জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে তৎকালীন চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালির দায়িত্বগ্রহণকে স্মরণীয়-বরণীয় করতে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম জাতীয় চা দিবস পালন করা হয়। এ বছরটি ছিল দ্বিতীয় জাতীয় চা দিবস, প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল—‘চা দিবসের সংকল্প, সমৃদ্ধ চা শিল্প’। বিগত বছরের শ্লেগান ছিল—‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, চা শিল্পের প্রসার’। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনোত্তর চা-বাগান পুনর্বাসনে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের নিদের্শনা, চা-শিল্প ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পর মালিকানাবিহীন ও পরিত্যক্ত চা বাগান পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নেন। চা গবেষণা স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউটে পরিণত করেন বঙ্গবন্ধু। শ্রমিকদেরবিনামূল্যে বাসস্থান, শিক্ষা, রেশন পাওয়াও নিশ্চিত করেছিলেন। প্রথম চা দিবস বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চা শিল্পের অস্থিরতা মুজিবের ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন যেন ফিকে হয়ে যেতে বসেছে। তবে হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু জনমানুষের হৃদয়ের কথা, অব্যক্ত বেদনা এবং মুখায়ব দেখে উপলব্ধি করতে পারতেন, ‘আমার ভাইয়েরা, আমার বোনেরা’ কী চাই! কী তাদের না দিলেই নয়! তাঁর এই বোধশক্তি ছিল বলেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের নিরেট ও নিখাদ ভালোবাসা উৎসারিত হয়েছে।
মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গলের অদূরে অবস্থিত ভাড়াউড়া চা বাগান, ভুরভুরিয়া চা বাগান বেশ কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বাগান দুটিতে বেশ কয়েকটি করে সাঁওতাল পরিবার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। মূলত চা শ্রমিক নেতা ও এমএলএ শ্রী জীবন কিস্কু (১৯৩৭ ও ১৯৫৪) ওরফে জীবন সাঁওতাল সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করতে পৌঁছেছিলাম। জীবন কিস্কুর প্রোপৌত্র চন্দন কিস্কু (সাঁওতাল)-এর সাথে কয়েক দফা বসেছি, চা শ্রমিক নেতা রাজেন্দ্র প্রাসাদ বুর্নাজিও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। চা শ্রমিকদের আন্দোলনের সূত্রপাত এই দুটি বাগান থেকেই। চা শ্রমিকদের প্রাণের দাবি দ্রব্যমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি নির্ধারণ করা হোক। বর্তমানে মালিক পক্ষ ১২০ টাকা প্রতিদিন মজুরি দিয়ে থাকে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাগান মালিকেরা ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকাতে উন্নীত কিন্তু করেছে এতে করেও শ্রমিকেরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকেছেন। ‘বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন’ নেতারা বারংবার মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা করেও কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না।
আমি হবিগঞ্জের সুরমা চা বাগান, তেলিয়াপাড়া চা বাগান গিয়েছি অনেকবার। সুরমা চা বাগানে আয়োজিত মহান সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস উদযাপন উপলক্ষে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়া সুযোগ পেয়েছিলাম এ বছর। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, চা শ্রমিক সাঁওতাল, মুণ্ডা, পানতাঁতী, উড়িয়াসহ শ্রমিকদের জীবন সংগ্রাম। সাঁওতাল পরিবারে থাকার সুযোগও হয়েছে, স্বল্প পরিসরে নির্মিত ঘরে মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, বউ মা নিয়ে থাকা কতটা যে অস্বস্তিকর; ঠিক তা বলে বোঝানো যাবে না। মজুরি যে পায় তা দিয়ে কী খাবে! মোটা চালের দামও যে অর্ধশত টাকা ছাড়িয়েছে। সবজীর কথা তারা মুখে আনেন না। কাপড়-চোপড় বলতে হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি। সামাজিক-ধর্মীয় উৎসবাদিতে নতুন কাপড়ের বায়না ধরলে সন্তানদেরকে ভোলানো হয় নানান ধরনের ছল কৌশলে। চা কেন্দ্রিক জীবন গড়ে উঠেছে শ্রমিকদের, চা