আজ ২৮ অক্টোবর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারী অনুযায়ী বৌদ্ধ ধর্মানুসারী ৮৯৮, ৬৫১ জন বসবাস করে। সর্বশেষ ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জনশুমারীতে বৌদ্ধরা মোট জনসংখ্যার ০.৬১ শতাংশ রয়েছেন। ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও অঙ্গসংগঠনগুলো সরকার পতনের লক্ষ্যে রাজধানীর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে। মহাসচিব ঘোষণা করেছেন, ‘২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে মহাযাত্রা শুরু হবে। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। অনেক বাধা আসবে, বিপত্তি আসবে। সব বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছুটে যেতে হবে।’ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী অন্যান্য দলও রাজপথে নেমে সরকারকে চাপে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। একই দিনে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের শান্তি সমাবেশ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে আয়োজন করা হয়েছে। রাজনৈতিক ত্রিমুখী কর্মসূচিতে শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন সম্মিলিত প্রবারণা পূর্ণিমা উদ্যাপন পরিষদ। ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় উৎসব উদযাপনে উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি প্রবারণা পূর্ণিমার বিষয়টি বিবেচনা করে আন্দোলন কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তনের বিনতী অনুরোধ করেছেন। প্রবারণা পূর্ণিমার ফানুস উৎসব পালনে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এক গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এটি তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। শুধু বৌদ্ধদের নয়, এটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রবারণার ফানুস উৎসবে সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে। ২৮ অক্টোবরের এ দিনে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ বৌদ্ধ বিহারগুলোতে আসা-যাওয়া করবেন। সকাল থেকেই ধর্মীয় বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে, যা চলবে দিনব্যাপী।
প্রবারণা বৌদ্ধ ধর্মীয় বিধানে বিনয়ভিত্তিক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্রতকর্ম ও অনুষ্ঠান। এর অপর নাম আশ্বিনী পূর্ণিমা। প্রবারণার এ আবেদন বৌদ্ধ ভিক্ষু জীবনে অধিক গুরুত্ব পেলেও বৌদ্ধ নর-নারী, উপাসক-উপাসিকাদের জীবনেও এর গুরুত্ব কম নয়। শুধু ধ্যানের দিকে থেকে নয়, আত্মশুদ্ধিতা, রিপু সংযম এবং আত্মোপলব্ধিতে এর অর্থবহ দিক অনুসারীদের পূর্ণ মনুষ্যত্ব বিকাশে অনেক অবদান রাখে। এ উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান তো আছেই, তার সঙ্গে আছে তাদের আত্মশাসন ও আত্মবোধের মূল শিক্ষা। এ যেন এক জীবনবোধ তৈরির সর্বোত্তম শিক্ষা। কারণ শাস্ত্রে প্রবারণার অর্থে বলা হয়েছে যে, প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা এবং নিষেধ করা। বরণ করা অর্থ হলো—বিশুদ্ধ বিনয়াচারে জীবনকে পরিচালিত করার উত্তম আদর্শ গ্রহণ করা। আর নিষেধ করা অর্থ হলো—আদর্শবান ও ধর্মাচারের পরিপন্থি কর্মগুলো থেকে বিরত থাকা অথবা ওইসব কর্ম পরিহার করা। অতএব অর্থের দিক থেকে প্রবারণার গুরুত্ব ও মর্যাদা অতীব মহান ও তাৎপর্যম-িত। তাই বৌদ্ধ প্রবারণা উদযাপনে বলা হয়, পাপ ও অশুভকর্ম থেকে মুক্ত থাকার জন্যই সৎ ও ব্রতকর্মের সাধনা। সুন্দর জীবন গঠনের ক্ষেত্রে এবং সত্যনিষ্ঠ ধ্যান সমাধির ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। অতএব শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাসাধনার পাশাপাশি আত্মসংযম ও ত্যাগ শিক্ষা বৌদ্ধ প্রবারণার একটি অপরিহার্য বিধান বলে বিবেচিত হয়েছে।
ধর্মানুসারীদের কাছে ধর্মীয় উৎসবাদি ধর্মীয় নির্দেশ, এটি কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ পুণ্যের আশায় ছুটে যান ধর্মীয় রীতিকে যথাযথভাবে পরিপালনের লক্ষ্যে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এটি সাংবিধানিক অধিকার। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পরিবারের বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তথা সর্বস্তরের অনুসারীরা আশির্বাদের প্রত্যাশায় অংশায়নকে আবশ্যিক মনে করেন। হৃদয়ের বিশ্বাসকে আমি, আপনি, আমরা কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারি না। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী হলেও দেশ গঠনে, উন্নয়নে, অগ্রগতি এবং দেশপ্রেমে নিজেদেরকে সুনাগরিক হিসেবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে। তাহলে কেন বিএনপি, জামায়াত ইসলামী দলগুলো এ দিনকে বেছে নিলেন! এটি কী ধর্মীয় অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে না! স্রষ্টার সাথে সম্পর্কে বিনির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলোর হঠকারিতামূলক ঘোষণা ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে সংখ্যালঘুদেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দেশের প্রতিটি ধর্মের ধর্মীয় উৎসবাদি সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে, নির্মল ও সম্প্রীতিমূলক পরিবেশে সম্পাদনের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করে; সেক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো ক্ষুদ্র ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় উৎসবাদির বিষয়টিকে গৌণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আমরা মর্মাহত, দুঃখার্ত ও হতাশাগ্রস্ত।
তিন মাস ধরে অবস্থান করার পর ধর্ম প্রচারের জন্য ভ্রমণে বের হওয়ার আগে বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে পারস্পারিক প্রবারণা তথা আমন্ত্রণ কর্ম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই প্রবারণা তথা আমন্ত্রণ কর্মটি করতে বলেছিলেন এভাবে: ‘অহং ভন্তে/আবুসো, আয়স্মন্তং পবারেমি দিটঠেন বা সুতেন বা পরিসঙ্কায় বা বদতু মং আয়স্মা অনুকম্পং উপাদায় পাসসন্তো পটিকরিসসামি।’ এর বাংলা অনুবাদ—‘ভন্তে/বন্ধু, আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি (আমার কোনো দোষ-ত্রুটি) দেখে থাকলে, শুনে থাকলে অথবা সন্দেহ পোষণ করে থাকলে অনুকম্পাপূর্বক আমাকে খুলে বলুন। আসলেই যদি আমার কোনো দোষ হয়ে থাকে, তাহলে আমি অবশ্যই এর সংশোধন করব।’ আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি রাজনৈতিক দলগুলো বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মীয় উৎসবের দিকটি অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করে সাংবিধানিক অধিকার পালনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে।
