প্রভু যীশুর জন্ম কোনো ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা নয় বরং আধ্যাত্মিক, যখন আমরা তাঁকে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি, যখন তিনি আমাদের জীবনে বাস্তব হয়ে উঠে, যখন আমরা ভালোবাসা মানুষে মাঝে, অকারে বিলিয়ে দেই তখনেই তিনি আমাদের হৃদয়ে জন্মগ্রহণ করেন। অদৃশ্য ঈশ্বর ইম্মেনুয়েল নাম ধারণ করে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন।
বছর ঘুরে বড়দিন আসে, বড়দিন বারবার বার্তাদিয়ে যায়, পাপী মানুষের পাপমুক্তের জন্য এই ধরাতে প্রভু যীশু মানুষ বেশে এসেছিলেন। প্রভু যীশুর জন্ম ঐতিহাসিক ভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যীশুর জন্ম ছিল অনেক আশ্চর্যপূর্ণ। অনেকে বলে থাকে যীশু তো মানুষ বেশে না আসলেও পারতেন! মানুষের পাপ ক্ষমা তো স্বর্গ থেকেও করতে পারতেন তার হুকুমেই তো সব সম্ভব! কারণ তিনি সর্বক্ষমতার অধিকার, আর কেনই বা কোনো রাজদরবারে জন্মগ্রহণ না করে দরিদ্রবেশে গোয়াল ঘরে জন্মগ্রহণ করলেন?
সৃষ্টির শুরুতে কোনো পাপ, অবিচার, অসুস্থতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ মহামারি, হিংসা, লোভ ছিল না। মানুষ স্বর্গের সুখে এদোন বাগানে বাস করতেন। তাদের কোন কিছু অভাব ছিল না ঈশ্বর নিয়মিত তাদের খোঁজ খবর নিতেন। তখন পর্যন্ত সব কিছু ঈশ্বরের ইচ্ছায় চলছিল। কিন্তু ঈশ্বর ও মানুষের শত্রু শয়তান আর ঠিক থাকতে পারল না। নারীর মধ্যে দিয়ে তিনি মানুষকে অবাধ্য করলেন ঈশ্বর থেকে। আর এই অবাধ্যতার মধ্যে দিয়ে মানুষের মধ্যে পাপ প্রবেশ করল।
ঈশ্বর যেহেতেু শতভাগ পবিত্র, তাই তার পক্ষে কোনো অপবিত্র মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সম্ভব না। তাই ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিলেন, হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক পুনঃউদ্ধারে তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে এই পৃথিবীতে পাঠাবেন। বিভিন্ন নবী / ভাববাদীদের মধ্যে দিয়ে তিনি তা পূর্বে প্রকাশ করেছিলে। আমরা পূর্বে দেখেছি যে, ঈশ্বর ওয়াদা করেছেন, স্ত্রীলোকের মধ্যে দিয়ে একজন ব্যক্তি আসবেন যিনি শয়তানের মস্তক পিষে দিবেন (তৌরত শরীফ, পয়দায়েশ ৩ : ১৫)। তাহলে এখন প্রশ্ন! স্ত্রীলোকের মধ্যে দিয়ে এ পৃথিবীতে কে এসেছেন? প্রধান দুই ধর্মীয়গ্রন্থ বাইবেল ও কুরআন এক কথায় স্বীকার করে নেয় একমাত্র যীশু খ্রীষ্ট এই পৃথিবীতে বাবা ছাড়া মায়ের মধ্যে দিয়ে এসেছেন। এটা ঈশ্বরের অলৌকিক কাজ। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা অদ্বিতীয়।
অন্যদিকে যদি ঐতিহাসিকভাবে দেখি, তাহলে দেখতে পারি সে সময় ঈসরাইল জাতি রোমীয় শাসকদের শাসনের অধীনে চলে গিয়েছিল। তাদের নির্যাতনে সারাদেশ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। রোমীয়দের শাসন অনেক দূর বিস্তারিত হয়েছিল। সেসময় ঈসরাইল দেশে প্রায় ছয় দলে বিভক্ত হয়েছিল, সব দলই চাইছিল মুক্তি। কেউ-বা চাচ্ছে, ঈশ্বর কাউকে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের উদ্ধার করবে, কেউবা সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। এটা ছিল একটা ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি। আর এদিকে প্রায় ৪০০ বছর