পড়তে এখন বেশ ভালো লাগে। এক সময় ভালো লাগতো না যখন ছাত্র ছিলাম। তখন ভাবতাম এত পড়ে কি হবে। আজ বুঝি যে এই পড়ার মধ্যেই আছে অনেক শক্তি, অনেক প্রেরণা। এখন অনেক ভালো লাগার বিষয় এই পড়া। তাই তো সুযোগ পেলেই পড়তে বসে যাই। তার পরে লেখা, তার পরেই সংস্কৃতির চর্চায় নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলি আমার সাধনা ঘরে। সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায় তখন, যখনই আমি ঐখানে প্রবেশ করে সাধনায় লিপ্ত হয়ে যাই। অসাধারণ এক সুখে তৃপ্ত হয় আমার অন্তর। আসলে মানব জীবনের জন্য এই তিনটার গুরুত্ব অনেক বেশি, তা এখন বুঝতে পারি। আর সেটা হলো পড়া, লেখা, আর সংস্কৃতির চর্চা করা। কেউ ভালো বলুক আর নাই বলুক এটা আমার নেশায় পরিণত হয়েছে। তবে এই নেশা আমাকে অনেক নতুন কিছু শেখাচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট বৃত্ত থেকে নিজের জানার থলিটা অনেক বড়ো হচ্ছে। সেই সাথে অজানা এক অনুভূতি যা শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি এনে দিচ্ছে মনে ও শরীরে। এক সময় আমি মানুষের সামনে কথা বলতে পারতাম না, আজ একটু একটু পারি। কিছু লিখতে পারতাম না, এখন একটু একটু পারি। গান গাইতে বা অভিনয় করতে পারতাম না। তবে ভালো না হলেও এখন একটু একটু পারি। আমার বিষণ্নতার সময় যখন একটা বই, বা একটা খাতা আর কলম, বা হারমোনিয়ম নিয়ে একটু বসি আমার সাধনা ঘরে, আর তখন সকল বিষণ্নতা মুহূর্তেই দূরে সরে যায়। নিজেকে অনেক সতেজ মনে হয় তখন। আর এটা সম্ভব হয়েছে এই বইয়ের কারণেই। জানি না এটাতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার কোনো ঔষধ আছে কিনা। তবে অদৃশ্য কিছু একটা শক্তি তো আছেই ।
আসলে বই পড়লে মনের পরিবর্তনের মাধ্যমে মস্তিষ্ক শক্তিশালী হয়। মস্তিষ্কের নিউরনের কাজ সামনের দিকে এগোতে থাকে। সেঞ্চুরি কর্টেক্সের কাজের পরিবর্তন হয়ে শরীরে ব্যথা পাওয়ার অনুভূতি কমিয়ে দেয়। যা মনকেও শান্ত রাখে। তবে যাই বলি না কেন, বই যে আমাদের প্রভাবিত করে না তা কিন্তু নয়। বই আমাদের দিক নির্দেশনা দেয়। একটা শিশু মনে এটার প্রভাব সবথেকে বেশি হয়। তাইতো শিশুদের ক্ষেত্রে একটা সুন্দর বই নির্বাচন করা খুবই কঠিন কাজ। এই নির্বাচনে ভুল হলে তাদের পরবর্তী জীবনে কর্মক্ষমতা, অন্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা এবং তার আত্মসম্মানের উপরে আঘাত করতেই পারে। কেননা এই বই-ই তাকে ভবিষ্যতের জন্য ধারালো হতে সাহায্য করে। বই আমাদের নিজেদের মধ্যে সহানুভূতি তৈরি করে। একজন লেখকের কল্পনার জগতকে, পাঠক তার বাস্তব জগতের সাথে মিলিয়ে, ভুল ভ্রান্তি সংশোধন করে, সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। যেখানে আবেগ, অনুভূতি, ঘৃণা, প্রতিবাদ, ভালোবাসা থাকে। যাকে এক কথায় বলে থিওরি অব মাইন্ড বা মনতত্ত্ব। আর সেখানেই সমাজ, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ সম্মন্ধে অনেক কিছুই জানা যায় ও তার ভুল সংশোধন করে সামনের দিকে চলা যায়। জানা যায় নতুন নতুন শব্দ ও তার গভীর তত্ব যা নিজের জীবন কে উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনের দিকে নিয়ে যায়। এই বই ছিল জন্যেই আমরা ঈশ্বর আছে তা জানতে পারি। ঈশ্বর আমাদের কাছে কি চান তা জানতে পারি। বিজ্ঞানের নতুন থিওরি জানতে পারি। বিজ্ঞানের নতুন দৃশ্যমান উদ্ভাবন জানতে পারি। আমরা জানি যে, এই পৃথিবীর সব কিছু একবারেই সৃষ্টি হয়েছে। শুধু সময়ের সাথে সাথে এটার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। নিজের জন্ম থেকে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত শরীর গঠনের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমার চাক্ষুষ যে পরিবর্তন, সেটাই হলো নতুন আবিষ্কার। তবে তা নতুনভাবে সৃষ্টি নয়। এক সময় আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হয়ে সব ভুলে যাই কিন্তু আমার সংগ্রহে কোনো থিওরির বই থাকলে তা দেখে আমি মুহূর্তেই নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারি। বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, প্রতিদিন মাত্র ৩০ মিনিট বই পড়লে আমাদের শরীরের রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই তো সুস্থ জীবনের সাথে পড়া, লেখা ও সংস্কৃতির একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। শুধু খেয়ে পরে দিন কাটানোটাই তো জীবনের আসল উদ্দেশ্য নয়। এর সাথে রয়েছে জীবনকে যাপন করা, উপভোগ করা, উদযাপন করা, বিচার বুদ্ধির আহরণ করা, অন্তরের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটানো এবং ভালোবাসার প্রতিফলনসহ আরো অনেক বিষয় আছে। আমি মুগ্ধ হয়েছি এক জন সামান্য দই বিক্রেতা, যিনি মাটিতে বসে বা কখনো কখনো সাইকেলে করে, পাড়ায় পাড়ায় দই বেচে বেড়াতেন, আর তার দই বেচা টাকায় বই কিনে একটা আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন এবং তিনি তাতে সফল হয়েছেন। আজ একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি। আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাই। আরো এমন অনেক আলোকিত মানুষ আছে যাদের সন্ধান হয়ত এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে যে যাই করি না কেন আমাদের মনে রাখা দরকার যে প্রতিটা দিন আমাদের কাছে নতুন ও সেরা দিন। সেখানে অনুসন্ধিৎসু মনে নতুন ও সেরাটা খুঁজে নেওয়ার জন্য নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। পবিত্র বাইবেলের হিতোপদেশ ১৯:৮ পদে লেখা আছে, যে নিজেকে ভালোবাসে সে বুদ্ধিমান। যে বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করে চলে সে আশীর্বাদ পায়।
ডা. অলোক মজুমদার: চিকিৎসক ও লেখক; বিশেষ প্রতিনিধি―সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তন।