মনীষীরা বলেছেন, ‘একটি রাষ্ট্র, একটি দেশ বা একটি সমাজ কতোখানি সভ্য, উন্নত, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক; তার মানদণ্ড হচ্ছে সেই সমাজের সংখ্যালঘু মানুষেরা কেমন আছেন!’ এই প্রশ্নের উত্তরে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের আদিবাসীরা ভালো নেই। কিন্তু কেন? দশকের পর দশক ধরে স্থানীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীদের দ্বারা জবরদখল, উচ্ছেদ, হত্যা, ধর্ষণ এবং লুণ্ঠনের মতো বর্বরতার শিকার হয়ে আসছে আদিবাসীরা। আদিবাসীরা শাখের করাতে পরিণত হয়েছে, পক্ষে ভোট দিলেও দোষ; না দিলেও দোষ। অর্থাৎ কখনোই শান্তিপূর্ণ জীবন প্রবাহিত হতে দেখা যায়নি। জীবন প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে বৈষম্যকে বৈষম্য হিসেবে গণ্য করেনি; ভেবে নিয়েছে এটি জীবনের প্রাপ্তি, ভাগ্যের লিখন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জোয়ারে শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হলে, শিক্ষার্থীদের মানসপটে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা প্রবলভাবে পরিস্ফুটিত হয়। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সাম্যতার বিষয়ে রাজধানীসহ জেলা, উপজেলা এবং নগরের ও বিদ্যালয়ের দেয়ালগুলোতে দৃষ্টিনন্দন গ্রাফিতির দৃশ্যমান হয়েছে। এমনই একটি গ্রাফিতি ‘আর নয় বৈষম্য প্রতিষ্ঠা পাক সাম্য’। একটি বৃক্ষের পঞ্চ পাতাতে পরিষ্কারভাবে লেখা রয়েছে—আদিবাসী, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম।’ পার্শ্বের লেখা, ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। এটিই প্রত্যাশিত, ’৭১-এ বহু জাতিগোষ্ঠীর রক্তে ক্রীত সার্বভৌম বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত রয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা—যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। ’
সাম্প্রতিকালে আদিবাসী বিতর্ক উস্কে দিয়েছে, ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ সংগঠনটি। অন্তবর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করলে প্রথম উপস্থিতি চোখে পড়ে সংগঠনটির। অতঃপর ২০২৫ সালের জন্য নতুনভাবে সংকলিত ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ (এনসিটিবি)-এর নবম ও দশম শ্রেণীর পাঠ্য বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতির ছবি যুক্ত করা হয়। ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ নামক ছাত্র সংগঠনটি এখানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পায় এবং এনসিটিবি অফিস ঘেরাও ও গ্রাফিতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। অপরদিকে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র জনতা’ ব্যানারে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করলে বিপত্তি ঘটে। দু-পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা মারাত্মকভাবে আহত ও চিকিৎসাধীন রয়েছে। আমরা ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’র এহেন বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানাই।
দেশের নাগরিকের প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ এনসিটিবি অফিস ঘেরাও ও তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছে; সেক্ষেত্রে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র জনতা’ তাদের যৌক্তিকতা জানাতে গেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এটি যেমন আইন ও নৈতিকতা বিরুদ্ধ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেও এটি সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। আদিবাসীদের গৌরবোজ্জল ইতিহাস রয়েছে—অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ বিরোধী, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। জনসংখ্যার অনুপাতে মহান মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের যে অগ্রগণ্য ভূমিকা, সার্বভৌমত্ব ও দেশপ্রেমের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে; ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ সেগুলো বেমালুম ভুলে গেছে। আমরা মনে করি, ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’ এখন পর্যন্ত দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে, পক্ষান্তরে যারা ঐতিহাসিকভাবে অবিচারের বিপক্ষে, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় সামনের সারিতে থেকেছে; তাদের অবমূল্যায়ণ এবং তাদের সম্পর্কে ভ্রান্তি ছড়ানো কাম্য নয়। ‘স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’র ঔদ্ধত্যতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আবশ্যিকতা রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানিয়েছে। প্রেস উইং থেকে প্রেরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সামনে বুধবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার এই হামলা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে এবং ইতোমধ্যেই এ ঘটনায় দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য অপরাধীদেরও শনাক্ত করা হচ্ছে এবং শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা হবে। সকল অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পুনর্ব্যক্ত করে যে বাংলাদেশে সহিংসতা, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নেই।’
