ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন শনিবার, সেভেন্থ ডে এডভেনটিষ্ট চার্চের সাব্বাথ দিন। গোপালগঞ্জ মিশনের খ্রিষ্টানুসারীরা সাপ্তাহিক উপাসনায় স্রষ্টার আরাধনায় মশগুল, গির্জার অভ্যন্তরে চলছে প্রশংসামূলক গান, পবিত্র বাইবেল পাঠ, প্রার্থনা এবং পুরোহিতের ধর্মীয় বাণী খ্রিষ্টান ভক্তজনদের উদ্দেশ্যে। সকাল ৯:৩০ মিনিটে শুরু হওয়া উপাসনায় মনোযোগ স্থির করে ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়ার ধ্যানে বিঘ্ন ঘটে স্থানীয় প্রশাসনের উপস্থিতি এবং বুলডোজারের ধ্বংসযজ্ঞ। বিনা নোটিশে অকস্মাৎ এসে মিশনের বাউন্ডারি দেয়াল গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করে। মিশনের বাউন্ডারির সঙ্গে সঙ্গে মিশনের কর্মচারীদের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে গির্জা সমাপ্তির পর দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হলে, তিনি জেলা প্রশাসনের ক্ষমতায়নকে উল্লেখ করেছেন। জেলা প্রশাসক এদিন জরুরি কাজে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে দেখেছি, বিক্ষুব্ধ খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ও মিশনের অভ্যন্তরে থাকা ছোট্ট শিশুরা প্রতিবাদে রাস্তায় মিছিল ও সমাবেশ করেছে। সম্প্রীতির গোপালগঞ্জে এ যেন লজ্জার কলঙ্কের তিলক!
জানা গেছে, জেলা প্রশাসন মিশনের সম্মুখভাগের রাস্তাকে চওড়া করণার্থে বেশ কিছুদিন পূর্বে অধিগ্রহণ করে। এ নিয়ে মিশন কর্তৃপক্ষের সাথে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। অপরদিকে মিশন কর্তৃপক্ষের আবেদন ছিল, যত কম মিশনের জায়গাকে অধিগ্রহণ করা যায়; সে বিষয়ে যেন গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়। দু-পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল যে, মিশনের বাউন্ডারি ওয়াল ভেঙে দেওয়ার পূর্বেই সরকার পক্ষ থেকে অধিগ্রহণের অর্থ পরিশোধ করবেন এবং মিশন কর্তৃপক্ষ ভেঙে দেওয়া প্রাচীরের ভিতরের দিকে নতুন প্রাচীর নির্মাণ করবেন, যাতে করে মিশন ও মিশনের অভ্যন্তরে থাকা হোস্টেল, গির্জা ও পরিবারগুলো নিরাপদে অবস্থান করতে সক্ষম হয়। মিশন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জেনেছি, পূর্বের আলোচনার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অদ্যাবধি মিশন কর্তৃপক্ষকে কোনো নোটিশ কিংবা মৌখিকভাবেও অবহিত করেননি। হঠাৎ করেই সাব্বাথ দিনে এসে তোড়জোড় করে ভাঙচুর শুরু করে। এটি যেমন কাঙ্ক্ষিত নয়, তেমনি ধর্মীয় অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে।
মিশন কর্তৃপক্ষ বলেছেন, প্রত্যেক বছর মিশনের শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষার্থে অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। বছরান্তের কোনো পরীক্ষা সাব্বাথ দিন শনিবার অনুষ্ঠিতের দিনক্ষণ ধার্য হলেই মিশন কর্তৃপক্ষ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান যে, সেভেন্থ ডে এডভেন্টিষ্ট চার্চের শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যার পরে পরীক্ষায় বসবেন। