামান বিদ্যামান ভুল-ত্রুটি দূরীকরণে উৎকর্ষ সাধনে এবং ধ্রুব সত্য অর্জনে বিজ্ঞান সহায়ক ভূমিকা পালন করে । [তথ্য সূত্র- প্রকৃতি বিজ্ঞান ও ধর্ম, প্রফেসর মোহাম্মদ আজিজুর রহমান লসকর ]
ধর্ম ও বিজ্ঞান এক, নাকি অভিন্ন?
ধর্মশাস্ত্র যা বলছে, তা শুধু চোখ বুজে মেনে নেওয়া, আর কিছু যুক্তি-তর্ক দিয়ে ধর্মকে টিকিয়ে রাখা যায় না। বর্তমান সময়ের মানুষ তা মেনে নিবে না। বর্তমান সময়ের মানুষ কিয়াস, ইজমা কিংবা কোনো ‘কাল্পনিক’ কথা শুনতে আগ্রহী নয়। আর তাদের কাছে এত সময়ও নেই। কতিপয় আদিম ধারণা, অলৌকিক-অদৃশ্য বস্তু প্রথা সংস্কার-কুসংস্কারের উপর অন্ধ বিশ্বাস আস্থা শুধু ধর্ম নয়। যখন কোনো জ্ঞানার্থী ধর্মীয় কোনো বিষয়ে, বিনা প্রশ্ন মেনে নেয়। তখন তার মধ্যে জ্ঞানের কোনো বিকাশ ঘটে না। তখন তিনি হয়ে যায় কূপমুণ্ডক বা মৌলবাদ। যার মধ্যে দেখা যায় ধমীর্য় গোড়ামী। ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার গণ্ডি সীমিত হয়ে যায়। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা বাঙালি জাতি। ধর্মীয় গোড়ামীর কারণে আমরা ইউরোপের দেশগুলো থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। আমরা শুধু ধর্মীয় গোড়ামী ও পরলৌকিকমুখী—ইহজাগতিক শিক্ষা-দীক্ষায উদাসীন। হয়ত সেজন্যই বাঙালি একবিংশতকের চালেঞ্জ মোকাবেলায় অদক্ষ-অক্ষম ।
সংঘাতের ভিত্তি
ধর্ম ও বিজ্ঞান সমাজ জীবনে দুটো দৃষ্টিকোন। এর মধ্যে ধর্ম গুরুত্বপূর্র্ণ। একটি প্রাচীন সময়ের নিরিখে। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সুদীর্ঘ দিন থেকে সংঘাত চলছে। আর তাতে বিজ্ঞান অনিবার্যভাবে জয়ী হয়েছে। বিজ্ঞান হলো পর্যবেক্ষণজাত অবিষ্কারের প্রচেষ্টা। এই পর্যবেক্ষণ যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। ধর্মতত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের সংঘাত আসলে কর্তৃত্ব আর পর্যলোচনার দ্বন্দ্ব। বিজ্ঞানের অনুসারীরা বলে প্রপজিশন বা যৌক্তিক বাক্যগুলো বিশ্বাস করতে হবে।
আর এ কারণে ধর্ম অধ্যাত্মিক অনেক বিষয় যুক্তি ও তথ্য দিয়ে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে । এবং বর্তমান বিজ্ঞানের সাথে ধর্মেও অনেক বিষয় অমীমাংসিতভাবে থেকে যাচ্ছে। দুই দৃষ্টিকোণ থেকে দুইভাগে ব্যাখ্যা করছে। যেমন—
ডারউনের মতবাদ, ‘‘মানুষের আবির্ভাব হয়েছে বানর থেকে ” এই কথায় পুরোবিশ্ব অবাক/ বিচলিত হয়েছিল। প্রতিক্রিয়া হিসাবে চিচেস্টরের (Chichester) ডিন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ম সভায় বলেছেন, ডারউনকে নোংরা পুজোর একটি বাণী প্রচারক।
লন্ডন বিশ্ববিধ্যালয়ের অধ্যাপক টি এইচ হাক্রলি (১৮৬৩) ‘প্রকৃতিতে মানুষের স্থান’ (Mains place in nature) নামক পুস্তকে বলেছেন, মানুষের সৃষ্টি হয়েছে এপ (গরিলা ও দুই প্রকার শিম্পাঞ্জি) থেকে। তার সাথের মানুষের অঙ্গের অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায় ।
বির্বতন এপের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কেউ কেউ পরে স্বীকার করে নিলেও। বানরের সাথে মানুসের সর্ম্পক মানতে নারাজ।
১৬৫৩ সালে ওলন্দাজ প্রত্নতত্ত্ববিদ ইসাকও্যলাপিয়েরের (Source : Organization Behavior p-86 ) একটি বইয়ে লেখেন এবং বইটির নাম ছিল ‘এডমের পূর্বে মানুষ থাকার অনুমান সংক্রান্ত ধর্ম তাত্ত্বিক পদ্বতি’ (A Theological system upon that presupposition that man were before Adam ) তিনি বলেন, আদম হয়ত বা প্রথম মানুষ হতে পারে কিন্তু ১ম মানুষ না, বইটি প্রচার হওয়ার পর হওয়ার পর প্রচুর হইচই পড়ে যায়!
এছাড়া বিগব্যাং এর মহাবিস্ফোরণ, পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস, কীভাবে নূহের সময় মহাবন্যা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল, কীভাবে নূহের জাহাজের প্রাণীগুলো আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। এ ছাড়াও আর কিছু মত-ঐক্য আছে। তবে এগুলো কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত করলেও ধর্মীয় বিশ্বাসকে নষ্ট করতে পারে না।
এই বির্তকটা আদিকাল থেকে চলে আসছে যখন থেকে কিছু লোক পরস্পর বিরোধী। মানব সভ্যাতার ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি দুটো সমসময়িক। ধর্ম নিজেই একটি বিজ্ঞান। আর বিজ্ঞানের নিজস্ব কিছু ধর্ম রয়েছে। যারা এই সত্যটাকে মানতে চায় না তারা সমাজের শত্রু। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো শত্রুতা নেই ও থাকবে না। কিছু ব্যক্তি ধর্মীয় আচার-আচরণকে সামনে এনে কিছু তত্ত্ব দিয়ে ধর্মকে হেনস্থা করার চেষ্টা করে। তবে এ কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই বিজ্ঞানের ফলে আজকের সভ্যতা ক্রমশ উন্নতির শিখর থেকে শিখরে ধাবিত হচ্ছে। তাই মানব কল্যাণে বিজ্ঞান ও ধর্ম উভয়ের প্রয়োজন। উভয়ে একে অপরের সম্পূরক।
নাহিদ বাবু : তরুণ লেখক।