বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে; হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রম আর রক্তের বিনিময়ে আমরা এই দেশটা পেয়েছি। তাই এ দেশর জন্য আমাদের আবেগ-ভালোবাসা অন্য সবার থেকে ভিন্ন। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তন হচ্ছে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগে। আমি রাজনীতি খুব কম বুঝি আর রাজনীতি নিয়ে মাথা ব্যথাও কম। আমি এ দেশের নাগরিক, এই দেশটা আমার। চোখের সামনে দেশটার মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখলে অনেক খারাপ লাগে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সমর্থন, আমার মতো সচেতন প্রায় প্রতিটি নাগরিকের ছিল, আমারা সবসময় চেয়েছিলাম সুশৃঙ্খলভাবে এটার সমাধান হোক। আর একাত্তরে এই বৈষম্য নিরসনের জন্যই আমাদের দেশটা স্বাধীন হয়েছিল সেই হানাদার পাকিস্তানিদের কাছ থেকে। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়েছিল দেশটা স্বাধীন হবে এই স্বপ্নে। যেখানে থাকবে না ধর্মীয় ভেদাভেদ, বৈষম্য, সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে―সবার প্রতি সবার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান থাকবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হওয়ার পরও সত্যিকার অর্থে আমরা কী দেখি! যেখানে ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি, বৈষম্য, সাম্পদায়িকতা! এটা কি আমাদের কাছে শহীদেরা চেয়েছিল! এ জন্য কি তারা জীবন দিয়েছে?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে বড়োই অভাব রাজনৈতিক নৈতিকতা, প্রকৃত আদর্শ। ভদ্রতা-সম্মান দেওয়া প্রায় উঠে গিয়েছে। রাজনীতি করা এত সহজ না। অনেকেই কেন রাজনীতি করে সেটাই জানে না। অনেকের উদ্দেশ্য রাজনীতিকে পুঁজি করে নিজের স্বার্থ হাসিল করা। কিন্তু আমরা যদি দেখি শেরে বাংলা এ কে ফজলুর হক, হোসেন শহীদ সোহাওয়াদী , মাওলানা ভাসানী, মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান কীভাবে দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিল, জিয়াউর রহমান দেশ উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু বর্তমান আমরা ভিন্ন বিষয় দেখতে পারি। রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই, কারো প্রতি কোনো সম্মান শ্রদ্ধা-ভক্তি নেই। যা আছে শুধু তেলমারা। রাজনীতিকে সবাই ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করে। রাজনীতিতে যদি উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার না করেতে পারে হয়ত অনেক ব্যক্তি রাজনীতি ছেড়ে দিবে।
আওয়ামী লীগ দল ও সরকার হিসাবে ভালো-মন্দ মিলিয়েই চালালেও ক্রমশ তাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদি আচরণ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। যা দলের নীতি নির্ধারকরা দমনে ব্যর্থ হয়েছিল। স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তাদের এই অবস্থা। তাদের ব্যর্থতার কারণে অনেক মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তাদের ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যতার কারণে দেশের মানুষ দিনে দিনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনে এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন এটা হয়ত কারো কাম্য ছিল না। নানা বৈষম্যতার কারণে ছাত্র আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল শুরুর দিকেই এর সুন্দর সমাধান করা যেত কিন্তু ফ্যাসিবাদি মনোভাবের কারণে এই সমস্যা সমাধান হয়নি। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান-শ্রদ্ধা করি। নিঃসন্দেহে তাঁরা এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারাও এই বৈষম্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে।
সাম্প্রতিক জুলাই-আগস্ট মাসে আমাদের দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তার মূল কারণ ছাত্র-জনতার, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ ছিল, কষ্ট ছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলে তাদের ফ্যাসিবাদ মানুষ মেনে নিবে তা কিন্তু নয় । এখনও পীড়া দেয় ১৭-১৮ জুলাই ও ৫ই আগস্টের কথা মনে পড়লে, খুব ভয়ংকর একটা সময় পার করতে হয়েছিল এদেশের জনগণকে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখি নাই কিন্তু আইন শৃঙ্খলাবাহিনী যেভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে কিছু দুষ্কৃতকারী যেভাবে জাতীয় সম্পদ নষ্ট করেছে তা ভোলার মতো না। আন্দোলনের একদিন যথারীতি অফিস থেকে বের হয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা