সাম্প্রতিক সময়ে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার সময়সূচি আমার মেয়ে ক্যাথি প্রসন্নার হাতে পৌঁছেছে। পরীক্ষার দিন তারিখগুলো মিলিয়ে দেখতে গিয়ে আমাদের দৃষ্টি পড়ে এপ্রিল ২০, ২০২৫ রবিবার খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের অর্থাৎ আমাদের ইস্টার সানডের দিন। পরীক্ষা শুরু হবে ১০ এপ্রিল এবং শেষ হবে ১৩ মে, ২০২৫ খ্রি.। এবার বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষা দিয়ে শুরু হবে এসএসসি পরীক্ষা। নির্দিষ্ট দিনগুলোয় সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত তত্ত্বীয় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ব্যবহারিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ১০ থেকে ১৮ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে। ইস্টার সানডেতে পরীক্ষা—এটি কি করে সম্ভব? আমার এই ক্ষুদ্র জীবনকালে কোনো সময়ই শোনা হয়নি যে, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের ইস্টার সানডের দিন পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। বোঝার চেষ্টা করলাম, আসন্ন পরীক্ষার দিনক্ষণ কতোদিন আগে ঘোষিত হয়েছে, যারা এটির সাথে সম্পৃক্ত, তারা কি এই বিষয়টি সজ্ঞানেই এবং ইচ্ছাপূর্বক দিনটিকে বেছে নিয়েছেন? কিন্তু কেন? এরূপ হওয়ার কথা তো ছিল না। তথ্যানুযায়ী, বিগত ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে—মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকা/রাজশাহী/কুমিল্লা/যশোর/ চট্টগ্রাম/বরিশাল/সিলেট/দিনাজপুর/ ময়মনসিংহ’র পরীক্ষার সময়সূচি। যার স্মারক নং- আশিবো/প্রশা/২০১০/২০২। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটি ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা আহ্বায়ক প্রফেসর মো. আবুল বাশার স্বাক্ষরিত সূচি এখন খ্রিষ্টানুসারীদের কাছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

ইস্টার সানডে মানেই রবিবার। গুড ফ্রাইডে এবং ইস্টার সানডের তারিখ পরিবর্তিত হলেও দিন কখনোই পরিবর্তনীয় নয়। ইস্টার সানডে উৎসবটি খ্রিষ্টানদের জন্য এক দীর্ঘ ধর্মীয় যাত্রার পরিসমাপ্তির উৎসব। ইস্টারের পূর্বে গোটা বিশ্বের খ্রিষ্টানুসারীরা প্রভু যীশু খ্রিষ্টের অনুকরণে ৪০ দিনব্যাপী প্রার্থনা ও উপবাস করেন। বাৎসরিক এই উপবাসের দিনটিও শুরু হয় সর্বদা বুধবার দিন; এইজন্যেই এ দিন বা বুধবারকে অ্যাশ ওয়েডনেস ডে আখ্যায়িত করা হয়। উপবাসটি শেষদিন পুণ্য শনিবার অর্থাৎ ইস্টার সানডের পূর্বের দিন। খ্রিষ্টানুসারীরা উপবাসের শেষ সপ্তাহকে পুণ্য সপ্তাহ হিসেবে মান্য করে থাকেন। ইস্টার বা পুনরুত্থান পার্বণ একটি রবিবার পালিত হলেও এর সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় পর্বটি আরও আটটি বরিবার পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকে। মূলতঃ খ্রিষ্টানদের উৎসবগুলো পবিত্র বাইবেলে থেকে উৎসারিত; ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারে যিহুদীদের পাসওভার বা পাস্কা। নিউ টেস্টামেন্ট অনুসারে, রোমান সম্রাট কর্তৃক শুধুমাত্র এই কারণে প্রভু যীশুকে ক্রুশারোপিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল—তিনি নিজেকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে দাবি করেছেন। রোমান রাজ্যপাল পন্টিয়াস পিলাতের বিচারসভায় যীশুর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, সিজারকে রাজস্বদানে বাধা ও নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল। তবে যীশুর ক্রুশারোপিতের তিনদিনের মাথায় অলৌকিকভাবে তাঁর পুনরুত্থান প্রমাণ করে দিয়েছিল যে, তিনি সত্যিই ঈশ্বরের সন্তান।
সুদূর অতীত থেকে আমরা অবলোকন করে আসছি, খ্রিষ্টানদের ইস্টার সানডের দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলো ছুটি হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছুটি থাকবে ৭৬ দিন। ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ সালে প্রকাশিত স্মারক নং ৩৭.০০.০০০.০৭১.০৪.০০২.০২ (অংশ)-৫২৩ প্রজ্ঞাপনের ১০ নম্বরে ইস্টার সানডে, ২০ এপ্রিল ২০২৫ খ্রি. রবিবার, ০৭ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দে ১ দিন বরাদ্দ দেওয়া আছে যা রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে উপসচিব মোসাম্মৎ রহিমা আক্তার স্বাক্ষর করেছেন। সরকারি/ বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের প্রতিষ্ঠানের প্রধানের হাতে সংরক্ষিত তিনদিন ছুটি রাখা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন জাতীয়, আন্তর্জাতিক দিবস ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে নিয়ম মেনে ছুটি থাকবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ সরকারি কলেজ-৪ শাখা কর্তৃক প্রজ্ঞাপনে পরিলক্ষিত হয় যে, পুণ্য শুক্রবার, পুণ্য শনিবার এবং ইস্টার সানডে তালিকার যথাক্রমে ১০-১২তে রয়েছে। ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ সালে প্রকাশিত স্মারক নম্বর ৩৭.০০.০০০০.০৬৯.০৮.০০১.১৯.২৫। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোসা. রোকেয়া পারভীন স্বাক্ষর করেছেন।