ধরে ঈসরাইল জাতির কাছে কোনো নবী/ভাববাদী আসছিল না, বিভিন্ন সময় ঈশ্বর বিভিন্ন নবী/ভাববাদীদের পাঠিয়ে ঈসরাইল জাতিকে সঠিক দিক-নির্দেশনা ও পরিচালনা করতেন। তাদের মধ্যে এটাও ধারণা ছিল, তারা যদি ঈশ্বর থেকে দূরে সরে যায় তাহলে ঈশ্বর তাদের অন্য জাতির হাতে তুলে দিতেন। তারা আবার ঈশ্বরের দিকে মন ফিরালে তাদের আবার উদ্ধার করতেন। আর এজন্য ঈসরাইল জাতি চাইছিল তাদের উদ্ধারের জন্য ঈশ্বর অবশ্যই মশীর মতো কাউকে পাঠাবেন রোমীয় জাতিকে পরাজিত করে তাদের উদ্ধারের জন্য। কিন্তু ঈশ্বর পূর্ব থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন তাদের উদ্ধারের জন্য একজনকে পাঠাবেন তবে ঈসরাইল জাতি চাওয়ার সাথে ঠিক সেই মিলটা ছিল না, তিনি তাদের জাগতিক নয় বরং আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য যীশুকে পাঠিয়েছিলেন। যদি আমরা দেখি তাহলে হয়রত মুসা নবীর মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর বলেছেন, “তোমার ভাইদের থেকে তোমার মতো একজন দাঁড় করাব, যার কথায় তোমাদের চলতে হবে, তার মুখ দিয়ে আমি আমার কথা বলব, সে আমার বাধ্য থাকবে, তাঁর কথা যদি কেউ না শোনে তাকে দোষী বলে গণ্য করা হবে। ” (তৌরত শরীফ দ্বিতীয় বিবরণ ১৮ : ১৬-১৬)
উপরোক্ত পদ আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা দেখি যে, কার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর তাঁর মুখের কথা বলেছেন নিশ্চই যীশু খ্রীষ্টের মধ্যে দিয়ে। যীশুর জন্মের প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে ঈশ্বর ইশাইয়া নবীর মধ্যে দিয়ে ভবিষদ্বাণী করেছিলেন, খ্রীষ্ট একজন সতী অবিবাহীত কুমারী গর্ভে জন্মিবেন তাঁর নাম রাখা হবে ইম্মানুয়েল ( ইশাইয়া নবীর কিতাব ৭ : ২) আর সেই ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা আমরা দেখতে পাই—
( মথি ১ : ১৮-২৫)
১৮ যীশু খ্রীষ্টের জন্ম এরূপে হয়েছিল। তাঁহার মাতা মরিয়ম যোষেফের প্রতি বাগ্দত্তা হলে তাঁদের সহবাসের পূর্বে জানা গেল, তাঁর গর্ভ হয়েছে—পবিত্র আত্মা হতে। ১৯ আর তাঁর স্বামী যোষেফ ধার্মিক হওয়াতে ও তাঁকে সাধারণের কাছে নিন্দার পাত্র করতে ইচ্ছা না করাতে, গোপনে ত্যাগ করার মানস করলেন। ২ ০ তিনি এই সকল ভাবছেন, এমন সময় দেখ, প্রভুর এক দূত স্বপ্নে তাঁকে দর্শন দিয়ে বললেন, যোষেফ, দায়ূদ-সন্তান, তোমার স্ত্রী মরিয়মকে গ্রহণ করতে ভয় করো না, কেননা তাঁর গর্ভে যা জন্মেছে, তা পবিত্র আত্মা হতে হয়েছে; ২১আর তিনি পুত্র প্রসব করবেন, এবং তুমি তাঁর নাম যীশু (ত্রাণকর্তা) রাখবে; কারণ তিনিই আপন প্রজাদিগকে তাদের পাপ হতে ত্রাণ করবেন। ২২ এই সকল ঘটল, যেন ভাববাদী দ্বারা কথিত প্রভুর এই বাক্য পূর্ণ হয়, ২৩ ‘‘দেখ, সেই কন্যা গর্ভবতী হবে, এবং পুত্র প্রসব করবে, আর তাঁর নাম রাখা যাবে ইম্মানুয়েল;” অনুবাদ করলে এর অর্থ, ‘আমাদের সহিত ঈশ্বর’।
২৪ পরে যোষেফ নিদ্রা হতে উঠে, প্রভুর দূত তাঁহাকে যেরূপ আজ্ঞা করেছিলেন, সেরূপ করলেন, আপন স্ত্রীকে গ্রহণ করলেন; ২৫ আর যে পর্যন্ত ইনি পুত্র প্রসব না করবেন, সে পর্যন্ত যোষেফ তাঁর পরিচয় নিলেন না, আর তিনি পুত্রের নাম যীশু রাখলেন।
