রাজধানীর বনানীতে গৃহকর্মী তানিয়াকে গৃহকর্ত্রী সামিনা আলম বর্বরতা ছাড়িয়ে যে নির্যাতন ও অত্যাচার করেছে, এটিকে অবশ্যই মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা আবশ্যিক। সামিনা আলম তানিয়ার মুখে স্কচটেপ ও হাতে সুপার গ্লু লাগিয়ে ঘৃণ্য ও হীনম্মন্যতার পরিচয় দিয়েছে। বোধ করি, তানিয়ার ভবিষ্যতে কাজের স্পৃহাকেও সমূলে বিনষ্ট করেছে এবং শহরের মানুষ সম্পর্কে অমানুষ চরিত্রের ধারণা হৃদয়ের শেকড় সংগ্রোথিত হয়েছে। সভ্য সমাজের আড়ালে বিকার নির্মমতা ও মনুষ্যত্ববোধ যে ঢাকা ছিল, সেটি নিজ থেকে উদ্ভাসিত হয়েছে। এটিকেই বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তানিয়ার ভাই শফিকুর রহমান বোনকে নিজ জিম্মায় নিয়ে গেলেও প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ দায়ের করেননি, কারণ তিনি উপলব্ধি করেছেন, মামলা হচ্ছে অর্থ-বিত্তবান মানুষের কাছে ডাল ভাত। পুলিশ হচ্ছে—অর্থের লালসাকারী, তাদের কাছে ন্যায়-নীতি, নৈতিকতা, দায়-দায়িত্ব বলে কিছুই নেই। পুলিশ অর্থের মোহে মোহবিষ্ট হয়ে থাকে, এটি নিম্নশ্রেণীর মানুষজন যেমন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে; আদিবাসীদের ক্ষেত্রে বলার অপেক্ষা রাখে না। স্থানীয় প্রভাবশালী, ক্ষমতাবানরা, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের লোলুপ দৃষ্টি থাকে সহায়-সম্পত্তি, জায়গা-জমি, নারীদের দিকে; আদিবাসীদের চোখে সর্বদা আতঙ্ক লেগে থাকে। কালেভাদ্রে দুয়েকটি মামলার রায় পেলেও অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি, আমার নিজের পরিবার এটির জীবন্ত সাক্ষী। কখনো কখনো মনে হয়, আদিবাসীরা যেদিকে তাকাই সাগর শুকাইয়া যায়। আদিবাসীরা জীবনের সর্বস্তরের বিচার ভার অর্পণ করে থাকেন স্রষ্টা বা ঠাকুরজিউয়ের ওপরেই।
ঢাকা শহরে অনেক বিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা চাকরিজীবীদের পরিবারে আদিবাসী মেয়েরা গৃহকর্মী হিসেবে যোগদান করে থাকেন। পরিবারের স্বচ্ছলতা আনয়নে, ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফোটাতেই অন্যের ঘরে শ্রমিকের কাজ নিয়ে থাকে। উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল, উরাঁওসহ গারো, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা মেয়েরা গৃহকর্মী ও বিউটি পার্লারে বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছি, ধর্মীয় উপাসনায় কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে, এমনকি পরিচিত কারো কাছে যাবার সুযোগ কাদাচিৎ পেয়ে থাকে। কাক ডাকা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত নিরলসভাবে পরিশ্রমে অসুস্থ হলে তো কথায় নেই, কে তার পেছনে বাড়তি অর্থ খরচ করবে! আবার পরিবারের কোনো দুঃসংবাদে তাদেরকে নিজ গ্রামের বাড়িতে যাবার প্রাক্কালে বেতনের টাকা-পয়সা না দিয়েই প্রেরণ করে থাকে, যাতে করে পুনর্বার ফিরে আসে। অনেকেই ফিরে আসে, আবার অনেকে একেবারেই চলে যায়। অপরদিকে যারা বিউটি পার্লারগুলোতে কর্মরত রয়েছেন, তাদের অবস্থাও ভালো নেই। কাজের কোনো নিয়ম নেই, মালিকের নিয়মই অলিখিত বিধান। তথ্যানুযায়ী প্রায় ৬৮ শতাংশ বিউটিশয়ানই কমপক্ষে ১০-১২ ঘণ্টার বেশি কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করেন। বেশিরভাগ মালিকপক্ষ নিয়োগ পত্র দিতে অস্বীকার করে থাকেন, আবার অনেকেই রয়েছেন—কর্মীদের বন্ডসই নিয়ে রাখেন। ফলস্বরূপ বিউটি পার্লারে আদিবাসী নারীরা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। দেখা গেছে যে, সর্বাধিক বিউটিশিয়ানরা কর্মক্ষেত্রে ছুটি ভোগ করতে পারেন না।
ঢাকা শহরে আদিবাসী গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা বেশ কয়েকবার গণমাধ্যমে এসেছে কিন্তু কোনো সুরহা হয়নি। বিত্তবান মানুষেরা—ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অসহায়, দুর্বল হিসেবে গণ্য করে। শরীরের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রমের মূল্য দিতে কার্পণ্যবোধ করি, কর্মঘণ্টার নিখুঁত হিসাব-নিকাশ করে না দেওয়ার যৌক্তিকতা খুঁজে ফিরি। ঘরের অন্দর মহলের বিশেষ জিনিসগুলো হারিয়ে যাওয়া ভান করে চোর হিসেবে স্যাবস্ত করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করি, গৃহকর্মীকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হই। ঢাকার বড়ো বড়ো স্কুল-কলেজে অধ্যয়নের পরও আমাদের বিবেক অর্ধজাগ্রত থাকে, গৃহকর্মীদের গায়ে হাত তুলি, লোহার রড কিংবা খুন্তি দিয়ে ছ্যাকা দিই। শহরের বাবুদের দ্বারাই গৃহকর্মীরা ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে। এইজন্যেই শত কষ্ট-যন্ত্রণা ও মনোবেদনা থাকলেও কারো কাছে শেয়ার করে না, এগুলিকে নিছক কাজের অংশ হিসেবেই গণ্য করে থাকে। তানিয়ার ভাইয়ের কণ্ঠই গৃহকর্মীদের প্রতিনিধিত্ব করে, ‘যারা বোনকে নির্যাতন করেছেন, তাঁরা প্রভাবশালী। মামলা করে তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। তা ছাড়া মামলার খরচ জোগানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই।’ দুর্বল, অসহায়, নিরুপায় লোকদের ভরসা ও আশ্রয়স্থল হচ্ছেন স্রষ্টা, ঈশ্বর। তিনিই ন্যায্যতার দাড়িপাল্লাই মানুষকে বিচার করে থাকেন, অন্য কোনো পরিচিতি নয়; তাঁর কাছে আমরা প্রত্যেকেই মানুষ, এটিই ফাইনাল। অশান্ত ও দুঃখার্ত হৃদয়কে প্রশান্তি দিতে ঊর্ধ্বের স্রষ্টার কাছেই বিচারের ভার ছেড়ে দিই, তিনি তো রিজিকদাতা, জীবনদাতা ও নিয়ন্ত্রণ কর্তা।
মিথুশিলাক মুরমু : আদিবাসী গবেষক ও লেখক।