আমাদের জীবনে সৎ জীবনাচরণ, প্রকৃত বন্ধুত্ব ও বন্ধুত্বের ভূমিকা অপরিসীম। সামগ্রিকভাবে ন্যায়, সত্য, সুন্দর আদর্শময় জীবনযাপন সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়, এগিয়ে নেয় সুন্দরের দিকে। এর বিপরীত হলে মানব সমাজ ক্রমশ পঙ্কিলতায় ডুবতে থাকবে। এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হয়ত এখন আমরা কিছু কিছু অনুভব করতে পারছি। আজকের লেখা পবিত্র ধর্মগ্রন্থের আলোকে সমাজকে আমরা কীভাবে সত্য, সুন্দরের দিকে এগিয়ে নিতে পারি সে নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা-পর্যালোচনা।
আমরা যা প্রত্যাশা করি তা কিন্তু করি না, তাই ঈসা মসীহ বলেছেন, “কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, তোমাদের শত্রুদেরও ভালোবাসো। যারা তোমাদের জুলুম করে তাদের জন্য প্রার্থনা করো যেন লোকে দেখতে পায় তোমরা সত্যিই তোমাদের বেহেশতী পিতার সন্তান (রুহানীকভাবে)। তিনি তো ভালো-মন্দ সকলের উপরে তাঁর সূর্য উঠান এবং সৎ ও অসৎ লোকদের ওপরে বৃষ্টি দেন।” (মথি ৫:৪৪-৪৫) তখন ঈসা তাঁকে বললেন, “তোমার ছোরা খাপে রাখ। ছোরা যারা ধরে তারা ছোরার আঘাতেই মরে।” (মথি ২৬:৫২)

ঈসা নবীর কথাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমরা যদি এভাবে চলি। তাহলে আমাদের সমাজটা কতোই না সুন্দর হতো। সর্বদা ভালো আচরণ পেতে চাই, কিন্তু ভালো আচরণ করি না। যখন আমরা পাবলিক বাসে চলাফেরা করি তখন ৫/১০ টাকার ভাড়া নিয়ে কন্ডাকটর-হেল্পারদের সঙ্গে কতই না খারাপ আচরণ করি। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবা উচিত। পবিত্র বাইবেলে আছে, তোমরা যেভাবে মেপে দাও তোমাদের সেভাবে মেপে দেওয়া হবে। অর্থাৎ তোমরা জীবনে যেমন আশা করো, সে রকম প্রতিফলন ঘটাও। আজকাল বিশ্বস্ত মানুষ ও বন্ধুত্ব পাওয়া কঠিন। তেমনি আমরা একটা গল্প জানি, দায়ুদ-যোনাথন সংগ্রাম ও প্রতিকূলতার মধ্যে বন্ধুত্ব। দায়ুদ একজন নবী ছিলেন আর, যোনাথন ছিলেন রাজা তালুতের ছেলে, তিনি ইসরাইলের প্রথম রাজা ছিলেন। যোনাথন আত্মায় দায়ুদের সাথে একতাবদ্ধ ছিলেন। দুজনেই একসাথে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন। এটাই ছিল বন্ধুত্বের মর্মার্থ। এটা বন্ধুত্বের চরিত্র। সেভাবেই বর্ণিত হয়েছিল। দুজনেই এটাকে ভালোবাসা বলে মনে করত।
বস্তুত, পক্ষে বন্ধুত্বই হচ্ছে ভালোবাসা। আত্মা ও আত্মিকভাবে একাত্ম হয়ে যাওয়াই হচ্ছে বন্ধুত্ব। এটা কোনো মাংসিক কাজের প্রতিফল নয়। কিন্তু একান্ত গভীর ও শক্তিশালী বিষয়। প্রকৃত বন্ধুত্ব নিজের একক বৈশিষ্ট্যের উপর গড়ে উঠে। প্রকৃত বন্ধুত্ব মানুষের হৃদয়ের একাকিত্ব ঘুচিয়ে দিতে ও চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। প্রকৃত বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় বৈবাহিক সম্পর্ক কিংবা অবৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, বৈবাহিক সম্পর্কে যুক্ত থাকার পরেও অনেকে একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন না ।
