খ্রীষ্টিয় নববর্ষ খ্রিষ্ট বিশ্বাসীরা চার্চে আড়ম্বরের সাথেই উদযাপন করে থাকেন। ছোটোবলা থেকেই দেখেছি, তরুণ-তরুণী, পৌঢ়-শিশুসহ সবাই নববর্ষকে বড়দিন উৎসবের শেষদিন হিসেবেই অঘোষিতভাবে মান্য করে থাকেন। অত্যন্ত সানন্দে চার্চে হাজির হয়ে আগামী দিনগুলো, পরিকল্পনা এবং সুস্থ জীবনের আকাঙ্ক্ষায় স্রষ্টা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা উৎসর্গ করে থাকেন। প্রায়শঃই যিশু খ্রিষ্টের শিক্ষা পবিত্র বাইবেলের এই অংশটি শ্রবণ করেছি—‘কোনো ব্যক্তির দ্রাক্ষাক্ষেত্রে তাঁর একটা ডুমুর গাছ রোপিত ছিল; আর তিনি এসো সেই গাছে ফল অন্বেষণ করলেন, কিন্তু পেলেন না। তাতে তিনি দ্রাক্ষা পালককে বললেন, দেখ, আজ তিন বৎসর এসে এই ডুমুর গাছে ফল অন্বেষণ করছি, কিন্তু কিছুই পাচ্ছি না; এটি কাটিয়া ফেল; এটা কেন ভূমিও নষ্ট করে। সে উত্তরে তাঁকে বললেন, প্রভু, এই বৎসরও ওটা থাকিতে দিন, আমি এর মূলের চারিদিকে খুঁড়ে সার দিব, তার পরে এতে ফল ধরে তো ভালই, নয় তো ওটা কেটে ফেলবেন।’ মানুষের যেমন ঈশ্বরের কাছে চাওয়া আছে, ঈশ্বরও মানুষের কাছে প্রত্যাশা করেন।
আমার গ্রামের অনুজ কমল সরেনকে জিজ্ঞেস করেছি, নতুন বছরের স্রষ্টার কাছে তোমার প্রার্থনা কী! খুবই উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিলেন, ঈশ্বর যেন আমাকে সুস্বাস্থ্যে রাখেন। সুস্থ থাকলেই জমিতে কাজ করতে পারব, ফসল উৎপাদন, পরিবারের জন্য খাবার সংকুলান, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ যোগান, নিকটজনদেরও কিছু সাহায্য করতে সক্ষম হবো। ঈশ্বরের কাছে আমার প্রাণের চাওয়াটাই হচ্ছে সুস্থ থাকা; শারীরিক-মানসিকভাবে ফিট থাকলে ঈশ্বরের জন্যেও কাজ করতে পারব। আরো প্রার্থনা করি, আমার দ্বারা যেন কোনো মানুষের অপকার না হয়, স্বজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে কারো অমঙ্গলের কারণ না হই। ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষকে যেন আমি মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি, কোনো ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাতির ভেদাভেদ না করি। সপ্তাহান্তে উপাসনা, সামাজিক কার্যাবলী সম্পাদন, অভাবী-দরিদ্র লোকদের সম্ভাব্য সাহায্য-সহযোগিতা করাকে নৈতিক দায়িত্ববোধ মনে করি। শুধু শুধু নিজের জন্য চিন্তা করাটা স্বার্থপরতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সামর্থ্যরে মধ্যে সামাজিক কল্যাণের ছোটো-বড়ো কাজ করা যায়। প্রত্যেকটি মানুষই বিশ্বাস করে উপরে স্রষ্টা, ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান, ঠাকুরজিউ রয়েছেন। তিনিই বিশ্বব্রাহ্মাণ্ডের মালিক, তিনিই আকাশ-বাতাস, নদী-সমুদ্র, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জীবন-মৃত্যু সমস্ত কিছু নিয়ন্তা। তাঁর হস্তের তালুতেই রয়েছে রিমোট কন্ট্রোল। তাই তো আমরা নিরুপায় হলে ঊর্ধ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করি, দু-হাত উচ্চে উঠাই, দীর্ঘশ্বাস ফেলি; তিনি তো ন্যায় বিচারক, তাঁর কাছে প্রত্যেকটি মানুষই সমান, তিনি কারো মুখাপেক্ষা করেন না।