আদিবাসী শব্দটি নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত কয়েক দশক পূর্ব থেকেই। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পাটিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর কর্ণধার, আইন প্রণেতাগণ বিভিন্ন সময়ে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করে বাণী, নির্বাচনী ইশতেহার, নির্বাচনী সভা, জাতীয় সংসদে হরহামেশা বক্তব্য দিয়েছেন এবং এখনো দিয়ে থাকেন। ২০১১ সালে পবিত্র সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে প্রবল প্রতিরোধের মুখে জাতীয় সংসদে পাশ হয় ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি’ শীর্ষক অনুচ্ছেদটিও। বলা হয়েছে— ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ ইতিপূর্বে পাশ করা হয়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০। অতঃপর হঠাৎ করেই ২০১১ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর’ জনগণকে যাতে ‘আদিবাসী’ বলা না হয়। সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি খাড়া করা হয়েছিল, আদিবাসী হতে হলে কলোনিয়াল কিংবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কলোনাইজেশন হতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সে ধরনের কিছুই হয়নি। ২০২২ সালের ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপনের পূর্বে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলো, গণমাধ্যমে যাতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করা হয়। অর্থাৎ আমরা একটি ক্লু পেলাম—তৎকালীন সরকার পার্বত্যবাসীকে ‘আদিবাসী’ বলতে অস্বীকার করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম হতে অবহিত হই যে,
ক. ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তিতে ব্যবহৃত ‘উপজাতি’ শব্দটি গ্রহণীয় ও গ্রাহ্যণীয় হিসেবে চুক্তিতে বারংবার উঠে এসেছে।
খ. ১৯৮৯ সালের ২০ নং আইন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ স্থাপনকল্পে প্রণীত আইন; যা ৬ মার্চ, ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত। এখানেও উপজাতি শব্দটিই প্রাধান্য পেয়েছে।
গ. বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীরা বাংলার ভূখণ্ডে মাত্র কয়েক শতাব্দী পূর্বে বসতি গড়ে তুলেছে, যা বাঙালিদের সমসাময়িক। বোধকরি, এরূপ বহুধা অভিযোগের তীক্ষ্ণ তীরে বিদ্ধ হয়েছে পার্বত্যবাসী।
এবার সমতলের আদিবাসীদের বিষয়টি দেখা যাক। মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের পর ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রজাস্বত্ব আইন জারি হয়। দীর্ঘ বছর পর ১৯৫০ সালে অর্থাৎ পাকিস্তান সরকার আইনটিকে রিভিউ করে নামকরণ করে স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট; সেখানেও ৯৭ ধারাকে অক্ষত রেখে সমসংখ্যক আদিবাসীদের অধিকার সমুন্নত রাখা হয়। আদিবাসীদের নামগুলো হলো—সাঁওতাল, বানিয়া, ভূঁইয়া, ভূমিজ, ডালু, গারো, গন্দ, হাদি, হাজং, হো, খারিয়া, খারওয়ার, কোচ (ঢাকা বিভাগ), কোরা, মগ (বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা) মাল ও সুরিয়া পাহাড়িয়া, মেচ, মুণ্ডা, মুণ্ডাই, ওরাঁও এবং তুরী। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সার্বভৌম সরকার উল্লিখিত আদিবাসীদের স্বীকার করলেও স্বাধীনতার প্রায় কয়েক যুগ পেরিয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের বিষয়ে সুমতি উদয় হয়েছে। চিন্তনীয় যে, সরকার উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের কোনো সংজ্ঞায়ন করেনি; করেনি কোন কোন জাতিগোষ্ঠীগুলো কোন নামে আখ্যায়িত করা হবে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, টেন্যান্সি এ্যাক্টের ৯৭ ধারা বলেই উল্লিখিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জায়গা-জমি, বিষয় সম্পত্তি বিক্রির ক্ষেত্রে এডিসি রাজস্বের পূর্বানুমতি ব্যতিত হস্তান্তর আইনসিদ্ধ হয়ে ওঠে না; এটি এখনো বহাল রয়েছে। নৃবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিকদের প্রামাণিক দলিল-দস্তাবেজ বাদই দিলাম। প্রকৃত অর্থে ইতিহাসের সত্যকে উপেক্ষা করা যায় কিন্তু অস্বীকার করা যায় না।
স্টুডেন্টস্ ফর সভারেন্টি’র প্রতিনিধিগণ ১২ জানুয়ারি স্বাধীনভাবেই এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের কাছে মতামত ব্যক্ত করেছে, প্রশাসন সহায়তা করেছে। ১৫ জানুয়ারি ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র জনতা’কে প্রশাসনের সামনে ও পরোক্ষ সহযোগিতায় পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। পরবর্তীকালে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আদিবাসী সংগঠনগুলোসহ অন্যান্য সংগঠনগুলো রাজপথে প্রতিবাদে বেরিয়ে এলে পুলিশ আচরণবিধি লঙ্ঘন করে। পুলিশের একপেশে আচরণ তথা ফ্যাসিবাদী আচরণ প্রতীয়মান হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোকে রাজনৈতিক সরকারগুলো বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত করেছে, সেটি একান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। অবশ্য এতে আদিবাসীদের হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু চেতনার পরিবর্তন সাধিত হয়নি। ক্ষুব্ধ চিত্তেই বলে থাকেন, সরকার যে নামেই ডাকুক না কেন, আদিবাসীরা মনে-প্রাণে, রক্তে-অন্তরে, হৃদয়ে ও শক্তিতে সর্বাঙ্গীনভাবেই আদিবাসী। আদিবাসীদের বিচার্য হতে হবে নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে। আদিবাসী শব্দটির মধ্যেই রয়েছে আদিবাসী জাতিসমূহের প্রাণের স্পন্দন।
[উক্ত মতামত, বক্তব্যের জন্য বিবর্তন সম্পাদক বা বিবর্তন কর্তৃপক্ষ কোনো দায়ভার বহন করবে না। মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার একান্তই লেখকের]
