কয়েকদিন হলো খুলনার রূপসা উপজেলার শিয়ালী গ্রামের সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর চিহ্নিত দুবৃত্তরা পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ করেছে এবং গ্রামের চারটি মন্দির এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু দোকান ও কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর করেছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ প্রতিবাদে ঢাকায় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিল এবং দেশের বিশিষ্টজনেরাও বিবৃতি দিয়েছেন। অভিযোগ উত্থিত হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের পাশে দাঁড়াননি। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে পুলিশ আগেভাগে বিষয়টি জানলেও তাদের নিষ্ক্রিয়তা বা সময়ক্ষেপণ এসব ঘটনা ঘটার সুযোগ করে দিচ্ছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নিরব ভূমিকায় দুর্বৃত্ত ও সাম্প্রদায়িক শক্তির ঔদ্ধত্য ক্রমাগত বাড়িয়ে চলছে। প্রাজ্ঞবানরা বলেন, জাতি, সমাজ, দেশ দুর্বৃত্ত ও খারাপ লোকদের জন্যে নষ্ট হয় না, নষ্ট হয় ভালো লোকদের জন্য। যারা নীতিবান, ন্যায্যতা, উন্নয়ন, উন্নতি, সম্প্রীতির কথা বলেন, তারা যদি নিশ্চুপ ও উদ্যোগহীন থাকেন; তাহলে দুর্বৃত্তরা সুযোগ পায়। ধর্মের অনুশীলনকারীরা ধর্মান্ধ হলে দেশের আকাশ-বাতাস দূষিত হতে থাকে। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিককে মানবতার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন, ধর্মকে উচ্চ আসনে আসীন করেছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত বছর বিজয় দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে উল্লেখ করেছেন, ‘এ দেশ সকলের। …মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সব ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে।’ এটির চেয়ে নির্মম সত্য আর হতে পারে না, মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের যে প্রবাহ, সেটিতে দেশের প্রধান চারটি ধর্ম ব্যতিরেকে সাংসারেক, ক্রামা, সানামাহি, সারি সারণা, অপকোপা, শিখ, বাহাইসহ প্রভৃতি ধর্মের বিশ্বাসীর সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। আর জাতিগত হিসেবে সাঁওতাল, উরাঁও, মাহালী, মুন্ডা, কোল, ভীল, গারো, চাকমা, ত্রিপুরা, খাসিয়া, মারমা, বমসহ প্রায় ৭৩টি জাতিগোষ্ঠীর রক্তের স্রোত স্বাধীনতার সাগরে মিশেছে। দেশ মাতৃকার ডাকে সর্বস্তরের জনসাধারণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিষ্টান বা কে আদিবাসী-অন্ত্যজ শ্রেণীর; সেটির কোনো বাছবিচার ছিলো না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের পরিচয় ছিলো আমরা বাঙালী। সেদিন মিছিলে মিছিলে মানুষের হৃদয়ের সৌন্দর্যই প্রস্ফূটিত হয়েছে। মিছিলে ধ্বনিত হয়েছে—‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘আমার দেশ, তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা’, ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি, বাঙালি’। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছিলো অসাম্প্রদায়িকতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই আমাদের চেতনা বিবর্ণ হতে চলেছে!
