ঐ যে মহাকাশ, যার দূরত্বের কোনো সীমা নেই। যার মধ্যে ছোটো-বড়ো কত গ্রহ নক্ষত্র, তারকাপুঞ্জ, আকাশ, মেঘ, শূন্যতা সব মিলে-মিশেই আছে। এটা কারো না কারো মহিমা তো নির্দেশ করেই। সাদা মেঘে রঙ-বেরঙের যে ছোপ ছোপ দৃশ্য তা কি কোনো মানুষ নিজ হাতে সাজিয়েছে, নাকি অদৃশ্য কোনো শক্তির সাহায্যে তা হয়েছে। সেটাও তো কারো না কারো সুদক্ষ হাতের কাজকেই নির্দেশ করে। অন্তরের গভীরতায় চিন্তা করলে শুনতে পাই, যেন প্রতিদিনই তার ভেতর থেকে কথা বের হয়ে আসছে। যে কথার মেধ্যে কোনো শব্দ নেই, কোনো ভাষার ব্যবহার নেই অথচ আকাশে-পাতালে এই পৃথিবীতে যত মানুষ আছে, সকলেই সেই মহিমা দেখতে পাচ্ছে কিন্তু সবাই বুঝতে পারছে না। সেই শব্দ আমাদের কানের ছিদ্র দিয়ে ঠিকই প্রবেশ করে অথচ শুনতে পাই না। আবার গভীর রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়ি, তখন কে যেন শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে, দেহের ব্যাটারিকে ফুলচার্য দিয়ে দেয়। ভোর বেলা যখন ঘুম থেকে উঠে রক্তিম পূর্ব আকাশের দিকে তাকাই, তখনো দেখি থালার মতো রক্তিম সূর্যটা মহাকাশের বাসর ঘর থেকে বের হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে তার বীরত্বগাঁথা রূপ আমাদের সামনে উন্মোচিত করে, পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই অপরূপ দৃশ্য যা কখনো কি এই মানুষের করার সাধ্য আছে। তাহলে এগুলোর গৌরব পাওয়ার অধিকারী কে? আমাদের নিজের ভুল কি আমরা নিজেরা বুঝতে পারি কখনো। নিজের অজানা দোষ কি কখনো খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছি। আজ আমাদের চাওয়া বা পাওয়াটাই যেন নিজের পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্য। নিজেই সব কিছুর নিয়ন্ত্রণকর্তা হতে চাই কিন্তু একটা বিদুচ্চমকের মতো তাঁর ধমক আমাদের সুন্দর সাজানোর জিনিসগুলোকে মুহূর্তেই ধ্বংস করে দিতে পারে, তা কি অনুভব করি কখনো। বিদ্যুচ্চমকানোর যে ঝলকানো আলো, যা আকাশের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত চলে যায়, তা কি কোনো কৌশলে ঠেকিয়ে দিতে পারি আমরা কখনো। তালগাছ লাগিয়ে কি বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এটা আমাদের শুধু কল্পনার বহিঃপ্র্রকাশ ছাড়া কি অন্য কিছু হতে পারে। তালগাছের উপড়েও তো বিদ্যুৎ পড়ে পুড়ে মারা যায়। আমরা কেন বিশ্বাস করি না কারো না কারো নিয়ন্ত্রণেই আছে সেটা। কারো না কারো নিয়ন্ত্রণেই আছে ঐগুলো। হয়ত জীবনের একটা সময়ে এসে তা অনুভব করি, যখন আমার গুদামে আর কোনো শক্তি থাকে না। জোয়ারের সময় নিজেকে কাপড় পরা অবস্থায় সাঁতারে ছিলাম কিনা তা আবিষ্কার করা খুবই কঠিন কাজ। তবে নিজেকে অদৃশ্য কারো না কারো প্রতি নির্ভরতা আমাকে শান্তি দেয়, আনন্দ দেয়। আর তখনই মনে পড়ে যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কাল জয়ী বাক্য, “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না”। আসলে কি পেতে আজ আমরা মারামারি, ভাঙচুর, হানাহানি কাটাকাটি করি। কিসের স্মরণসভা বা কিসের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, কিসের নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলা। আমরা খেলার মাঠ দখলের মতো করে আমাদের বিভক্তির কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছি। কতই না নৈরাজ্য চলছে চোখের সামনে। আমরা ইতিহাস ভুলে গিয়ে নিজে নিজে ইতিহাস তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। ভুলে গেছি আমাদের নির্মাণকর্তা যিনি কোনো ধর্ম, বর্র্ণ, জাতি বা গোষ্ঠি নির্মাণ করেননি। ভাষার ভিন্নতা তৈরি করেননি। বাবিল সাম্রাজ্য থেকেই আমাদের এই বিভক্তির কারণ যা ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায়। সেখান থেকেই শুরু হয়েছে আমাদের পথের ভিন্নতা। চলার ভিন্নতা। চাওয়া বা পাওয়ার ভিন্নতা। আজও তা চলছেই। আমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে মাকে পাঠাই তা বাবার বাড়ি। বাবাকে পাঠাই তার শ্বশুর বাড়ি। আর আমি বাড়ি ফাঁকা পেয়ে বেড়াতে যাই মামা বাড়ি কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে তো দেখা হয় সবাই একই বাড়িতে। তাহলে এই বিভক্তি কেন। এই পৃথিবীতে মানুষের গৌরব বা কৃতিত্বের কি কোনো স্থায়িত্ব আছে। সব কিছুই তো মরচে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন। আজ আমাদের বিকারগ্রস্ততাই আমাদেরকে নৃশংস আচরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবতে কষ্ট হয় যে একজন ছাত্র অন্য ছাত্রকে কি পেটানো পেটাচ্ছে, মারতে মারতে মেরে ফেলছে। নিজের বা কোনো একটা গোষ্ঠীর কৃতিত্ব টিকিয়ে রাখতেই সে সেই কাজটি করে যাচ্ছে। সেই ছাত্র কি তার নিজের জীবন বা পরিবারের কথা একটিবারের জন্যও ভেবেছে কখনো। পাপকে ঘৃণা করো। তাই তো মন পরিবর্তন করে পাপের পথ পরিত্যাগ করো। ক্ষমা করতে শেখো। যদিও জীবনের বাস্তবতায় তা বড়োই কঠিন কাজ। পবিত্র বাইবেল বলেছে, আপনাদের বিষয়ে সাবধান থাকিও। পাছে ভোগ পীড়ায় বা মত্ততায় বা জীবিকার চিন্তায় তোমাদের হৃদয় যেন ভারগ্রস্ত হয়ে নিজের ফাঁদেই যেন নিজে জড়িয়ে না যাই।
অলোক মজুমদার : চিকিৎসক ও লেখক।