অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি আর সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় বর্তমানে যেভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। ইতিহাসবিদরা বলছেন, সবসময়ই এই রূপে বর্ষবরণ করা হতো না। বরং কাল পরিবর্তনের সাথে সাথে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতায় নানা পরিবর্তন এসেছে।
তারা বলছেন, মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা সন গণনা শুরু হওয়ার পর খাজনা আদায়ের পর যে উৎসব থেকে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল তা সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।
এই ধারাবাহিকতায় কখনো আগের বিভিন্ন নিয়ম বাদ দেয়া হয়েছে, আবার কখনো নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এই উৎসবের সাথে। ধীরে ধীরে বাঙালি সংস্কৃতি আর রাজনীতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে এই উৎসব।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, বিভিন্ন সময়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হয়েও উঠেছে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আইয়ুব খানের আমল এবং আশির দশকের শেষের দিকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ছিল বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা।
বাংলা নববর্ষ, বা পহেলা বৈশাখ, বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল উদযাপিত হয়। এটি একটি নবচেতনা, নতুন আশা এবং সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে আসে। তবে, এই উৎসব নয়, কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি আমার কিছু বিশেষ ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে যখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়, সেটি আমার হৃদয়ে একটি আন্দোলন তৈরি করে। আমার হৃদয়ে একটি ভালোবাসার ঘর তৈরি করে, যেখানে আমি বাস করি ,সেই দেশ আমার বাংলাদেশ। আমি এই দেশের নাগরিক আমি এই দেশকে ভালোবাসি, আমি বাংলায় কথা বলি, আমি বাংলায় হাসি , বাংলার গান গাই, বাংলায় আমি বুক ভরে নিশ্বাস নেই, এটা আমার অক্সিজেন, আমার অহংকার, আমার চেতনা। বর্তমানে বাংলার বুকে যে সমস্ত নেক্কারজনক ঘটনা ঘটছে তাতে আমি লজ্জা পাই। আমি ভাবতেই পারি না যে, বাংলার মানুষ এত বর্বর কীভাবে হলো। বাংলার মানুষেরা হলো সহজ সরল, অন্যের বিপদে বুক পেতে দেওয়ার মানুষ, অতিথি পরায়ণ, কিন্তু আমি লজ্জা পাই যে, সেই বাংলার মানুষেরা আশ্রয় দিয়ে তাদেরকে জবাই করে হত্যা করে, আমি লজ্জা পাই।।
কিন্তু তার জন্য তো আমার হৃদয়ের গভীরে বাংলা ভাষার জন্য আকুলতা, যে ভালোবাসার উদগীরণ হয় তা তো নষ্ট হতে পারে না। তা এইরকম—যখন আমি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলতে চাই মনে হয় যে, সেটা আমার ভেতর থেকে বের হয় না, মনে হয় কেউ যেন আমার গলার স্বরকে রূদ্ধ করে রেখেছে । আমার ভিতরে কেমন এক অস্বস্তি তৈরি হয়, কারণ আমি বাংলাতেই স্বস্তি বোধ করি। বাংলার এই নববর্ষে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃবোধ ঐক্যতা তৈরি করতো । বাংলায় আবার শান্তি ফিরে আসুক, বাংলা শুচি হোক, পবিত্র হোক, শুদ্ধ হোক, বাংলার ভ্রাতারা এক ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাস করুক। এখানে ভাষায় ভাষায়, জাতিতে জাতিতে, গোত্রে গোত্রে, কোনো ভেদাভেদ না থাকুক, কারণ কোনো কালে এরকম ছিল না, বাংলার সমস্ত জাতির লোকেরা গলাগলি করে একসাথে বাস করেছে।
বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মোটামুটি একমত যে, ১৫৫৬ সালে মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের শাসনামল থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছিল। যদিও বাংলা সন শুরু হয়েছিল আরো পরে, কিন্তু এটি সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের সময় থেকেই কার্যকর বলে ধরা হয়। তবে শুরুতে এটি বর্ষবরণ ছিল না। বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা পরে যোগ করা হয় ।বাংলা নববর্ষ মূলত নতুন বছরের সূচনা, যেখানে মানুষ পুরোনো বছরের সকল দুঃখ-বেদনা ভুলে নতুন বছরের জন্য উদ্দীপ্ত হয়। কিন্তু আমার মতে, এই উৎসবের প্রকৃত আনন্দ তখনই আসবে, যখন আমরা নিজেদের জীবনকে শুধুমাত্র একটি দিন বা অনুষ্ঠান দ্বারা পরিবর্তন না করে, বছরের প্রতিটি দিনেই নতুন কিছু শিখতে এবং ভালো কিছু করার চেষ্টা করব।
এই দিনটি শুধুমাত্র পান্তা ভাত ও ইলিশের জন্য নয়, বরং একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, একটি নতুন উদ্দীপনা এবং পরিশুদ্ধ মন নিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ।অর্থনৈতিক এবং গ্রামে-গঞ্জে ব্যবসায়ীরা নতুন বছরের শুরুর দিনে তাদের পুরোনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষ্যে তারা তাদের নতুন-পুরোনো খদ্দেরদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি মুখ করাতেন। এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে এসে অনেক খদ্দের তাদের পুরোনো দেনার পুরোটা বা কিছু অংশ শোধ করে নতুন খাতায় হিসাব হালনাগাদ করতেন।
অতীতের তুলনায় এই আনুষ্ঠানিকতা বেশ কমে গেছে। তবে এখনো কোথাও কোথাও পহেলা বৈশাখে হালখাতার চল চোখে পড়ে। ছোটবেলায় আমরা দেখেছি যে নববর্ষের সময় প্রতি দোকানে দোকানে হালখাতা খোলা হত । আর সে কি একটা উৎসবের আমেজ, সবাই সেই দিনই যাদের দোকানে বাকি থাকতো তারা তাদের হিসাব পরিশোধ করত এবং দোকানদার তাদেরকে আনন্দে মিষ্টি খাওয়াতো পরিবারের সবাইকে। এইযে ভ্রাতৃপ্রেম একে অন্যের সঙ্গে বন্ধন, এখন আর তেমন দেখা যায় না । গ্রামগঞ্জে কিছু কিছু জায়গায় এইসব দিনগুলো এখন সামান্য আকারে পালিত হয়ে থাকে।
শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় হতাশ হয়ে পড়ি। তাই, বাংলা নববর্ষ শুধু একটি আনন্দের উপলক্ষ নয়, বরং এটি একটি উপলক্ষ, যা আমাদেরকে নিজের উন্নতির জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে সাহায্য করে। এছাড়া, বাংলা নববর্ষের মাধ্যমে সমাজে যে ঐক্য ও সম্পর্কের বন্ধন তৈরি হয়, তা খুবই মূল্যবান। এই দিনটি যেমন পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো আনন্দের, তেমনি এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষা এবং জাতীয়তাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার একটি সুযোগ।
মণিকা বিশ্বাস: লেখক ও কলামিস্ট।