তখনকার লোকেরা মসীহের আশায় ছিল। রোমীয়রা সারা পৃথিবী শাসন করতেছিল। ইহুদিরা রোমীয়দের দ্বারা অত্যাচারিত ও নির্যাতনে নিপীড়িত। তারা আশা করেছিল মসীহ আসবেন এবং তাদের উদ্ধার করবেন। সত্যিই যীশু এসেছিলেন তবে রাজা বেশে নয় দরিদ্র বেশে পাপীদের মুক্তি দিতে।
দিনটির তাৎপর্য
“মনে রেখ, ইবনে আদম সেবা পেতে আসেনি বরং সেবা করতে এসেছেন এবং অনেক লোকের মুক্তির মূল্য হিসাবে নিজের প্রাণ দিতে এসেছেন” (ইঞ্জিল শরীফ, মার্ক ১০ : ৪৫) এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, মুক্তির মূল্য কিসের মুক্তি? একজন কয়েদীর কাছে তার কাছে আনন্দের দিন হচ্ছে, যে দিন সে মুক্তি পাবে, এ দিনের অপেক্ষায় সে থাকে, তার মুক্তির দিনেই হচ্ছে তার কাছে বড় দিন। ঠিক তেমনি মানুষ শয়তানের পাপ জগতে বন্দি, আর এই পাপ জগত থেকে বেরিয়ে আসতে মুক্তি একটি মাধ্যম বা উপায়। একারণে যীশুর মধ্যে দিয়ে সব পাপের মুক্তি পায়। তাই তাদের কাছে যীশুর জন্মদিনেই বড় দিন, তাদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন।
দিনটি যে ভাবে পালিত হয়
রোমানদের মধ্যে জন্মদিন পালনের কোনো রীতি নীতি ছিল না। আর এ কারণে যিহুদীরা জন্মদিন পালনে বিশ্বাসী ছিলেন না। তারা শুধু রাজা যে দিন সিংহাসনে বসবে সে দিন পালন করতেন। যীশুর প্রথম জন্মদিন পালন করেন আর্মেনীয়ান খ্রীষ্টানরা, তারা এক সঙ্গে পুরো জাতি যীশুকে গ্রহণ করেছিলেন। তারা যখন দেখলেন যীশুর স্বীকৃত কোনো জন্মদিন নেই তখন তারা ৬ই জানুয়ারি যীশুর জন্মদিন হিসাবে পালন করতে শুরু করলেন। এরপর ৩৩৬ খ্রীষ্টাব্দে রাজা কনস্টাইন যখন যীশুকে গ্রহণ করলেন, তখন থেকে ২৫ ডিসেম্বর যীশুর জন্মদিন হিসাবে স্বীকৃতভাবে পালিত হয়ে আসছে। সারা পৃথিবীর খ্রীষ্টানরা অনেক আনন্দে এই দিন পালন করে আসছেন। খ্রীষ্টানরা এই দিনটিতে শুধু আনন্দ উপভোগ করে না। বরং সবার প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা দেখায়।
যীশু এই পৃথিবীতে মাত্র ৩২/৩৩ বছর বেঁচে ছিলেন, তাঁকে ঈশ্বরের বিশেষ কার্য্য সাধনের জন্য ক্রুশে জীবন দিতে হয়েছিল, যদিও বা তাঁকে ক্রুশে দেওয়ার মতো কোনো দোষ খুঁজে পাননি রোমীয় সম্রাট পন্তিয় পীলাত। তারপরেও তাঁকে এই শান্তি ভোগ করতে হয়েছিলল। যীশু অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন, তিনি পেশায় ছিলেন একজন ছুতার মিস্ত্রি, তিনি ন্যায়, আদর্শবান ও কর্মঠ পুরুষদের আদর্শ। তিনি ছিলেন ঈশ^রের মেশশাবক ও চূড়ান্ত কোরবানি। “ঈশ্বর মানুষকে এত ভালোবাসলেন যে তাঁর প্রিয় পুত্রকে দান করলেন, যে কেউ সেই পুত্রের উপর ঈমান/বিশ্বাস আসে সে বিনষ্ট না হয় কিন্তু অনন্ত জীবন পায় (ইঞ্জিল শরীফ ইউহোন্না ৩ : ১৬)
প্রতি বছর ঘুরে-ফিরে বড়দিন আসে, আমাদের এই বারতা দিয়ে যায়, মানুষ্যপুত্র দরিদ্রবেশ ধারণ করে এসেছিল এই ধরণীতে, তিনি মানুষকে ভালোবাসে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
সব ধর্মই সম্প্রীতির কথা বলে। এ সম্প্রীতি বজায় রাখলেই বিশ্ব শান্তিময় হবে। মানুষে- মানুষে বন্ধুত্ব ও প্রীতি বাড়বে। একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। সমাজ শান্তি হবে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামবে। ভালোবাসা দিয়ে থামাতে হবে হানাহানি। পৃথিবীতে ফিরে আসুক শান্তি, এটাই হোক বড় দিনের বারতা।
নাহিদ বাবু : তরুণ লেখক ও খ্রীষ্টিয় ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়নরত।