রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়! মহান জাতীয় সংসদের সদস্য, আইন প্রণেতা শিবলী সাদিক (দিনাজপুর-৬ নং আসন) ক্ষমতাহীন, অনগ্রসর, পিছিয়েপড়া সাঁওতালদের জমি দখল করে স্বপ্নপুরীর পরিধি বিস্তৃতি করতে কৌশুলী হয়েছেন। স্বপ্নপুরীর পার্শ্ববর্তী আদিবাসী সাঁওতাল, মাহালীদের কবরস্থান, জায়গাজমি জবরদখল করে স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলতে হয়েছেন ব্যতিব্যস্ত। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও আদিবাসীরা ক্ষীণ কণ্ঠেই জানান দিয়েছেন, রক্ষকই ভক্ষক। একদা যিনি স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকারে প্রলুব্ধ করে ভোট হাতিয়েছেন, তিনিই এখন সাঁওতালদের স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছেন। সত্যিই বৈচিত্র্যময় আমাদের সাংসদরা, অদ্ভুৎ আমাদের চরিত্র; আমরা নির্বাক, হতভম্ব।
বিনোদনকেন্দ্র স্বপ্নপুরীর অবস্থান দিনাজপুর জেলা থেকে প্রায় ৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে আফতাবগঞ্জ উপজেলাধীন। উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরদিকে ৯নং কুশদহ ইউনিয়ন পরিষদের অধীন খালিপপুর মৌজার মধ্যে অবস্থিত। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে একান্ত ব্যক্তিতগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন এই পার্কটি। ১৫০ একর জমির ওপর নির্মিত নান্দনিক সৌন্দর্যের এক স্বপ্নিল জগত স্বপ্নপুরী। ইতিমধ্যেই সমগ্র উত্তরবঙ্গের নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শীতের আগমন থেকে শেষান্ত পর্যন্ত সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁওসহ জেলাসমূহ থেকে বাস, মাইক্রোবাস ভাড়া করে মানুষ ছুটে আসে স্বপ্নপুরীতে। একটু স্বাচ্ছন্দ্যে, একান্তে সময় কাটানোর ও নির্মল পরিবেশে প্রিয়জনদের সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে চলেছে স্বপ্নপুরী। দূরদুরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষের হৃদয়কে উদ্দীপ্ত করতে গড়ে তোলা হয়েছে চিড়িয়াখানা, বৈচিত্র্যময় ফুলের বাগান, কৃত্রিম হ্রদ, বর্ণিল মাছের সমাহার, রাইডসসহ জাদুর গ্যালারী। এছাড়াও রয়েছে রেষ্ট হাউজ, পিকনিক স্পট। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর অবয়বও দর্শনার্থীদেরকে আকৃষ্ট করে, এগুলোর মধ্যে এমি, মোরাল, ডাইনোসরসহ অসংখ্য ছোটো-বড়ো প্রতিকৃতি।
স্বপ্নপুরীর স্বত্তাধিকারী দেলোয়ার হোসেন ও সাংসদ শিবলী সাদিক তাদের স্বপ্নের পরিধিকে প্রসারিত করতেই হয়ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল আদিবাসী সাঁওতাল-মাহালীদের ভূমির দিকে। আদিবাসীদের পৈত্রিক সম্পত্তির দলিল-দস্তাবেজকে ক্ষমতার দাপটে কিংবা অর্থের জোরে ওলট-পালট করে দিয়েছেন। ভূমিপুত্র আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করে স্বপ্নের স্বপ্নপূরীর ষোলকলা পূর্ণ করতে বিনোদন কেন্দ্র বর্ধিতকরণে কী সামান্যতম বিবেক তাদের কাজ করে না! এ যেন বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।
আদিবাসীরা বুকে বল ও সাহস নিয়ে পৌঁছিয়েছে দিনাজপুর প্রেসক্লাবে। ক্ষমতাসীন সরকারের একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করা সত্যিই দুরূহ কাজ, আর সেই কাজটিই করেছে স্বপ্নপুরী পার্শ্ববর্তী জমির মালিকেরা।
