সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও মানবাধিকার দিবস পালন করা হয়। ১০ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৫০ সাল থেকে তা নিয়মিতভাবেই পালন করছে বিশ্ব। এটার মূল বিষয় ছিল, ‘‘বৈষম্য ঘোঁচাও, সাম্য বাড়াও, অধিকার সুরক্ষা করো, আমার মতামতের মূল্য দাও’’। কিন্তু বৈষম্য কী তা কি আমরা জানি, সাম্য কী তা কি আমরা জানি, আধিকার কী তা কি আমরা জানি, আবার মতামত কোনটা তাও কি আমরা জানি? অথচ দেখি যে মুখে যা বলি, তা কারোই কার্যক্ষেত্রের কথা নয়। এটা কথার কথা মাত্র। আমাদের পরিবারে সংঘর্ষ, পথে সংঘর্ষ, মানবতায় অবক্ষয়ের সংঘর্ষ চলতেই আছে। মানবাধিকার নিশ্চুপ। আসলে তারও কারণ আছে, কেননা তারও তো নিজস্ব লাইন আছে। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন ঈশ্বরদী প্লাটফর্ম থেকে ঢাকার দিকে যাবে, নাকি পার্বতীপুরের দিকে যাবে, সেটা তো ট্রেনেব ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার নিয়ন্ত্রণকর্তা সূক্ষ্ণ মস্তিষ্কের বিচারে তার গন্তব্যের পথ নির্নয় করে দিচ্ছে, আর তখনই সেটা তার গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে। আবার যেখানে খুশি থামতে বললেই তাকে থামিয়ে দিতে হচ্ছে। তাহলে ট্রেন কোথায় তার স্বাধীনতা পেল। ট্রেন কি ইচ্ছা করলেই তার বৈষম্য ঘুচাতে বা সাম্য বাড়াতে বা পেসেঞ্জারের প্রাপ্ত অধিকাকে সমুন্নত রাখতে পেরেছে?
আমরা জন্মসূত্রেই কিছু কিছু অধিকার পেয়ে থাকি। আবার কর্মের মাধ্যমে কিছু কিছু অধিকারকে অর্জন করতে হয়। তবে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত আধিকারেই যদি অনধিকার চর্চা হতে থাকে, তবে পরেরগুলোর হাল যে কি হয়, তা তো বোঝাই যায়। ক্ষমতায় থাকা মানুষ যখন ক্ষমতাহীনদের অসম্মান করতেই থাকে, কারণে-অকারণে হেনস্তা করার সংস্কৃতিতে যখন লিপ্ত থাকে, তখন মানবাধিকারের স্টেশনে অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কি-ইবা করার থাকে। কখন ক্লিয়ারেন্স আসবে যে তোমাকে ঐ দিকে যেতে হবে আর তখনই সে যাবে।
পবিত্র সংবিধান আমাদের জন্যে নাগরিক জীবনের সকল অধিকার, সমতা ও মর্যদা নিশ্চিত করেছে, কিন্তু তার কতটা সুফল পাচ্ছি আমরা। নতুন আসবে আর পুরাতন বিদায় হবে এটাই পৃথিবীর চিরন্তন নিয়ম। পুরাতনদের কাজ হলো নতুনদের কিছু শিখিয়ে রেখে যাওয়া, যেন তারা সেই আলোতে চলতে পারে কিন্তু কী শেখাচ্ছে তারা। তারা বলছে মানবাধিকারের কথা, দিবস পালন করছে ঘটা করে, অথচ তারাই লঙ্ঘন করছে ও করা শেখাচ্ছে।
আজ কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে সেটা বিচার করে পার্থক্য করা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য দুরূহ ব্যাপার। কোন সেই বাটখারা, যেটা দিয়ে সত্য ও মিথ্যাকে পৃথক করব। কতজন আছি যারা সত্য ইতিহাস পড়ে শিক্ষা নিতে পারি। আবার যেটা পড়ে শিক্ষা নিতে চাচ্ছি তারই বা সত্যতা কতটা তাই বা কে জানে। ক্রমান্বয়েই আমরা মস্তিষ্কের রোগে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছি। পবিত্র বাইবেলে লেখা আছে হিতোপোদেশ ১২ : ১৫ পদে, অসাড় বিবেক লোকের পথ তার নিজের দৃষ্টিতে ঠিক মনে হয় কিন্তু জ্ঞানী লোক পরামর্শ শুনে। যিশাইয় ৫ : ২১ পদে লেখা আছে, ধিক সেই লোকদের যারা নিজের চোখে জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমান। আসুন না একটু ধৈর্য ধরি। ধৈর্যসহকারে সকলের কথা শুনি। ভালো লাগলেও শুনি, আবার ভালো না লাগলেও শুনি। হাজার কথার মধ্যে একটা কথাই আমার জীবনের মোড় পাল্টে দিতেই পারে। আমরা সমালোচনায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, কবে যেন আমাদের সমালোচনার জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হতেও পারে। এটা তো সমাজ সংস্কারের জন্য ঠিক নয়। আর তাই তো একটা সুন্দর মাদকমুক্ত, হানাহানি মুক্ত, ঈর্ষা মুক্ত, সুস্থ মানবতা বোধ সম্পন্ন মানুষের সমাজের আশায় নিবেদিত প্রাণ জাতীয় খেলাঘর’র এনামুল হোসেন জিন্না বলেছিলেন, কোনোদিন কারো খারাপ কোনো বিষয় নিয়ে সমালোচনা করবে না। যার সমালোচনা করতে যাচ্ছো তার এক হাজার খারাপের মধ্যে যদি একটাও ভালো পাও, তবে সেই ভালোটা নিয়েইে আলোচনা করবে। দেখবে সে পাল্টাবেই। আর সেই সাথে তার মধ্যে ভালো করার বীজ অংকুরিত হবে। সমাজ পাল্টাতে কারো খারাপ সমালোচনা দিয়ে হয় না। কেননা সবার মধ্যেই কিছু না কিছু খারাপ আছেই। তাই তো আসুন সমালোচনা খারাপ নিয়ে নয়, সেই খারাপীর ভালোটা নিয়ে করি। আসলে নিজেকে বদলানো ছাড়া সমাজ বদল করা যায় না ।