বন্ধুত্ব সম্পর্কটি হচ্ছে পারস্পরিক। এছাড়াও পরিষ্কারভাবে এখানে যোনাথন হচ্ছে দায়ুদের জন্য দাতা। এবং এই সম্পর্ক প্রকৃতপক্ষে দায়ুদ যা ছিলেন,তা থেকে ভবিষ্যতে ইস্রায়েলের রাজা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
রাজা তালুতের একমাত্র রাজসিংহাসনের উত্তারাধিকারী ছিলেন যোনাথন। যিশয় পুত্র দায়ুদ ছিলেন একজন রাখাল। তারা দুজনেই ছিলেন বিবাহিত ও সন্তানাধির পিতা। যোনাথনের জন্য এটা ছিল প্রথম দর্শনে বন্ধুত। প্রথম দর্শনে যোনাথন, তার রাজকীয় বিষয় দায়ুদের সাথে সহভাগিতা করেছেন। তার দেহবর্ম ও তরবারি। তার তীরধনু ও কোমর বন্ধনী দায়ুদের কাছে সমর্পণ করেছিল। এভাবে যোনাথন দায়ুদের কাছে সমস্ত কিছু সমর্পণ করলেন। এর পরে যখন এক সময় তাদের সম্পর্ক প্রতিকূল অবস্থায় গেল তখন এই সমস্ত কিছু যোনাথনের আত্মত্যাগ ও ভালোবাসা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলো। দায়ুদ একজন মেষপালক হিসাবে, নিজেকে ভবিষ্যৎ রাজা হিসাবে নিজেকে দেখেছেন নিজেকে উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু রাজপুত্র যোনাথন তা পরিষ্কারভাবে দেখেছেন। নিজেকে রাজপুত্রের জন্য অস্বীকার করে। সেই সাক্ষ্য তিনি রেখেছেন।
ভালোবাসা কখনই আত্মস্লাঘা করে না (১ম করি ১৩: ৫) এক্ষেত্রে যোনাথন হচ্ছে একজন উৎকৃষ্ট উদাহরণ । যিনি নাকি রাজ্য ও সিংহাসন অধিকার করতে যাচ্ছেন। তার সাথে তিনি কখন ও হিংসা করেননি। তার নিজস্ব পদ ও মর্যাদার জন্য তিনি কখনই অহংকার করেননি। তাদের এই বন্ধুত্ব উভয়ের প্রয়োজন মিটিয়েছে। যোনাথন তার স্বার্থপর বাবার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছেন। দায়ুদকে অবশ্যই তার বড়ো ভাইদের সাথে প্রতিযোগী হতে হয়েছিল। বন্ধত্বের এই বিষয়টি আমাদের বহুমূল্য জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হয় এক্ষেত্রে তাই প্রমাণিত হয়েছিল। রাজা তালুতের ক্রমন্বয়ে চাপের মধ্যে দায়ুদকে দিন কাটাতে হয়েছিল। যে রাজা স্পষ্টতই তার ছেলের পদময়ার্দা যে হুমকির সম্মুক্ষীন তা বুঝেছিল। যোনাথন শুধু নিঃস্বার্থ ও আত্মত্যাগী ছিলেন না। তিনি অনুগত ও বিশ্বস্ত ছিলেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নিজ গৃহে দায়ুদকে সুরক্ষা করেছিলেন। যখন শেষ রক্ষা হলো না তখন দায়ুদকে তিনি পালিয়ে যেতে সাহায্যে করেছেন।
যোনাথন শত নিরাশার মধ্যেও দায়ুদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। রাজা তালুত সমস্ত ঘৃণ্য ও দায়ুদকে মারার জন্য তার পরিকল্পনা দায়ুদের ব্যবহারকে বদলে দিয়েছিল। এটা যথেষ্ট নিরাশা ছিল যে লোকটি ছিল। ঈশ্বরের/ সৃষ্টিকর্তা হৃদয়ের অনুসন্ধানকারী (প্রেরিত ১১:২২) বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় দায়ুদ নিজেকে ঠিক রেখেছেন। তিনি যেন শেষ পর্যন্ত পারলেন