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উকিল হেমব্রম, গণেশ হেমব্রম, খুকুমনি হেমব্রম, রবেন মার্ডি, অখিল হেমব্রম, লুইস হাঁসদা, সলোমন মার্ডীসহ অনেকেই মিডিয়ার সামনে নিজেদের বেদনার কাহিনী তুলে ধরেছেন। লিখিত বক্তব্যে সাংসদ শিবলী সাদিক ও তাঁরই চার্চ ও জাতীয় পার্টির নেতা দেলোয়ার হোসেনকে ভূমিদস্যু হিসেবে আখ্যা দিয়ে উঠে এসেছে—দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় স্বপ্নপুরী নামের বিনোদনকেন্দ্রে সাঁওতাল ও মাহালী সম্প্রদায়ের তিনটি কবরস্থানের দখল খবর। একটি কবরস্থানের ওপর স্বয়ং সাংসদ শিবলী সাদিক বাড়ি নির্মাণ করেছেন। অন্যদিকে তাঁরই চাচা সাঁওতালদের ৭৭ দশমিক ১১ একর জমি দখল করে আছেন। শুধু এটি নয়, এলাকায় কোনো জমি নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে জমির মালিক হয়ে যান দেলোয়ার হোসেন। আর এখন মুহুর্মুহু সাঁওতালদেরকে হুমকি, ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দাখিল করলেও প্রশাসন নির্বিকার; দায়িত্বরতদের যেন চোখ-কান-মুখ কিছুই নেই। বরং উল্টো নির্যাতনের কৌশল বদলায়, বেগবান হয়; আদিবাসীরা তটস্ত হয়ে পড়ে।
বিগত ৬ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে গণেশ হেমব্রম প্রকাশ করেছেন, তার ২০ দশমিক ৫৬ একর জমি দখলা করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩৩ শতক কবরস্থান, ২৮ শতকে কালীমন্দির ও পূজাপাঠের স্থান এবং ২ একর জমিতে পুকুর তৈরি করে দখল করা হয়েছে। খুকুমনি হেমব্রমের ২ দশমিক ৩২ একর জমি ও তাঁর বাড়িঘর দখল করা হয়েছে। খালিপপুর মৌজায় লুইস হাঁসদার ১ দশমিক ৬১ একর জমি দখল করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া রবিন মার্ডীর ২১ দশমিক ৮ একর জমি দখল করেছেন, যার অধিকাংশ জমি স্বপ্নপুরীর সীমানার মধ্যে রয়েছে। এসব জমি নিয়ে আদালতে একাধিক মামলাও চলমান। চোখের জলে ভয়ার্ত কণ্ঠে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উকিল হেমব্রম রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে জানাচ্ছিলেন, তাঁর ৩৩ শতাংশ জমির মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। বাকি সব বেদখল হয়ে গেছে। গ্রামের কেউ-ই ভয়ে কথা বলতে পারেন না। এছাড়াও স্বপ্নপুরী বিনোদনকেন্দ্রের ময়লা সাঁওতালদের কবরস্থানে ফেলা হয়। একমাসের বেশি সময় ধরে তিনি নিজ বাড়িতে যেতে পারছেন না। উকিল হেমব্রম জোর দিয়েই বলেছেন, ‘যেসব জমি দখল করা হয়েছে, তার প্রমাণ তাঁদের কাছে আছে।’ অভিযোগের প্রতুত্তরে জনাব শিবলী সাদিক সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘তিনি নিজে কোনো বাড়ি করেননি এবং চাচার বাড়িতে থাকেন বলে জানান।’ তিনি আরো জানান, ‘প্রায়ই তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হয়। কিন্তু এসব নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট মামলাও নেই।’ তিনিও এসবের তদন্ত চান উল্লেখ মন্তব্য করেছেন, ‘অভিযোগ সত্য হলে তিনি নিজ উদ্যোগে জমি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।’ বলেছেন, ‘আমরা সাত-আট বিঘা জমি ওই গ্রাম থেকে কিনেছি। এজন্য ওদের দাদা টাকা নিছে, বাবা টাকা নিছে, আবার ওরাও টাকা নিয়েছে। ভবিষ্যতে আমার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হওয়ার কথা শুনে প্রতিপক্ষ এসব করাচ্ছে।’ অপরদিকে তাঁরই চাচা দেলোয়ান হোসেন বলেছেন, জমির সব কাগজপত্র এবং সাঁওতালদের দাবি সত্য নয়। তাঁর সব জমির কাগজপত্র আছে। দেলোয়ার হোসেন আরো জানিয়েছেন, ‘স্বপ্নপুরীতে মোট জমি আছে ৫৬ একর। যাঁরা সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তাঁরা দাবি করেছেন ৭৩ একর। মূলত এই জমিগুলো ছিল এক সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের। দেশভাগের সময় তিনি চলে গেলে জমিগুলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নামে রেকর্ডভুক্ত হয়। জমিগুলো তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে কিনেছেন, যার রেকর্ড, খাজনা, দলিল সবই আছে। এমনকি যাঁরা সংবাদ সম্মেলন করেন, তাঁরা সর্বশেষ পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন, কিন্তু এখনো জমি বুঝিয়ে দিতে পারেননি। কেউ হয়ত তাঁদের উসকানি দিয়ে এগুলো করাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।’
আদিবাসী সাঁওতালদের দাবি কতটুকু যৌক্তিকতা রয়েছে—শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার লক্ষ্যে এত বড়ো অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে না। দিনাজপুরের রাজপথে মানববন্ধন, জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন সত্যিই একটু হলেও আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। স্বপ্নপুরীর আশেপাশের অসংখ্য আদিবাসী মানুষের কাছ থেকেও বোঝার চেষ্টা করেছি, সত্যিই রহস্যের ঘোরটোপে বাঁধা পড়েছে ভুক্তভোগীরা। ফুলবাড়ি-আফতাবগঞ্জের বাতাসেও গন্ধ ভেসে আসে, কান পাতলেও শোনা যায় আদিবাসীদের রক্তক্ষরণের নিরব কান্না। পূর্বপুরুষদের নিরক্ষরতা ও অসচেতনার সুযোগ পূর্ণোদ্যমে ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। একমাত্র জমির কাগজপত্রের নির্ভুলতাই প্রমাণ করে সত্যিকারের ভূমির মালিকানা। পূর্বাহ্নে দেখেছি, আদিবাসীদের আক্রমণ, উচ্ছেদ, জবরদখলের শিকার হলে সচেতন নাগরিক সমাজ বেরিয়ে আসতেন, এখন আমাদের বিবেক অসাড় হয়ে গেছে। সত্যিকে উদঘাটনের লক্ষ্যে উদগ্রীব হতেন, ক্রমশই আমরা নিস্তেজ হয়ে পড়েছি। আদিবাসীরা সংখ্যালঘুর চেয়েও সংখ্যালঘু, আদিবাসীদের জমি জায়গা টার্গেট করেই দখল করা হচ্ছে প্রতিনিয়তই। সাংসদ শিবলী সাদিক আপনি তো আইন প্রণেতা, আইনের শাসনকে প্রতিষ্ঠাকল্পে অগ্রগণ্য হবেন কিন্তু আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে নিরীহ আদিবাসীদের সহায় সম্পত্তি গ্রহণ করা নৈতিকতার পরিপন্থী। দেলোয়ার হোসেন মানুষের শেষ অবলম্বনকে করায়ত্ব করে স্বপ্নের পুরী কি সত্যিকার আনন্দ দিতে সক্ষম! স্বপ্নপুরীর আনন্দকে ছাপিয়ে এখন শোনা যাচ্ছে আদিমতম মানুষের আজাহারি, ডুকরে ডুকরে কান্নার আওয়াজ, রাতের আঁধারে উচ্ছেদের চিৎকার এবং নিরানন্দ জীবনের ছাপ।
মিথুশিলাক মুরমু : আদিবাসী গবেষক ও লেখক।
[লেখাটি সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তনের বর্ষ ৬, সংখ্যা ৩০, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত]