পাহাড় থেকে সমতল কিংবা চা বাগান থেকে দক্ষিণের সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত কোথাও কোনো জায়গার আদিবাসীরা শান্তিতে, আনন্দে, উৎফুল্লে বসবাস করতে পারছে না। রাজনৈতিক নেতারা, ক্ষমতাবানরা বরাবরই আদিবাসীদের জায়গা-জমি, শশ্মান-কবরস্থান, বসতভিটা দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। মনে হয়, এ যেন আদিবাসীদের দেশ থেকে উচ্ছেদ করে বাহবা এবং পুরষ্কার প্রাপ্তির গোপন এজেন্ডা রয়েছে। মূলত আদিবাসীদের ভূমিহীনে পরিণত করার প্রচেষ্টা এক সময় নিজ থেকেই নিরাপদ স্থানের খোঁজে স্থানান্তর হতে বাধ্য হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নীতি-নৈতিকতা রয়েছে এবং সেটির ব্যতয় ঘটলে অবশ্যই দলীয়ভাবে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দোষে দুষ্ট হবেন। তবে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের জন্যে বর্ণিত নীতিমালা, আদর্শ এবং দলীয় কর্মকা- থেকেও মানবিকতা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, ন্যায় বিচারের পক্ষে দাঁড়ানো; সর্বোপরি সত্যের পক্ষাবলম্বন করা। আদিবাসীদের কখনো ডানপন্থী, বামপন্থী, গণতন্ত্রপন্থী হিসেবে আখ্যা দিয়ে সর্বশ্রেণীর রাজনীতিবিদদের দ্বারা আক্রান্তের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কালেভাদ্রে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে তড়িত গতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দলের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল রাখার দৃষ্টান্ত আমাদেরকে একটু হলেও স্বস্তি দিয়ে থাকে। পিছিয়েপড়া, অনগ্রসর আদিবাসীদেরকে জন্মভূমিতে সুরক্ষা ও অধিকার নিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি আবশ্যিক।
বান্দরবান লামা থেকে আমার অনুজ বিনয় ত্রিপুরা মুঠোফোনে হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, আদিবাসীদের জুমের ফসল চিহ্নিত লোকজন পুড়িয়ে দিয়েছে। আমি তার কণ্ঠে উদ্বেগের, উৎকণ্ঠার যে শব্দাবলী শ্রবণ করেছি, সত্যিই অনুমিত হয়েছে হরিণের ডেরায় বাঘের উপস্থিতি। এতদিন শান্তিপূর্ণভাবে যে জীবনাচরণে অভ্যস্ত ও যুগের পর যুগের যে রেওয়াজ ও রীতিনীতি সম্মানিত হঠাৎ করেই কোম্পানির উপস্থিতিতে বিঘ্নিত হওয়া নৈতিকভাবে সমর্থিত নয়। লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ৩৯টি ম্রো ও ত্রিপুরা প্রায় ৪০০ একর বনাঞ্চলে বংশ পরম্পরায় জুমচাষ করে আসছে। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানি রাবার চাষের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কেটে উজাড় করে ও আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। ম্রো ও ত্রিপুরাদের বসতবাড়ি ও জুমের ফসল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিলুপ্ত প্রায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী ম্রো’রা গহীন বনাঞ্চলেই নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়ে থাকে, সেখানেও শহরের কথ্য সভ্য নাগরিকদের হস্তক্ষেপ; আমাদের বিবেক যেন অসাড় হয়ে গেছে। পার্বত্য এলাকায় একের পর এক জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নানা ধরনের সহিংস তৎপরতা এবং ভূমি দখলের ঘটনা ঘটে চলেছে। পাহাড়ি আদিবাসীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার।
সম্প্রতিকালে সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী বসবাসকারী উরাঁও আদিবাসীদের বসত জায়গা থেকে ভূমিদস্যুরা মাটি সরিয়ে তাদের জীবনযাত্রাকে হুমকির সম্মুখিন করে তুলেছে। তারা কয়েক দফা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বাঁচার আকুতি জানালেও, অর্থের মানদ-ে প্রশাসনের সুদৃষ্টি ক্ষমতাবানদের দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে। ঠাকুরগাঁও-এ ২৩ এপ্রিল পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মো. বাবুল-এর বিরুদ্ধে আদিবাসী সাঁওতাল ও উরাঁও’রা মিছিল ও মানববন্ধন করেছে। নানান ধরনের কলাকৌশল, কারসাজি করে জমি জবরদখলের হীনচেষ্টা করে। মানববন্ধনের দিনেও সাবেক কাউন্সিলর মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে উদ্যত হয়েছিলেন। ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টির লক্ষ্যে গুজব ছড়ান—আদিবাসীরা মসজিদে মুসল্লিদের ওপর হামলা করেছে! এ নিয়ে শহরের মন্দিরপাড়ার আদিবাসী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মারমুখি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সচেতন ব্যক্তিদের প্রচেষ্টা ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে কাউন্সিলর মো. বাবুলকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়। ১৭ এপ্রিল নওগাঁর পোরশার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের মুরলিয়া পাহাড়িয়া আদিবাসী গ্রামকে চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা রাতের আধারে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। মুরলিয়া গ্রামে অন্যতম জাতিগত সংখ্যালঘু পাহাড়িয়া’র প্রায় ৬০/৬২ পরিবার স্মরণাতীতকাল থেকেই বসবাস করে আসছে। গ্রাম ও পুকুরসহ আদিবাসীদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ মোট ৩৯ বিঘা, এটির মধ্যে ১৮ বিঘা বসতভিটা, পুকুর ও শশ্মান রয়েছে। বিগত বছরও এই সম্পত্তিকে নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় শশ্মান ও পুকুর সংলগ্ন জমি দখলের প্রচেষ্টা চালালে সংঘর্ষ হয় এবং মিনু পাহাড়িয়া নামে এক আদিবাসী নিহত হন। মনিল পাহাড়িয়া ছেলে মদন পাহাড়িয়ার বাড়িটি সম্পূর্ণ ভস্মিভূৎ হয়েছে, অন্যদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কিছুটা রক্ষা পেয়েছে।
রাজশাহী গোদাগাড়ীর বসন্তপুরে আদিবাসীদের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। ২৬ বছর ধরে ২৪ কাঠা জমি দখল করে আসছিলো স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা জালাল উদ্দিন ও তার তিন ছেলে শহিদুল, মাহাবুবুর রহমান, তাহাবুর রহমান। জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউপির ৩নং ওয়ার্ডে বসন্তপুর গ্রামে বাঁশঝাড় ও ভিটা মিলে ২৪ কাঠা জমি ওয়ারিস সূত্রে দুই ভাই জোহরলাল পান্না ও মোহরলাল পান্না মালিক হয়েছেন। দুই সহদরের পিতা গোহানু সরদার নাকি জালাল উদ্দিনের কাছে জমিটি হস্তান্তর করেছিলেন। দুই সহদর জমির ফেরত পেতে চাইলে নানাভাবে তাদেরকে হুমকি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করেছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন দুই পক্ষকে জমির কাগজপত্র সমেত থানায় হাজির হতে বললে, জালাল উদ্দিন কোনো কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। গোদাগাড়ী থানার ওসি কামরুল ইসলাম জানান, ‘জমিটির প্রকৃত মালিক গাহানু সরকারের ছেলে জোহরলাল পান্ন এবং মোহরলাল পান্না। অপর আরেকটি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী তানোর থানার মালশিরা গ্রামে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নাগরিক দেবেন মুরমু’র পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিটি রাজনৈতিক পেশীশক্তির প্রতীক ভূমিদস্যু হামিদুর রহমান দাবি করে আসছে নিজের সম্পত্তি বলে। অখ্যাত অঞ্চল ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর দেবেন মুরমুকে উচ্ছেদ করণার্থে ৩০/৪০ জনের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সাড়াশি আক্রমণ চালায়। ২৩ অক্টোবর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সন্ত্রাসী হামিদুর রাতের অন্ধকারে দেবেন মুরমু’র ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও হত্যার চেষ্টাও করে। ইতোপূর্বে অন্যান্য আদিবাসীর ঘরবাড়ি বাইরে থেকে তালা মেরে আটকে রাখা হয়েছিল। জানা মতে, আজ পর্যন্ত চিহ্নিত হামিদুর বীরদর্পে খোলা আকাশের নিচে বিচরণ করে চলেছে।
প্রতিটি ঘটনার সাথেই আদিবাসীদের জায়গা-জমি সম্পৃক্ত। আদিবাসীদের অজ্ঞানতা, সরলতা, পিছিয়েপড়ার কারণে সম্পত্তি রক্ষার আইন-কানুন সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নন। অন্যদিকে শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র এবং শহুরে বাবুদের লোলুপ দৃষ্টি ওই দুর্বলদের সহায় সম্পত্তিতেই। ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন বিবেক, আর বিবেকই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আদালত। দুর্বলদের সহযোগিতা, উন্নয়নে পাশে না দাঁড়িয়ে তাদেরকে ভূমিহীন, উচ্ছেদ, দেশত্যাগে বাধ্য করার প্রচেষ্টা আমাদের নৈতিক অবক্ষয়। মানুষের, সমাজের, দেশের নৈতিক অবক্ষয় বিশৃঙ্খলা ও ঈশ্বরীয় অভিশাপ নেমে আসে। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আদিবাসীদের প্রতি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হোন। অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করুন, অন্যায়ের সাথে যুক্ত গাছ, ডাল-পালাকে ছেঁটে ফেলুন। ঈশ্বর ন্যায়বানদের সাথেই অবস্থিতি করেন।
মিথুশিলাক মুরমু : আদিবাসী বিষয়ক গবেষক ও লেখক।