১৯শে জানুয়ারি ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র ৩০ বছর পূর্ণ হলো। সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করে অসাম্প্রদায়িক ও জাতি-দেশ বিরোধী, ধ্বংস-ষড়যন্ত্রকারীদের সমূলে উৎখাত এবং বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলন করে যাচ্ছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহীর মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। চিহ্নিত ও প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে নীল নক্সানুযায়ী ‘জামায়েত ইসলামী’র আমীর ঘোষণা করলে দেশপ্রেমীরা গর্জে উঠেছেন ভিসুভিয়াসের মতো। রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটলেও ‘এ আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুনামগঞ্জ থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত। শহীদের পুণ্যভূমিকে রাজাকারমুক্ত করতে নেতৃত্বের দায়িত্ব স্কন্ধে তুলে নিয়েছিলেন জাহানারা ইমাম, তিনি হলেন আহ্বায়ক। মা-মাটি-দেশকে শত্রুমুক্ত করতে জাহানারা ইমামের দরকার ছিল, মায়েরা নির্ভিক হয়ে উঠেন অস্তিত্বের জন্যে, সম্ভ্রম রক্ষার্থে অস্ত্রও তুলে নিয়েছেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারী ১০১ সদস্য বিশিষ্ট নাগরিক ঐক্যমতে পৌঁছান এবং সূচিত হলো একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। নির্মূল কমিটির উজ্জ্বল চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল, সংস্কৃতিক জোটসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের সম্পৃক্ততায় রূপ পেল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’।
স্বাধীনতার ক্ষণকাল পরেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্প্রীতির আদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপ্ন, দেশপ্রেমের চেতনাগুলো ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরবর্তিতে নির্বাসিত হয়েছে। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক আকাশে সাম্প্রদায়িক কালো মেঘের ঘনঘটা আদিবাসীদেরকেও স্পর্শ করেছে। দেশের অভ্যন্তরে আদিবাসীরা ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু—কেউ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-ক্রামা-সারণা ধর্র্মাবলম্বী; আবার কেউ জাতিগতভাবে সাঁওতাল, উরাঁও, মুন্ডা, গারো, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খাসি, মণিপরী জাতিগোষ্ঠী। সাম্প্রদায়িকতার সরল সমীকরণ হচ্ছে—১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব বাংলায় ২৯ দশমিক ৭ ভাগ ছিলো ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এসে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে; ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ১১.৭ শতাংশ, আর স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করেছে মাত্র ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু। বাকি ৩৭ শতাংশ স্থানচ্যুত হয়েছে ও নিরাপদ পোতাশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছে। ধর্মীয় ও জাতিগত ব্যানারে শত-সহস্র আদিবাসী স্থানচ্যুত হয়েছেন, এই সত্যটি অকপটে স্বীকার করে এবং নিরাপত্তার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে নির্মূল কমিটি। দেশের যে প্রান্তেই আদিবাসীরা নির্যাতিত হয়েছে, সেটি হোক রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অথবা ধর্মান্ধদের দ্বারা; একমাত্র নির্মূল কমিটিরই শেকড় থেকে সুত্রানুযায়ী মূল কারণ উদঘাটন এবং উম্মোচনের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা রয়েছে। ঘটনার শিকার হওয়া ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু আদিবাসীদের নিয়ে এসে সমগ্র জাতির সামনে মিডিয়ার মুখোমুখি করে প্রকৃত দোষীদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশের সংগঠন হচ্ছে নির্মূল কমিটি। রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যর্থ হলেও নির্মূল কমিটি দুঃসাধ্য কাজটি সহজসাধ্য করেছে। সাধারণ মানুষের অব্যক্ত কথাগুলোই যেন সংগঠনের কথা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জালে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আটকে পড়ার স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয় বলেছিলেন, ‘এ আইনে যাঁরা হয়রানির শিকার হয়েছেন, নিঃসন্দেহে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই’। এজন্যেই আদিবাসীদের সাথেও নির্মূল কমিটির সখ্যতা গড়ে উঠেছে, ভালোবাসার সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতিককালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্ম থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্যায়কে অন্যায় বলার সৎ সাহস এবং সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে নির্ভিকচিত্তের অধিকারী হচ্ছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। নিজস্ব সোর্স থেকে প্রতিবেদন প্রণয়ন করে সত্যিকারের চিত্রগুলো উপস্থাপন করেছে, একইরূপ ভূমিকা দেখেছি—দিনাজপুর পাবর্তীপুর উপজেলার আদিবাসী গ্রাম চিড়াকুটা ক্ষেত্রেও। আদিবাসীদের দুঃখ-কষ্ট, চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, মনোব্যথা সবকিছু উপলব্ধির মতো হৃদয় নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। আদিবাসীরাও এদেশের নাগরিক, প্রতিটি সংগ্রাম-আন্দোলনে তাদের অসামান্য অবদান রয়েছে, মানবিকতা সম্পন্ন সংগঠন হিসেবে নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই অধিকারের প্রশ্নে, যৌক্তিক দাবিগুলোতে কণ্ঠ মিলিয়েছে। আদিবাসীরাও মানুষ, এটি বড়ো পরিচয়; অবহেলিত, নির্যাতিত, অত্যাচারিত প্রান্তিক মানুষগুলোর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে উন্নয়নের মহাসড়কে সামিলের চেষ্টাকে খাটো করে দেখা যাবে না।
সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ণের দাবি জানানো সংগঠনসমূহের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নির্মূল কমিটি। আদিবাসীরা নানা ছুতায় আক্রান্ত হচ্ছে, জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি, বসতভিটা প্রভৃতি থেকে উচ্ছেদ, নির্যাতন, অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। দখল হচ্ছে কবরস্থান, শশ্মানও। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন কিংবা জাতীয় নির্বাচন এলে তটস্থ থাকতে হয় সার্বক্ষণিক। বিগত দিনগুলোর নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচনোত্তরকালীন সহিংসতামূলক ঘটনা আইনের যৌক্তিকতাকে আরো সময়োপযোগী করে তুলেছে। অগ্রজদের কাছ থেকে শ্রবণ করেছি, এ দেশে আদিবাসী, প্রান্তিক বা সংখ্যালঘু হিসেবে জন্ম হওয়া অপরাধ। নির্বাচন পরবর্তীতে ‘হেফাজত-জামায়াতের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বশ্রেণীর মানুষের উপর ঘটে যাওয়া অকথ্য ও অসহনীয় বিবরণকে জীবন্ত করেছে। সংগঠনটি অত্যন্ত কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, শুধুমাত্র ধর্মীয় ও জাতিগত কারণে সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এটি কখনোই ধর্ম নিরপেক্ষতার দেশে কাম্য নয়। সুরক্ষার জন্য আইনের জরুরি প্রয়োজন। অপরদিকে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পদে পদে শিকার হচ্ছে বৈষম্যের, হোটেল রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া, ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা কিংবা চাকরি ক্ষেত্রেও। পছন্দানুযায়ী ধর্ম পালনেও কখনো কখনো হেনস্তার শিকার হতে হয়। জাতপাত ও বর্ণবৈষম্যের ঊর্ধ্বে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার রয়েছে নির্মূল কমিটি।
একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে গোটা বিশ্বে মানবতাকামী মানুষের কাছে দাবিটি পৌঁছিয়েছে নির্মূল কমিটি। এ গণহত্যার শিকার হয়েছে দেশের প্রান্তিক আদিবাসীরাও। বিশেষ করে ’৭১-এর ১৯ এপ্রিল রাজশাহী, পুঠিয়া বাঁশবাড়ি; রাজশাহী গোদাগাড়ীর আমতলীপাড়া (কাশিঘুটু) ১১ জনকে হত্যা; ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে নভেম্বর নওগাঁর সাপহারের সৎপুর, পাইকবান্দা, হলাকান্দরের ৩৫ জন আদিবাসীকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। দিনাজপুর সদর ফার্মহাটেও আদিবাসীরা প্রতিরোধ গড়ে উঠলে নির্মম হত্যার শিকার হন। একাত্তরের গণহত্যা বর্বরোচিত তথ্যাদি, শহীদ পরিবারের ইতিহাস এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। বছরান্তের ২৫ মার্চ কালোরাত্রিতে মশাল প্রজ্জ্বলনে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা কিংবা বীরাঙ্গনাদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে ভূমিকা নিয়ে থাকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের আদিবাসীদের গৌরবোজ্জ্বল অবদান তুলে ধরেছে নির্মূল কমিটি, তুলে ধরেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত এলবার্ট এক্কা মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হওয়ার দুর্লভ তথ্যাদি উপস্থিত করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের যে অজস্র বীরত্বগাঁথা রয়েছে, সেটি দেশবাসী ওয়াকিবহাল নন; সুবর্ণ জয়ন্তীতেও আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতির আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, যা জাতির জন্য অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীরা যে গণহত্যা চালিয়েছে, এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যাকেও হার মানিয়েছে। পাকিস্তানীরা ধর্মের নামে যে কাজ করেছে, সেটি বিশ^বাসী জানা দরকার; গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সৌরভম-িত করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যায্যতার আন্দোলন, জনমানুষের সম্পৃক্ততা সার্থক হবে।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, বিশেষ করে তিন পার্বত্য জেলার আদিবাসীরা আশান্বিত হয়েছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে জীবনধারণ করতে পারবেন। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারই সেদিনও যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু রজত-জয়ন্তীতেও আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সরকারের সাথে মতানৈক্য কিংবা দূরত্ব ক্রমশঃই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অপর ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু স্বাক্ষরকারী অপর পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মতে, ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাগুলোর ১৮টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে আর ২৯টি সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। পাহাড়ের আদিবাসীদের প্রতি সরকারের উদাসীনতাকে সমালোচনা করে অবিলম্বে এবং দ্রুত চুক্তিনুযায়ী কার্য সম্পাদনে নির্মূল কমিটি মতামত ব্যক্ত করে চলেছে। অশান্ত পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত করতে শান্তিচুক্তির শতভাগ বাস্তবায়নের পক্ষাবলম্বন করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
মহানগর, নগর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘটে যাওয়া আদিবাসীদের জীবনযাপন ও সংগ্রামের বিষয়াদি তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে থাকে। ধর্মের ঊর্ধ্বে, জাতির ঊর্ধ্বে থেকে সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য দৃষ্টান্ত আদিবাসীদেরকে মোহিত করেছে। বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আবশ্যিকতা রয়েছে। আর এক্ষেত্রে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আমাদের সকলের কাছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হতে পারে। ইতোমধ্যেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের আস্থা ও কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে অবদান রেখে যাচ্ছে। এটিই নির্মূল কমিটির সৌন্দর্য।
মিথুশিরাক মুরমু : আদিবাসী গবেষক ও লেখক।