দেই, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলাম। ঢাকার বনশ্রী থেকে নতুন বাজার থেকে পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয়েছিল। রাস্তায় উৎসুক জনতা, কোনো যানবাহন নেই। কিছু সরকারি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছিল। বিটিভি ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাস্তায় মানুষের মধ্যে একটা উচ্ছ্বাস দেখেছিলাম। দুপুরের দিকের ভয়াভয় সংঘর্ষ লোকমুখে বর্ণনা শুনে অনেক খারাপ লেগেছিল ,আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ছাত্র-জনতা অনেকের প্রাণহানীর সংবাদ পাচ্ছিলাম। অনেক কষ্ট করে বাসায় পৌঁছানোর পর বুকের ভিতরে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি,আসলে দেশের মধ্যে কি হচ্ছে? পরদিন ছিন শুক্রবার, মিছিল-গুলি, টিয়ারশ্যাল, সাউন্ড গ্রেনেড, ককটেলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়, কিছু বুঝতে পারছি না দেশে আসলে কি হচ্ছে? হঠাৎ চোখ মুখ ঝাঁঝালো লাগছিল। তারপর আবিষ্কার করলাম টিয়ারশেলের কারণে এমন, ১৯ জুলাই ছিল একটা বিভীষিকাময় সময়। বারবার মনে হয়েছিল দেশে যুদ্ধ লেগেছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় দেশের অন্য স্থানের অবস্থা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তখনেই আঁচ করতে পরেছি, এটা এখন আর ছাত্র আন্দোলন নেই, সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সরকার কারফিউ দিল, সবকিছু নতুন পরিস্থিতির মধ্যে নিরাপত্তাহীন লাগছিল। নিরাপত্তাহীনতায় সবকিছু চলছিল, এদিকে আন্দোলন গতি পাচ্ছিল। হঠাৎ করে পাঁচ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। অনেকে বলছে তাকে বাধ্য করা হয়েছে। এরপর দেশের মধ্যে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে, পাঁচ তারিখের পর যে বিচার বহির্ভূত হত্যা হয়েছে তা দুঃখজনক । মানুষ হিসাবে এটা আমাদের কাম্য না।
কখনো কি নিজের মধ্যে এই প্রশ্ন জেগেছে? মানুষকে কেন শ্রেষ্ঠ জীব বলা হয় ? মানুষের চেয়ে তো অনেক বলবান ও সাহসী প্রাণী রয়েছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে মানুষের বড়ো পার্থক্য মানুষের একটা সুন্দর হৃদয় আছে। যা অন্য প্রাণীর মধ্যে নেই। মানুষের সুন্দর হৃদয়ে প্রেম, ভালোবাসা, নম্রতা, সহ্যগুণ, দয়ার স্বভাব বিরাজমান। আর এজন্য সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অন্যন্যভাবে সৃষ্টি করে করেছেন শ্রেষ্ঠ জীব। প্রতিটি প্রাণী মানুষের কাছে মাথা নত করে। কিন্তু যখন একটা মানুষের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা, নম্রতা, সহ্যগুণ, দয়ার স্বভাব বিরাজমান থাকে না তখন তাকে আর মানুষ বলা যায় না। মহাবীর আলেকজান্ডার জীবনের শেষে এসে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, অর্থ আর ক্ষমতা জীবনের একটা পর্যায় এসে আর কোনো কাজে দেয় না। তার উপলব্ধি হয়েছে ডাক্তার তার জীবন শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারবে না। তার হাত কফিনের বাইরে রাখার কারণ, তিনি শূন্য হাতে এসেছেন শূন্য হাতে চলে যাচ্ছেন। পথে ধন সম্পদ ছিটিয়ে দেওয়ার কারণ তিনি সারা জীবন যে ধন সম্পদের জন্য সব সুখ ত্যাগ করেছেন, সেই ধন সম্পদ তার কফিনের সাথে যাচ্ছে না। আমার গঁ শিউরে উঠে কিছু মানুষরূপী অমানুষের কার্যকলাপ দেখে, তারাও হয়ত জীবনে অনেক বড়ো বড়ো ডিগ্রি অর্জন করেছে এই পর্যায়ে আসতে।
সেই মধ্যযুগে কবি চ-িদাস, লিখেছেন, “সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।” জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “একই বৃন্দে দুটো ফুল হিন্দু-মুসলমান/ মুসলমান তাঁর নয়নের মনি, হিন্দু তার প্রাণ।” আজ আমরা ধর্মের দোহাই দিয়ে সব ভুলে যাচ্ছি, আমরা বুলে যাচ্ছি আমাদের মানবতা, আমাদের ইতিহাস, আমাদের সংস্কৃতি। আজ আমরা মানুষের জন্মগত অধিকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছি। মানুষের মানবতা বিকাশ, স্বাধীনতা মর্যদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ-সুবিধাগুলো আমরা হরণ করছি। আমরা নিজের সুবিধার জন্য ধর্মের অপব্যবহার করছি। তাই আর নয় অনেক হয়েছে।
মানুষ মানুষের জন্য, মানবতার সেবাই সবচেয়ে উত্তম ধর্ম। সব ধর্মই সম্প্রীতির কথা বলে। এ সম্প্রীতি বজায় রাখলেই বিশ্ব শান্তিময় হবে। মানুষে-মানুষে বন্ধুত্ব ও প্রীতি বাড়বে। একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। সমাজে শান্তি ফিরবে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামবে। ভালোবাসা দিয়ে থামাতে হবে হানাহানি। আমরা এক হব, ভালো থাকব, সুখে থাকব।
নাহিদ বাবু : লেখক ও কলামিস্ট।