যদিও দিনটি অনেক ছোট তবুও ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ ভাষাভাষী মানুষেরা এই দিনটিকে ‘বড়দিন এই শব্দ দ্বারা প্রকাশ করে থাকে। কেন এই দিনটিকে বড়দিন বলে? কারণ এই দিনে মানব জাতির উদ্ধারের জন্য স্বয়ং ঈশ্বর পুত্র হিসাবে এই ধরণীতে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি মানব দেহে যখন প্রকাশিত হলেন তাঁকে ‘যীশু’ নামে অবিহিত করা হলো, যা ঈশ্বর পূর্বেই ঠিক করে রেখেছিলেন। যে নামের অর্থ ‘ত্রাণকর্তা’। ঈশ্বরের পরিকল্পনা কি শুধুই পাপ থেকে উদ্ধার করার অভিপ্রায় ছিল নাকি আরো বিষয় ছিল? যদি আমরা আদিতে ফিরে যাই তবে দেখতে পাবো যে পৃথিবীর প্রথম মানব মানবী আদম ও হবা যারা ঈশ্বরের অবাধ্য হয়ে শয়তানের প্ররোচণায় প্রথম পাপ করল এবং সমস্ত মানব জাতিকে পাপের মধ্যে ঠেলে দিল। আর তাদের সম্পর্ক সব কিছুর সাথে ছিন্ন হয়ে গেল। হারিয়ে ফেলল তাদের সমস্ত অধিকার। বাইবেল প্রকাশ করে যে ঈশ্বর তিনি চান না যেন তাঁর প্রিয় সৃষ্টি নষ্ট হয়ে যাক তাই তিনি একটি উদ্ধারের রাস্তা স্থাপন করলেন যেন মানব জাতি আবার তার অধিকার ফিরে পেতে পারে। ঈশ্বরের পরিকল্পনা শুধুমাত্র মানুষের পরিত্রাণই নয় কিন্তু পাপে পতনের সমস্ত ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলোকে পুনর্গঠন করা—
১. আমাদের প্রভুর সাথে সম্পর্ক
২. আমাদের একে অন্যের সাথে সম্পর্ক
৩. এছাড়া জগতের অন্যান্য সমস্ত কিছুর সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা
১. আমাদের প্রভুর সাথে সম্পর্ক
যদি আমরা বাইবেলে প্রথম অধ্যায় দেখি সেখানে আমরা দেখতে পায় যে মানুষ সে পবিত্রভাবে তার সৃষ্টিকর্তার সাথে নিয়মিত সম্পর্ক স্থাপন করে চলছিল, কিন্তু যখনই তারা পাপ করলো সাথে সাথেই সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল পাপের কারণে। অর্থাৎ ঈশ্বরের সাথে সেই পবিত্র সম্পর্ক আর থাকল না। কারণ বাইবেল বলে ঈশ্বর পবিত্র তাঁর মধ্যে পাপের লেশ মাত্র নেই, তাই পাপ নিয়ে আমরা তাঁর কাছে আসতে পারি না। তাই আমাদের তাঁর কাছে আসতে গেলে অবশ্যই পবিত্র হতে হবে। তিনি বাইবেলে বারবার প্রকাশ করেছেন যে “তোমরা পবিত্র হও, কারণ আমি পবিত্র” (লেবীয় ১১ : ৪৪)। তাই আমাদের তাঁর কাছে যেতে গেলে পবিত্র হওয়াটা অত্যাবশ্যক। আর মানুষ তার নিজের ক্ষমতায় সেই পবিত্র হওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব না। যেহেতু ঈশ্বরের প্রিয় সৃষ্টি মানব তাই তিনি চাইলেন যেন সেই মানব আবার তার পবিত্রতা ফিরে পাক। সেটি কীভাবে সম্ভব? যেহেতু মানবজাতি পাপ করেছে তাই মানুষকেই সেই মূল্য দিতে হবে যার পরিণাম হলো মৃত্যু (রোমীয় ৬ : ২৩)। আর সেই মৃত্যু এমন একজনের হতে হবে যার কোনো পাপ নেই। বাইবেল বলে মানবজাতির মধ্যে এমন কেউই নেই যে সে পাপহীন ও এই মূল্য দেওয়ার জন্য উপযুক্ত (রোমীয় ৩ : ২৩)। তাই প্রভু তিনি নিজে পরিকল্পনা করলেন এই পৃথিবীতে মানুষরূপে এসে এই পতিত মানব জাতিকে যেন পাপ থেকে উদ্ধার করতে পারেন। আর তিনি পুত্র হিসাবে এই জগতে এলেন (যোহন ৩ : ১৬)। বহু বছর ধরে অনেক ভাববাদীদের মধ্যে দিয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন যে তিনি মানুষরূপে এই পৃথিবীতে আসছেন, (যিশাইয় ৭ : ১৪, ৯ : ৬-৭)। তিনি কুমারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন ও আকারে প্রকারে মনুষ্যবৎ হলেন ও ক্রুশীয় মৃত্যু পর্যন্ত আজ্ঞাবহ রইলেন। তাঁর ক্রুশের মৃত্যু মানব জাতিকে ঈশ্বরের ক্রোধ থেকে বাঁচালেন। কারণ যে কেহ যীশুকে বিশ্বাস করবে সে সমস্ত দণ্ডাজ্ঞা থেকে রক্ষা পাবে (রোমীয় ৮ : ১)। আর যীশুর ক্রুশের মৃত্যু আমাদের পবিত্র হওয়ার নিশ্চয়তা দেয়-(১ যোহন ১ : ৭,৯)।
২. আমাদের একে অন্যের সাথে সম্পর্ক