না। দায়ুদ এখানে তার জীবনে আর একটি বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করলেন। রাজপদ পাওয়ার জন্য তার আর লক্ষ্য স্থির থাকলো না। কিন্তু তিনি ঈশ্বরের/ সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভর করেছিলেন। কিন্তু দায়ুদ তার নিজের উপর ফিরিয়ে আনলো। কিন্তু এটা কাক্সিক্ষত ছিল না। যা ছিল মিথ্যা ও প্ররোচনার সুতায় গাঁথা। অনেক বন্ধুই হতাশাই এই স্থলে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন। কিন্তু যোনাথন করেনি। বরং তিনি ঘনিষ্ঠভাবে দায়ুদকে সাহায্য করেছেন। এবং তিনি দায়ুদকে ঈশ্বরের/ সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভর থাকতে বলেছেন। তিনি বলেছেন দায়ুদ ভয় কর না। আমার পিতা তোমার উপর তার হাত বিস্তার করবে না। তুমি অবশ্যই রাজা হবে। আমি তার পরের পদ থেকে তোমাকে সাহায্য করবে (১ম শমূ ২৩-১)
এখন তাদের উভয়ের জীবনের জন্য শেষ সময় উপস্তিত হলো। কিছু দিন পরেই যোনাথনকে হত্যা করা হলো। দায়ুদের বিলাপ আমাদের বলে দেয় তিনি কি গভীরভাবে এই ক্ষত মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, তুমি আমার জীবনে অতি প্রিয় বন্ধু ছিলে। তোমার ভালোবাসা ছিল সাংঘাতিকভাবে অনন্য। একজন প্রেয়সীর ভালোবাসার থেকে মধুর। দায়ুদ ও যোনাথনের মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক ছিল তাদের নিজ নিজ বিবাহিত জীবনে ও একই রকম মধুরতা ছিল না। যখন দায়ুদ রাজা হলেন। তখন বিশ্বস্তভাবে যোনাথনের জন্য তার প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন। (দ্বি; শমূ ৯ অধ্যয়) প্রায় তিন হাজার বছর ধরে এই বন্ধুত্বের কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। দায়ুদ ও যোনাথনের সম্পর্ক একটি আদর্শ বন্ধুত্বের উদাহরণ। যোনাথনের মতো বন্ধু পাওয়া যেন একটি স্বপ্নীল বিষয় স্মরণ করার মতো। অন্তরের গভীরতম স্থান থেকে আমরা সেরকম বন্ধুই হতে চাই।
মানুষে মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও গভীর বিষয়টি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত থাকা। এটা পরিষ্কারভাবে জানা যায় না যে, দায়ুদ ও যোনাথন তাদের সম্পর্ক ঈশ্বর কর্তৃক অধীষ্ট। ঈশ্বরের কাছে অনুরোধ জানানোর জন্য এ বিষয়টি অন্যতম (ফিলি, ৪:৬)
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, ঈশ্বর সে রকম বন্ধু আমাদের কাছে এনে দেন ‘প্রিয় ভাইয়েরা, তোমরা নিজেরা প্রতিশোধ নিয়ো না, বরং ঈশ্বরকে শাস্তি দিতে দাও। পাক-কিতাবে মাবুদ বলেন, “অন্যায়ের শাস্তি দেবার অধিকার কেবল আমারই আছে; যার যা পাওনা আমি তাকে তা-ই দেব।” কিতাবের কথামতো বরং “তোমার শত্রুর যদি খিদে পায় তাকে খেতে দাও; যদি তার পিপাসা পায় তাকে পানি দাও। এই রকম করলে তুমি তার মাথায় জ্বলন্ত কয়লা গাদা করে রাখবে। খারাপীর কাছে হেরে যেয়ো না, বরং ভালো দিয়ে খারাপীকে জয় কর।” (মথি ৫:৪৪-৪৫)
