বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তীকালে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি সহজেই চোখে পড়ছে রাস্তার ডিভাইডার, মেট্রোরেলের পিলার, রাস্তার আশপাশ ও গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালগুলোতে। ছবি ও লেখা সম্বলিত গ্রাফিতিতে আন্দোলনের চেতনা, স্বপ্ন, প্রত্যাশা, সম্প্রীতির বাণী এবং নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির আকাঙ্ক্ষা পরিস্ফুটিত হয়েছে। এটি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের কথা নয়, আপামর জনসাধারণের—জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবারই। দেশের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতিও রাজধানীসহ জেলাশহরগুলোর দেয়ালে দেয়ালে নিজেদের বঞ্চনা, বেদনা, অবহেলার কথাগুলো দৃষ্টিনন্দন তবে হৃদয়ের অব্যক্ত কথাগুলো শোভা পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা ‘কল্পনা চাকমা ১৯৯৬?’ আঁকতেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে হুশিয়ারী দিয়েছে। তাহলে কি ২০২৪ সালের স্বাধীনতাও আদিবাসীদের স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারে নাই!
আদিবাসীদের তথা সমগ্র ভারতবর্ষের অধিকার আন্দোলনের অগ্রপথিক হিসেবে স্বীকার করা হয় সাঁওতাল নেতা সিধু-কানু, চাঁদ-ভাইরো, জানো-ফুলমণিকে। ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, সহোদরদের শিকার হতে হয়েছিল মর্মভেদী মৃত্যুদণ্ডে। সেই বীরযোদ্ধাদের স্মরণে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তনগর মন্দির প্রবেশ পথে তীর-ধনুক সমেত সিধু-কানু ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়েছে চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা, সাথে সাথেই লাল ইটের ওপরে কালো কালিতে লিখে ফেলল ‘কালেমা চত্বর’। সিধু-কানু, তীর-ধনুক ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়া হৃদয় ভাঙার সমরূপ। এবার ঐতিহাসিক তীর-ধনুকের গ্রাফিতি চোখে পড়েছে ঢাকার রাজপথে। আদিবাসীদের জীবনের সংগ্রামের অপরিহার্য অধ্যায় হচ্ছে তীর-ধনুক। সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভীমপুর থেকে বাগদা ফার্ম সর্বত্রই অধিকার আদায়ের অন্যতম সঙ্গী হিসেবেই তীর-ধনুক জড়িয়ে আছে। সঙ্গত কারণেই ভাস্কর্য ভেঙে দেওয়ার পরই গ্রাফিতির মধ্যে দিয়ে চেতনার বহির্প্রকাশ ঘটানো হয়েছে।

কয়েক দশক থেকে আদিবাসীরা বরাংবার দাবি উত্থাপন করে চলেছে, আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির; স্বীকৃতি মিলেছে কিন্তু সেটি ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ হিসেবে। আদিবাসী ছেলেমেয়েরা ঢাকার রাজপথে গ্রাফিতিতে সেই আবেদনই রেখেছে, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র শব্দটির সামনে ক্রশ চিহ্ন এঁকে ‘আদিবাসী’ শব্দটির পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে নিচে সারিতে লেখা রয়েছে, ‘আমরা সবাই এক’। এছাড়াও মেট্রো রেলের পিলারগুলোতে শোভা পাচ্ছে, বাংলাদেশ বৃক্ষের শাখাস্বরূপ— ‘বৌদ্ধ, হিন্দু, আদিবাসী, মুসলিম, খ্রিষ্টান’, গাছের একপাশে সবুজ-লাল রংয়ে লিপিবদ্ধ, ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। বোধকরি, একজন উরাঁও শিক্ষার্থীই দেয়ালে এঁকেছেন, ‘আমি ওরাঁও, আমিই আদিবাসী, আমি বাংলাদেশী, সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই’। “আদিবাসী ওরাঁও’ সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই”। অন্যত্র শোভা পাচ্ছে—আমরা বাংলাদেশী, বাঙালী না! গ্রাফিতিতে জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখপূর্বক লেখা হয়েছে—‘আমি সাঁওতাল’, ‘আমি খাসিয়া’ ‘আমি ম্রো’; এভাবেই প্রায় ২৩টি জাতিগোষ্ঠীর নাম স্থান পেয়েছে। এরূপ আরেকটি গ্রাফিতি নজর কেড়েছে, চর্তুকোণে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নামগুলো রয়েছে, আর মাঝখানে লেখা রয়েছে— ‘এক জাতির দেশ নয়, বহু জাতির বাংলাদেশ’। অব্যক্ত কথাগুলো লেখার মধ্যে দিয়ে স্বাধীন মতামত পুনর্বার প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্বাস করি, আদিবাসী শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতির সাহায্যে দেশবাসীর দৃষ্টি ও মনোজগতকে আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। আদিবাসীদের প্রাণের দাবি ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতিকে তোয়াক্কা না করেই পঞ্চদশ সংশোধনীতে যুক্ত করা হয়েছিল ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ শব্দগুচ্ছটি। যে শব্দটিতে জাতিগোষ্ঠীগুলো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, সেই নামেই তাদের ডাকা হোক, অচিরেই আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয় কিন্তু পরবর্তীকালে চিত্রটি আমাদেরকে আহত করেছে। যে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সারথী, সেই আদিবাসী সমাজই এখন ভাঙচুর, সহায়-সম্পত্তি ও উচ্ছেদ আতঙ্কে নিদ্রাহীন রাত অতিক্রান্ত করছে। আমার পৈত্রিকভিটা রাজশাহীর, গোদাগাড়ী থানার সাঁওতাল পল্লী শিমলা দিঘীপাড়া তার একটি উদহারণ। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি গ্রামের নিরাপত্তাহীনতায় শিকার আদিবাসীর সাথে কথোপকথন হয়েছে, কেউ-ই আক্রমণের চিন্তায় প্রাণের ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেন না। ক্ষুব্ধতায় উচ্চারণ করেছেন, ‘বাঘে মহিষে লড়াই হয়, নলখাগড়ার জীবন যায়’। আদিবাসীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাঠের জমিতে, শহরের রেস্তোরায়, সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, চাকুরির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের জালে ধৃত হয়ে থাকেন; আবারও বৈশ্বিক রাজনীতি কিংবা দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির পট পরিবর্তনে টার্গেটে পরিণত হন। কেন এই নিরাপত্তাহীনতা, কেন এই নির্ঘুম রাত; শিক্ষার্থীদের বৈষম্য আন্দোলনও আমাদেরকে স্বস্তি দিতে পারে নাই।
আমাদের নতুন প্রজন্মের বহির্প্রকাশ দেয়াল গ্রাফিতিতে চোখে পড়ে। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পথ দীর্ঘ হলেও অজেয় নয়। বিশ্বাস করি, আমাদের প্রজন্মের সেই চেতনা, স্বপ্ন, শক্তি ও মনোবল রয়েছে।