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসায় গোপালগঞ্জের প্রশাসনের কাছে অজানা নয় যে, সেভেন্থ ডে এডভেন্টিষ্ট চার্চের উপাসনার দিন শনিবার। তাহলে কেন উপাসনার দিন, যখন সবাই গির্জায় উপস্থিত; সেই সময় সরকারের প্রশাসনের লোকজন বেছে নিলেন? প্রশাসনের লোকজন এসে একটিবারও মিশনের কর্তৃৃপক্ষের খোঁজ নিলেন না কেন! কারণ এই প্রশাসনের লোকজনের মধ্যে সম্প্রীতির চেতনার অভাব রয়েছে। যে মিশন দেশের সবচেয়ে দরিদ্র, অবহেলিত, নিষ্পেষিত ও বঞ্চিতদের মনোজগত আলোকিত করার ব্রত নিয়ে লড়ে যাচ্ছে; একটিবারও কি সেই দিকটি বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন না? ২০২৩ সালেরর ২২ নভেম্বর এডভেন্টিষ্ট ইন্টারন্যাশনাল মিশন স্কুলের নতুন ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলমের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) গোলাম কবির। তিনি সেদিন মিশন কর্তৃপক্ষ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে থেকে শিক্ষার্থীদের ডিসপ্লে, খেলাধুলা, সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন। ইংলিশ ভার্সনের নব নির্মিত ভবনের দ্বারোঘাটন করতে করতে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মিশন স্কুলগুলোর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন; মাত্র দিন কয়েক পরেই মিশনকে এহেন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে এটি অকল্পনীয়।
দিন কয়েক পূর্বে একই চিত্র আমরা লক্ষ্য করেছি সেণ্ট গ্রেগরিতে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেণ্ট গ্রেগরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ। বিগত ২৪ নভেম্বর একদল শিক্ষার্থীর হামলা ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে সমগ্র খ্রিষ্টানুসারীর হৃদয়ের অন্তঃস্থল। খ্রিষ্টানদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি মানে-গুণে, ঐতিহ্যে এবং নিরপেক্ষতায় আপোসহীন, এরূপ প্রতিষ্ঠান হামলার শিকারে দেশবাসী যেমন নির্বাক ও সংক্ষুব্ধ হয়েছে; সম্প্রীতির অবারিত হাতও কালক্রমে যেন সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। খ্রিষ্টানুসারীরা হামলাকে কখনোই স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না, এগুলো সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ, মুক্ত চিন্তা ও দেশ গঠনের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকোজ করার প্রয়াস মাত্র। অবশ্য স্থানীয় অভিভাবকগণ বলেছিলেন, এ স্কুলে কোনো ঝামেলা নেই। পড়াশোনার পরিবেশ ভালো। এজন্য একটি প্রি ক্যাডেট থেকে ছেলেকে সেণ্ট গ্রেগরিতে ভর্তি করিয়েছিলাম। এ স্কুলের কেউ কোনো রাজনীতি বা অন্য কোনো ঝামেলায় জড়ায় না। ছাত্ররা তো এসবে যায়-ই না, শিক্ষক-কর্মচারীদেরও নিয়ম মানতে হয়। সেখানে এমন হামলা মেনে নিতে পারছি না।
আমরা মনে করি, সরকারের প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবেই সম্প্রীতির বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পে মেঘাচ্ছন্ন হচ্ছে। মিশনের শিক্ষার্থীদের সামনে প্রশাসনের যে মহড়া হয়েছে, কোমল মনা শিশুদের হৃদয় থেকে সেটিকে কী কখনো মুছে ফেলা যাবে! সাব্বাথ দিনে উপাসনা চলাকালীন প্রশাসনের দিক থেকে অসহিষ্ণুতা প্রদর্শিত হয়েছে, এটি তো এখন বহির্বিশ্বের কাছে নজির হয়ে থাকলো। প্রশাসনের হঠকারিতা আমাদেরকে সংক্ষুব্ধ করে তুলেছে। যে বিষয়টি পদ্ধতিগতভাবে সমাধান করা যেত, সেটি এখন আমাদের সরকারের জন্য নিন্দনীয় এবং লজ্জার। আমাদের দাবি, যারা মিশন বাউন্ডারি ভেঙে দেওয়ার সাথে যুক্ত, তাদের অতীতের দিকগুলো খতিয়ে দেখা হোক; তারা অসাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করে কী না! ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ জীবনে প্রশাসনের অপরিপক্ক চেতনা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে? সম্প্রীতির গোপালগঞ্জের পুনরাবৃত্তি আর আমরা দেখতে চাই না।
