আমার বাংলাদেশের বয়স প্রায় অর্ধশতাব্দীতে পর্দাপণ করেছে। অগ্রজ খ্রিষ্টিয় ব্যক্তিবর্গের কাছে জানার চেষ্টা করেছি, বড়দিনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানটির সূচনা কীভাবে হয়েছে! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হলেও বড়দিনের অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। মহান জাতীয় সংসদে কোরআন তেলওয়াতের পাশাপাশি ত্রিপিটক, গীতা এবং বাইবেল পাঠের দাবি উত্থিত হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু হৃদ্যতার সাথেই সংসদে গ্রহণ করেছিলেন। বোধ করি, খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রথম উপস্থিত হয়েছিলেন ‘ডেইলি অবজারভার’ সম্পাদক জনাব ইকবাল সোবহান চৌধুরী। সময়কাল সম্ভবত ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের বড়দিনে, আয়োজন করেছিল জাতীয় চার্চ পরিষদ-বাংলাদেশ (এনসিসিবি)। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে বড়দিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হলে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এবার আয়োজন করা হয় মগবাজারস্থ ‘বাংলাদেশ এসেমব্লিজ অফ গড চার্চ’-এ। ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মেজর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে খ্রিষ্ট সম্প্রদায় একটি স্মারকলিপি সাহায্যে বড়দিনের অনুষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবি উত্তোলন করে। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করে আর্চবিশপ মাইকেল রোজারিও, স্যামসন এইচ চৌধুরী, বিশপ মাইকেল ডি রোজারিও, রেভা. সুভাষচন্দ্র সাংমা, বিশপ বি ডি মণ্ডল, ম্যাথিউ মালাকার স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিটি হস্তান্তর করেন। ৪টি দাবির তৃতীয় দাবিটি ছিল—‘State functions are organized by the Government on different occasions. Leaders from various groups and communities are invited to those functions. Seldom Leaders of the Christian Communities, Catholic and Protestant are invited. This is gives us a feeling of being left out of state and national events. We shall be most obliged if our Leaders are allowed to participate in such events.’
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বেশ কয়েকবার খ্রিষ্ট বিশ্বসীদের আয়োজিত বড়দিন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়েছিলেন। জাতীয় চার্চ পরিষদ ও ন্যাশনাল খ্রিষ্টিয়ান ফেলোসিপ অফ বাংলাদেশ (এনসিএফবি)-এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি ড. ডেনিস দিলীপ দত্ত স্মৃতিচারণ করছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বড়দিনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন এবং যথারীতি মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। আমি লক্ষ করলাম, আমাদের সবার পায়ে জুতো থাকলেও তাঁর পায়ে কোনো জুতো ছিল না, কারণ বড়দিনের পবিত্র ও ভাবগাম্ভীর্যের বিষয়টি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছিলেন। আমরা তাঁর সম্মানবোধে লজ্জ্বিত হয়েছিলাম।’ ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে এক প্রকার বাধ্য হোন। ড. দত্ত জানাচ্ছিলেন, সম্ভবত বিচারপতি আহমদের সময়কালেই বঙ্গভবনে খ্রিষ্টিয় ব্যক্তিবর্গরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। অতঃপর শুরু হলো রাষ্ট্রপতি ভবনে খ্রিষ্টধর্ম নেতৃবৃন্দের যাতায়াত।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তদানন্তীন ব্রিটিশ বাংলা প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি প্রদেশ সৃষ্টি করার ঐতিহাসিক পটভূমিতে বঙ্গভবনের সূচনা হয়। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের এক ঘোষণায় ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর সদ্য নতুন প্রদেশ গঠিত হয় এবং ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে মনোনীত করা হয়। সৃষ্ট নব প্রদেশের প্রধান শাসক লেফটেন্যান্ট গভর্র্নর নিযুক্ত হন স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার। ঢাকার নবাবদের বিশেষত দিলকুশা বাগান বাড়ির দক্ষিণাংশ ইজারা নিয়ে নির্মাণ করা হয় অস্থায়ী গভর্র্নমেন্ট হাউজ। পরবর্তীকালে তার উত্তসূরীরাও যারা পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের ছোটলাট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে—স্যার লান্সলট হেয়ার, স্যার স্টুয়ার্ট বেইলি এবং তাদের সহধর্মীগণ ব্রিটিশ ঐতিহ্যের দিলকুশার রাজপ্রসাদে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সৃষ্টি করেন যা যুগের পরিবর্তনে আজও স্থায়ী হয়ে আছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হলে ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বঙ্গভবন নামে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির অফিস ও বাসভবন হিসেবে এক নব অধ্যায়ের পথ উন্মোচিত হয়। রয়েছে ঐতিহাসিক দরবার হল; এখানেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ধর্মীয় উৎসবাদি—ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ উল আযহা, জন্মাষ্টমী, দূর্গাপূজা, বুদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন, বাংলা নববর্ষসহ সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবারিক অনুষ্ঠানমালায় মুখরিত হয়ে উঠে দরবার হল।
২.
খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিনের দিনে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অতীতে বেশ কয়েকবার অবগত হলেও তেমন আমলে নিইনি; কিন্তু এবার আমার পরিবারের সাথে যুক্ত হওয়ায় সত্যটি স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হয়েছে। আমেরিকান ইণ্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি—বাংলাদেশ, নর্থ-সাউথ ইউনির্ভাসিটিসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২৫ ডিসেম্বর, প্রভু যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিনে সেমিস্টার পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে; এবারও অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) তথ্যমতে, ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের নানান প্রান্তে শিক্ষাদান করে আসছে। এছাড়াও রয়েছে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার খ্রিষ্টিয়ান ছেলেমেয়েরা অধ্যয়ন করছে। আমরা ইতোপূর্বেও অবলোকন করেছি, ‘বড়দিনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা’ (২০ ডিসেম্বর, ২০১৩; বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)। আবার নিশ্চিত হয়েছি যে, প্রভু যিশু খ্রিষ্টের পুনরুত্থান অর্থাৎ ইস্টার সানডে’তেও যথারীতি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে; শুধুমাত্র ক্যারিয়ারের দিকে তাকিয়ে খ্রিষ্টিয়ান ছেলেমেয়েরা গুরুজন, শিক্ষকদের মতামতকে উপেক্ষা করার সাহস দেখাতে পারে না। হতাশা, ক্ষুব্ধতা এবং শিক্ষকদের প্রতি ভক্তিহীনতায় পরীক্ষার হলে উপস্থিত হয়ে থাকে।
স্বাধীন দেশের নাগরিক এবং সাংবিধানিকভাবে ধর্মীয় নিরপেক্ষতার দেশে ধর্মীয় উৎসবদিনে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে কিনা ভেবে দেখা দরকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২.ক তে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ অনুচ্ছেদ ২৮.১ এ বলা হয়েছে ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ এবং ২৮.৩ তে রয়েছে—‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।’ অর্থাৎ মর্মাথ আমরা যেটি বুঝেছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, পরীক্ষা কিংবা রেজাল্টের ক্ষেত্রেও ধর্মকে কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর রক্তে রঞ্জিতের প্রতীক সবুজ জমিনের ওপর লাল রং পতাকা আমাদের অসাম্প্রদায়িকতারই প্রতীক। একটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যেতে না যেতেই একি দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যপীঠগুলো! ধর্মীয় উৎসবাদিকে বা ধর্মীয় অধিকারকে ক্ষুণœ করে কখনো মহত্ত্বর গুণাবলী অর্জন করা সম্ভবপর নয়।
২৫ ডিসেম্বর, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের বড়দিনে মাননীয় রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে সব ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম ও আচার ও অনুষ্ঠানাদি স্বাধীনভাবে পালন করে আসছে। বিদ্যমান সম্প্রীতির এই সুমহান ঐতিহ্যকে আরও সুদৃঢ় করতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখতে হবে। …জাতির পিতা একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।’ সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতেও উল্লেখ করেছেন, “বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। …‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সবাই একসঙ্গে উৎসব পালন করব। আমাদের সংবিধানে সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সবাই মিলে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। তাই এই দেশে আমাদের সবার। বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, দয়া করে ধর্মীয় উৎসবাদিতে পরীক্ষা, ক্লাস কিংবা আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলোকে এড়িয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করলে আমরা কৃতার্থ হবো। আমাদের ছেলেমেয়েরা সম্প্রীতির বাংলাদেশকে ভালোবাসবে, সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাবে।
● মিথুশিলাক মুরমু : গবেষক ও লেখক।