খ্রিষ্টানুসারীরা বিশ্বাস করে, মানুষমাত্রই নিজ কর্মের গুণে বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যিশু খ্রিষ্ট বারবার ঈশ্বরের কাছে দয়া ভিক্ষা করেন। ডুমুর গাছের দৃষ্টান্ত খুবই পরিষ্কার—গাছে যদি কোনো ফল না ধরে, সেটিকে কেটে ফেলাই উত্তম ও বুদ্ধিমানের কাজ। বাগানের পরিচর্যকারীর শ্রমকে বৃথায় পর্যবসিত করে, গাছ মাটিকে নষ্ট করে, সর্বোপরি ওই গাছের পেছনে সময় ব্যয় করা ফলবান গাছকে বঞ্চিত করা হয়। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাছের ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়, এতেও যদি কাজ না হয়; সেক্ষেত্রে নির্ঘাত মাটিসহ গাছ উপড়ে ফেলতে হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে আমরা মানুষ কতটুকু নিজের জন্য কাজ করি, প্রতিবেশীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কিরূপ কিংবা কিরূপ মনোভাব পোষণ করি! নিজ ধর্মের না হলে তার সম্পর্কে আমার অভিব্যক্তি পজেটিভ নাকি নেগেটিভ! আদিবাসী-অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ হলে সত্যিই কি তার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে পারি! স্রষ্টা ঈশ্বর কর্মহীন, ফলবিহীন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারকে সংকীর্ণ করতে চাইলে মানুষের পক্ষে অনুনয় বিনয় করে চলেছেন যিশু খ্রিষ্ট। আরেকবার গাছের চতুর্পাশে মাটি কুপিয়ে, সার লাগিয়ে, কীটনাশক প্রয়োগ করে এবং সময়ানুযায়ী পানি দিয়ে পরিচর্যার পরও যদি ফল না ধরে; তাহলে নিশ্চয়ই আগুনের জন্যই প্রযোজ্য হবে! সত্যিই আমরা গাছের সাদৃশ্য, অবশ্যই আমাদের জীবন হতে হবে ফলদায়ক, মানব সেবামূলক, ঈশ্বরের ইচ্ছার পরিপূরণ করা।
মরণপণ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর আমরা ভুলে যায় একজন নিয়ন্ত্রক রয়েছেন, যাঁর হাতে রয়েছে জীবন ও মরণ। বছরের সূচনালগ্নে প্রত্যেকেই স্রষ্টার কাছে কিছু স্বপ্ন, পরিকল্পনা, আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে অদৃশ্য ঈশ্বরের কাছে যাচনা করি। জীবন চলার পথ মসৃণ ও ঝামেলামুক্তের প্রার্থনা স্রষ্টার কাছে সমর্পণ করি। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে গ্রাহ্যণীয় হলে হয়ত আমাদের প্রতি কৃপা করবেন, নইলে নয়। শাস্ত্রের মধ্য দিয়ে জানিয়েছেন, ‘কেননা আমি ক্ষুধিত হয়েছিলাম, আর তোমরা আমাকে আহার দিয়েছিলে, পিপাসিত হয়েছিলাম, আর তোমরা আমাকে পান করিয়েছিলে; অতিথি হয়েছিলাম, আর আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলে; বস্ত্রহীন হয়েছিলাম, আর আমাকে বস্ত্র পরিয়েছিলে; পীড়িত হয়েছিলাম, আর আমার তত্ত্বাবধান করেছিলে; কারাগারাস্থ হয়েছিলাম, আর আমার নিকটে এসেছিলে। তখন ধার্মিকেরা উত্তরে তাঁকে বলবে, প্রভু, কবে আপনাকে ক্ষুধিত দেখে ভোজন করিয়েছিলাম, কিংবা পিপাসিত দেখে পান করিছিলাম? কবেই বা আপনাকে অতিথি দেখে আশ্রয় দিয়েছিলাম কিংবা বস্ত্রহীন দেখে বস্ত্র পরিছিলাম? কবেই বা আপনাকে পীড়িত কিংবা কারাগারস্থ দেখে আপনার নিকটে গিয়েছিলাম? তখন রাজা উত্তরে তাদের বলবেন, আমি তোমাদের সত্য বলছি, আমার এই ভ্রাতৃগণের এই ক্ষুদ্রতমদের মধ্যে একজনের প্রতি যখন এটি করেছিলে, তখন আমারই প্রতি করেছিলে।’
আমাদের নতুন বছরের প্রার্থনা হোক ক্ষুধিত, পিপাসিত, বস্ত্রহীন, পীড়িত, কারাগারাস্থ কিংবা আশ্রয়হীনদের অতিথি হিসেবে সেবা দিতে। মানুষের সেবার মধ্যে দিয়ে স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট ও সেবা করা যায়। মানুষকে সেবা করতে না পারলে স্রষ্টাকে সেবা প্রদান করা যায় না। আসুন, স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষকে ভালোবাসি ও সেবা করি, এটিই হোক নতুন বছরের নিরন্তর প্রার্থনা।
মিথুশিলাক মুরমু : আদিবাসী গবেষক ও লেখক।