শুরুতে প্রভু যখন আদমকে তাঁর প্রতিমূর্তিকে তৈরি করলেন তখন সে তার নিজের একজন সঙ্গিনীর প্রয়োজন অনুভব করলো। তাই ঈশ্বর সেই আদম থেকে তার সঙ্গিনী হিসাবে হবাকে তৈরি করলেন, যেন তারা একত্রে প্রভুর গৌরব করতে পারে ও এই সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পারে। ততক্ষণ অবধি তারা সেই সম্পর্ক ঠিক রেখেছিল যতক্ষণ অবধি তারা পাপ না করেছিল। যেই তারা পাপ করলো আর অমনি তাদের মধ্যে সেই দোষারোপের মনোভাবের সৃষ্টি হলো ও একে অপরকে দোষারোপ করা শুরু করলো। আর এই মনোভাব মানব জাতির মধ্যে প্রবেশ করল। আমরা যদি পরবর্তী সৃষ্টির থেকে বর্তমান মানব জাতির ইতিহাস দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাবো বিভিন্ন ধরনের মানবজাতির মধ্যে বৈরিতা এবং আজও আমরা তা বহন করে চলেছি। তাই ঈশ্বর তিনি চাইলেন যেন আমরা সেই একে অপরের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করি ও তাঁর গৌরবের মধ্যে প্রবেশ করি। তাঁর জগতের আগমনে আমাদের একে অন্যের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। বাইবেল বলে আমরা যেন আমাদের প্রতিবেশিকে নিজের মতো প্রেম করি (মার্ক ১২ : ৩১)। আর এটি বৃহৎ দুটি আজ্ঞার মধ্যে একটি। এর অর্থ কি? যেন আমরা সকলে সৃষ্টির শুরুতে যেমন ছিলাম তদ্রুপ হই। যীশু আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, যদি আমরা প্রার্থনা উৎসর্গ করতে যাই, অথচ আমরা যদি আমাদের ভাইকে ক্ষমা না করি, তবে প্রথমে সেই নৈবেদ্য যেন সেখানে রাখি। তারপর আমাদের ভায়ের কাছে গিয়ে মিটমাট করে এসে যেন প্রার্থনা উৎসর্গ করি, তবেই প্রভু তিনি শুনবেন (মথি ৫ : ২৩-২৪)। অর্থাৎ আমাদের অবশ্যই আমাদের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে হবে, যেটা যীশু আমাদের সাহায্য করবে।
৩. এছাড়া জগতের অন্যান্য সমস্ত কিছুর সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা
আমরা যদি একটু শুরুতে ফিরে যাই, তবে আমরা দেখতে পাবো যে মানুষকে সৃষ্টি করার পর যে স্থানে ঈশ্বর রাখলেন সেই স্থানের নাম এদেন উদ্যান। আমরা যদি আমাদের মনে কিছু প্রশ্ন উদয় করি তবে আমরা এইরুপ কিছু প্রশ্ন আমাদের মনে আনতে পারি যথাঃ- শুরুতে এদেন বাগান কেমন ছিল? সেখানে প্রথমে তারা কেমন ছিল? আদমের সাথে অন্য সৃষ্টির সম্পর্ক কেমন ছিল? আদমের যা দরকার তা সবকিছুই কি সেখানে ছিল? তাদের কি যথেষ্ট খাদ্য ছিল? যথেষ্ট সুরক্ষা ছিল? তাদের কি রোগের মধ্যে পরতে হতো? পতনের সময় অমঙ্গল/মন্দতা জগতে প্রবেশ করলো, কেবলমাত্র নৈতিক মন্দতাই নয়, শারীরিক মন্দতাও প্রবেশ করল। পতনের আগে যথেষ্ট খাবার ছিল, কোনো ভূমিকম্প ছিল না, বন্যা ছিল না, খরা ছিল না। পতনের ফলস্বরূপ আমাদের কাছে সমস্ত কিছুই প্রবেশ করলো। আজ আমাদের বিভিন্ন সংকট রোগ ও বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় যা কিনা পাপের কারণেই আমাদের সামনে এসেছে। আমরা যদি লক্ষ করি তাদের পাপের কারণে তারা সমস্ত বস্তুগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হল, বিতারিত করা হলো সেই এদেন উদ্যান থেকে যেখানে ঈশ্বর তাদের পরিকল্পিতভাবে রেখেছিলেন (আদিপুস্তক ৩ : ২৩)। আজ প্রভু যীশুর জন্ম আমাদের এই বার্তায় দেয় যে—“যা হারিয়ে গিয়েছিল তার অন্নেষণ করতেই মনুষ্যপুত্র এসেছেন” ( লুক ১৯ : ১০)। লূক ২ : ১১ পদে বলে,“অদ্য দায়ুদ নগরে তোমাদের জন্য এক ত্রাণকর্তা জন্মিয়াছেন, তিনি খ্রীষ্ট প্রভু।” আজ সত্যি করেই তিনি সমগ্র মানব জাতিকে তাদের সমস্ত বন্ধন থেকে স্বাধীন করতে চান। তাঁকে বিশ্বাস করার মধ্যে দিয়ে আমরা সেই অধিকার ফিরে পেতে পারি যা আদমের মধ্যে দিয়ে আমরা শুরুতেই হারিয়েছিলাম। আজ প্রভু যীশু আমাদের সমস্ত মূল্য তিনি ক্রুশের ওপরে দিয়েছেন যেন আমরা সেই স্বাধীনতা ফিরে পায় (গালাতীয় ৫ : ১)।