সরকারি ছুটির তালিকায় ৮ নম্বরে রয়েছে—ভস্ম বুধবার ০৫ মার্চ, ২০২৫ খ্রি. (ঐচ্ছিক ছুটি-খ্রিষ্টান পর্ব); ১৯ নম্বরে পুণ্য বৃহস্পতিবার ১৭ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রি. (ঐচ্ছিক ছুটি-খ্রিষ্টান পর্ব); ২০ নম্বরে রয়েছে—পুণ্য শুক্রবার ১৮ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রি. (ঐচ্ছিক ছুটি-খ্রিষ্টান পর্ব); ২১ নম্বর—পুণ্য শনিবার ১৯ এপ্রিল, ২০২৫(ঐচ্ছিক ছুটি-খ্রিষ্টান পর্ব) এবং ২২ নম্বরে রয়েছে—ইস্টার সানডে, রোববার ২০ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রি. (ঐচ্ছিক ছুটি-খ্রিষ্টান পর্ব)। বলা হয়েছে—একজন কর্মচারীকে তার নিজ ধর্ম অনুযায়ী বছরে অনধিক মোট ০৩ (তিন) দিনের ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করার অনুমতি প্রদান করা যেতে পারে এবং প্রত্যেক কর্মচারীকে বছরের শুরুতে নিজ ধর্ম অনুযায়ী নির্ধারিত ০৩ (তিন) দিনের ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করার জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ ছুটি, নির্বাহী আদেশে সরকারি ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটির সাথে যুক্ত করে ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করার অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
বিগত কয়েক দশক থেকে আমরা নিরীক্ষণ করছি যে, ইস্টার সানডে দিন দেশের সকল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ছুটি ঘোষণা করে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল ইস্টার সানডে উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অফিস, ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষের (জুলাই ১ থেকে জুন ৩০) ছুটির তালিকায় দেখা যায়, ইস্টার সানডে উপলক্ষে ছুটি নির্ধারিত রয়েছে। বিশেষ দ্রষ্টব্যে লেখা রয়েছে— পর্বগুলোর ছুটির তারিখ পরে জানানো হবে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যতয় করেছে, ইস্টার সানডের দিন ক্লাস, পরীক্ষা গ্রহণ করে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে চরমভাবে ক্ষুন্ন করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো—সবচেয়ে বড়ো এবং আলোচিত পাবলিক পরীক্ষা হচ্ছে এসএসসি। পরীক্ষায় দেশের সব ধর্মের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে থাকে। খ্রিষ্টান ধর্মের জনসংখ্যা স্বল্প হলেও স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে সুনামের সাথে সেবা দিয়ে আসছে। যুগের পর যুগ অত্যন্ত যত্নসহকারে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের কাছে শিক্ষার সৌন্দর্যকে আরো পরিস্ফুটিত করে চলেছে। সেক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ ওয়াকিবহাল থাকবেন না, এটি আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। নিশ্চয়ই কোনো অসাধু কর্মকর্তাগণ খ্রিষ্টান ধর্মের ইস্টার সানডেকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন।
খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা (নবম-দশম শ্রেণী) প্রসঙ্গ কথাতে বর্ণিত রয়েছে—‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত হয়েছে মাধ্যমিক স্তরের সকল পাঠ্যপুস্তক। পাঠ্যপুস্তকগুলোর বিষয় নির্বাচন ও উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে শুরু করে ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিবোধ, দেশপ্রেমবোধ, প্রকৃতি-চেতনা এবং ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমমর্যাদাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে। …নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, সহনশীলতা, উদারতা ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ ও সাম্যের চেতনা উজ্জীবিত হয়ে সেই দিক বিবেচনায় রেখে অত্র পুস্তকটি রচনা করা হয়েছে।’ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ইস্টার সানডের দিনে এসএসসি পরীক্ষা পাঠ্যপুস্তুকের পরপন্থী চেতনা। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের ২৮ ও ৪১ অনুচ্ছেদের পরপন্থী। আমরা এদেশের মাইক্রোসকপিক সংখ্যালঘু, নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সামনে এরূপ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ কাম্য নয়। মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টাসহ প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলতে চাই—যারা হাজার বছরের সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পারিক সম্পর্কের ঐতিহ্যকে লালন করেন না; নিশ্চয়ই তাদেরকে প্রতিরোধ এবং ধর্মীয় অধিকারকে সমুন্নত করবেন।