অনুধাবন করতে কষ্ট হয়, অভিযোগ উঠেছে দেশের প্রশাসন, সামাজিক সংগঠন, সরকারি কিংবা বিরোধী দলের নেতা কর্মীরা খুলনায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। শুধু খুলনায় নয়, পাবনার সাঁথিয়ায় (২০১৩), কক্সবাজারের রামু (২০১২), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর (২০১৬), ভোলার মনপুরা (২০২০), সুমানগঞ্জের শাল্লার (২০২১) ঘটনাগুলোও জানি। তাহলে কী আমাদের মানবতার পরাজয় সুনিশ্চিত হয়েছে! আমাদের বিবেক কী অসাড় হয়ে গেছে! বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহসা বলেছেন, ‘…আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান।’ বাঙালি হিসেবে হাজার বছরের মিল মহব্বতকে তো আর অস্বীকার করা যায় না; বাঙালি সংস্কৃতি কোন অখ- বা অভিন্ন সংস্কৃতি নয়। এ সমাজ যেমন বহুভাগে বিভক্ত, এ সংস্কৃতিও তেমনি বহু রঙে রাঙানো। বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দু, মুসলমান, উচ্চবর্ণের হিন্দু, নিম্নবর্ণের হিন্দু, বৈষ্ণব, শাক্ত, বাউল, আশরাফ, আতরাফ, বৌদ্ধ, খৃষ্টান—সবার সংস্কৃতি। আমার বাংলাদেশ যে মানদণ্ড নিয়ে যাত্রার সূচনা করেছিলো, সময়ের ব্যবধানে আমরাই নিজেদেরকে বদলিয়েছি। হয়তো পূর্বাহ্নেই স্থপতি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সদ্য স্বাধীন দেশ পথ হারাবে; সেটিই যেন পরখে পরখে সত্যিতে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘…ক্ষমাপ্রাপ্ত কিছু কিছু লোক সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে না। বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান বাংলাদেশে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা সকলেই এদেশের নাগরিক। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর সম-অধিকার ভোগ করবেন (বাংলাদেশের সমাজ বিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস সম্পাদিত, আগামী প্রকাশনী)।
আমাদের প্রশাসন সবকিছু অবহিত হওয়ার পরও কেন ভূমিকা নেন না! আমিও দু’একজনকে প্রশ্নবান ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। সত্যিই কী আমাদের প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ভূমিকা নিতে পারতেন না! আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ কী তাদের হৃদয়কেও ছাপিয়েছে; হয়তো হ্যাঁ কিংবা না। তবে বাংলার আকাশে মেঘের ঘনঘটা যে হচ্ছে, সেটি খোলা চোখেই ধরা পড়ে। স্থপতি বঙ্গবন্ধু ধর্মের পরিচয় শেষান্তে দিয়েছেন, আমরা সেখানে ধর্মের পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। এখানেই এবং এই জায়গাতেই আমরা পরাজিত হয়েছি। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই; সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষকে অবজ্ঞা, হেয়জ্ঞান, অবিচারে নিরবতা যেন স্রষ্টাকেই উপেক্ষা করা হয়। সব ধর্মশাস্ত্রগুলো মানুষে মানুষে ভালোবাসা, প্রতিবেশীর সাথে সৌহার্দ্য সম্পর্ক এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উজ্জীবিত করেছে। ধর্ম আমাদের উদারতা, মানবিকতাবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা ও সহিষ্ণুতা শিক্ষা দেয়। ধর্মের বাণীগুলোকে বিশ্বাস করি কিন্তু মেনে চলি না। প্রশাসন কী ধর্ম, চেহারা বা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ লাভের আশায় নিশ্চুপ থেকেছেন! জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘…বাংলাদেশে কাহাকেও ধর্মের নামে রাজনীতি, ব্যবসায়, সম্পদ অর্জন ও জনসাধারণকে শোষণ করিতে দেওয়া যাইবে না (ইত্তেফাক ২৯ এপ্রিল, ১৯৭২)।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সমর্থকেরা যখন ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’ কিংবা ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগানে মুখরিত এবং জনউন্মাদনা সৃষ্টি করে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন; সেই সময় দেশের কবি, লেখক, সাহিত্যিক, চিত্রপরিচালক, অভিনেতা, শিক্ষাবিদ, গায়কসহ ৪৯ জন তারকা শিল্পী প্রতিবাদ চিঠি প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে প্রেরণ করেছেন। উদ্বেগ জানিয়ে লিখেছেন, ‘জয় শ্রীরাম যেন এখন যুদ্ধের হুংকার। এই শ্লোগানকে ঘিরে এখন আইনশৃঙ্খলা অবনতি হচ্ছে। আর এই বিশৃঙ্খলা হচ্ছে ধর্মের নামে। এটাতো মধ্যযুগ নয়। রামের নামে এই উন্মাদনা অবলিম্বে বন্ধ করুন।’ অবিলম্বে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা বন্ধের দাবি তুলে বলেছেন, গণপিটুনি ও ধর্মের নামে যে উন্মাদনা চলছে তা ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশের জন্য কাম্য নয়। ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের ওপর আঘাত স্বরূপ। নোবেল বিজয়ী অর্মত্য সেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘স্বাধীনতা-পরবর্তী কলকাতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন—‘ধর্ম নিয়ে ভারতবর্ষে এখন নতুন করে পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। ভারতের সংবিধানে বিভিন্ন ধর্মের যে স্থান, তাতে ধর্ম নিয়ে পার্থক্য থাকা উচিত নয়। কিন্তু যখন শুনি একজন রিকশাওয়ালাকে রিকশা থামিয়ে একটি বুলি আওড়াতে বলা হয়, সেই বুলি না আওড়ালে তাঁর মাথায় লাঠির বাড়ি পড়ে, তিনি রক্তাক্ত হন, তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে, তখন খুব খারাপ লাগে। কলকাতার ঐতিহ্য অনুসারে এটা কাম্য নয়। তাই এখন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মোকাবিলায় মানবাধিকার শিক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ছোটো থেকে শিশুদের সঙ্গে এই শিক্ষার পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আর এই সময়গুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সম্প্রতিকালে ভারতের ধর্মাচরণ সম্পর্কিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত সমীক্ষায় প্রতিবেশীর সাথে পারস্পারিক সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং ধর্মাচরণ ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। ভারতের ২৬টি রাজ্য এবং তিনটি টেরিটোরিতে ১৭টি ভাষার প্রায় ৩০ হাজার লোক তাদের মতামত দিয়েছে, আর এটির সম্পন্নকাল ছিলো ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিক থেকে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমদিক পর্যন্ত। জরিপে দেখা গেছে, ৩৬ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশী হিসেবে মুসলমানদের পছন্দ করেন না। অবশ্য বাকি ৬৪ শতাংশ হিন্দু প্রতিবেশী মুসলমানদের সাদরে গ্রহণ করছে, সেটিও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ভারতীয়রা আন্তঃধর্মীয় বা আন্তবর্ণের বিবাহেরও ঘোর বিরোধী। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ভারতীয়দের মধ্যে নিজের ধর্মের বা নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়তে বেশি পছন্দ করে। বলা হয়েছে, ভারতীয় প্রতি পাঁচজন মুসলমানের একজন বলেছেন, তারা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। ঠিক একই সঙ্গে ৯৫ শতাংশ ভারতীয় মুসলমান ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গর্ববোধ করে থাকে। তবে পিউ রিসার্চের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে—প্রধান প্রধান ধর্মের অনুসারীদের অধিকাংশ লোক বলেছেন, ‘সত্যিকার ভারতীয়’ হতে হলে ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা মনে করেন, সহিষ্ণুতাও ধর্মাচারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
নিছক অনুমান করি, ভারতের সাথে আমার দেশের জনমানুষের চিন্তা-চেতনার ফারাক খুব একটা নেই। সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্যও ভারতের দৃষ্টান্ত শিক্ষণীয় হতে পারে। আমার দেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ধর্মান্ধতাকে জয় করে মানবতাবোধকে জাগ্রত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে ধর্মের নামে ভন্ডামির বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলো যা আজকের দিনেও সমান প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শাহাদাৎ মৃত্যুর পূর্বে বলেছিলেন, ‘…জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে, দলমত-নির্বিশেষে, বাংলার জনগণ যে যেখানে আছেন, আজকে থেকে আমরা প্রতিজ্ঞা করে নতুন জীবন শুরু করব। আমরা নতুন বিপ্লব শুরু করব’ (বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫)। আসুন, মানবতাকে উচ্চীকৃত, মানবতার জয়গানকে ছড়িয়ে দিতে নতুন বিপ্লব শুরু করি।
মিথুশিলাক মুরমু : আদিবাসী বিষয়ক গবেষক ও লেখক।