পাতার ভর্তা খায়, চা পাতা তুলে এনে সকালে চা ও চাল ভাজা হচ্ছে নাস্তা। এটিই বাস্তবতা, এটিই সত্য। চা বাগানে থাকা শ্রমিকদের পুষ্টিহীনতার দৈহিক গঠন, শীর্ণ চেহারা দেখলেই সহজেই অনুমিত হয়। বাগানের অভ্যন্তরে রয়েছে মদ্যপানের প্রতিযোগিতা, এটি আবার দেশীয় আইনে বৈধতা রয়েছে। দেশীয় মদের সহজলভ্যতার কারণে শ্রমিকেরা সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক জীবনের চিন্তা করতে পারে না; চিন্তা শক্তি অকর্মণ্য হয়ে পড়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষা, উন্নত জীবন কিংবা মজুরি বৃদ্ধির দাবিও কখনো কখনো উত্থাপন করতে সাহস পান না। বাগান ম্যানেজারদের হামবড়াভাবে শ্রমিকরা তটস্ত থাকে কখন কোন সময় মাস্টার রোলের কর্মী থেকে বাদ দিয়ে দেন। কতোটা পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে শ্রমিকরা অনড় অবস্থান নেয়, সেটি একমাত্র দেয়ালে পিঠ ঠেকলেই। আর এটি যদি চা শ্রমিকদের বাস্তবসম্মত দাবি হয়ে থাকে, জীবন জীবিকার প্রশ্ন হয়ে থাকে, তাহলে শ্রমিকদের দিকটি বিবেচনা করা আবশ্যিক। শ্রমিকরাই চা শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে, চা এখন আমাদের জাতীয় সম্পদ, রপ্তানিতে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। তথ্যমতে, দেশের ১৬৭টি বাগানের ৬১ হাজার ৬৭৮ হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে।
শ্রমিকরা বাগান থেকে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, সে লক্ষ্যে চালু করা হলো—Workman’s Breach of Contract Act (1859)। চা মালিকের অত্যাচার কেমন ছিল তা জানা যায়, সনৎকুমার বসুর Capital and Labour in India Tea industry (1859) বইতে ক্যাপ্টেন ল্যাম্বের ডায়েরি থেকে জানিয়েছেন। ক্যাপ্টেন ল্যাম্বের সাথে দেখা হয়েছিল সাতজন বনবাসী শ্রমিকের। এদের পিঠে ছিল গভীর ক্ষত। ল্যাম্ব এদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন, এই সমস্ত শ্রমিকেরা বাগানে রেশন না পেয়ে বাগান ছেড়ে অন্যত্র যেতে চেয়েছিল। বাগান থেকে বেরোবার সময় বাগানের পাহারাদারদের হাতে ধরা পড়ে যায়। এদের নিয়ে যাওয়া হয় বাগানের শাস্তির ঘরে। সেখানে হাত-পা বেঁধে প্রচণ্ডভাবে বেত্রঘাত করা হয়েছিল। তারপরে সেই ক্ষত স্থানে তেল ও নুন দিয়ে ডলা হয়েছিল। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির Slave Labour in Mordern India প্রকাশিত হলে খোদ লন্ডনেও প্রতিবাদের ঝড় বয়েছিল। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে রামকুমার বিদ্যারতন প্রণীত ‘কুলিকাহিনী’ আসাম ও উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের বর্ণনা পাওয়া যায়। সময় বদলিয়েছে কিন্তু চা বাগানের মালিকদের মানসিকতা পরিবর্তন হয়নি। বাগানের উন্নয়নে, উৎপাদন বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, শুধু নেওয়া হয়নি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের পদক্ষেপ।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমমন্ত্রী হিসেবে সিলেটের খাদিমনগর চা বাগানে পঞ্চায়েত ও শ্রমিকদের সাথে মতবিনিময় করেছিলেন। বাগানের শ্রমিকরা সেদিন বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের দুঃখ বলিয়া হয়রান হইয়াছি। আমাদের অনেক দুঃখ আছে। বহুবার জানাইয়াছি আর কতবার বলিব। বর্তমানে আমরা যে রোজী পাই পরিবার পরিজনের খরচ কুলাইতে পারি না, ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ চালাইতে পারি না। কাপড়-চোপড় দিতে পারি না। এই রোজীর দ্বারা ছেলে-মেয়েদের যত্ন ও শিক্ষা দিয়া মানুষ বানাইতে পারি না। আমরা যে চাউল পাই তাহাতে সকলের খোরাক পোষায় না। সপ্তাহে অন্ততঃ ২ দিন উপবাস করিতে হয়। শীতের কাপড় কিনিতে না পারিয়া ছেঁড়া বস্তা সংগ্রহ করিয়া শীত কাটাই।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতির জনকের স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু সেদিন সূচনা করেছিলেন কিন্তু অসমাপ্ত রেখে গেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন কিন্তু তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যা এখন সরকার প্রধান। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।
মিথুশিলাক মুরমু : গবেষক ও লেখক।